টোফু খেলে কি জাপানিদের মতো বহু বছর অবধি তারুণ্য ধরে রাখা যাবে? জানতে পড়ুন ‘তোফা স্বাদের টোফু’। লিখেছেন ব্রতীন দাস।
দেখতে পনিরের মতো। কিন্তু মুখে দেওয়ার পর চেনা স্বাদ পাচ্ছেন না। মনে হচ্ছে নতুন কিছু? ভাবছেন, এটা আবার কী খেলেন! রান্নার গুণ নিয়ে প্রশ্ন তোলার দরকার নেই। কারণ, ওটা পনির নয়। টোফু। সোজা কথায় বলতে গেলে সয়াবিনের চিজ। খেতেও মন্দ নয়, চীনা, জাপানিদের দেখাদেখি তো বিলেতের মানুষজন কবে থেকেই খাওয়া শুরু করেছেন। বাঙালির তো আবার ছানার ডালনা ছাড়া রোচে না। কিন্তু দিন বদলেছে। বদলাচ্ছে খাবারের ধরনও। আর তাই বাঙালির হেঁশেলও এখন সমান জনপ্রিয় টোফু।
এটা ঠিক যে প্রোটিনের নতুন হদিশ মিলতেই বাংলায় সয়াবিনের চাঙ্ক বা বড়িকেই আপন করে নিয়েছিলেন গৃহিণীরা। ছয়ের দশকের শেষ দিকে এক মার্কিন কোম্পানি প্রথম তৈরি করে সয়া বড়ি। ভারতের কোনও বাণিজ্যিক সংস্থা এগিয়ে না আসায় এক মার্কিন মিশনারি নিজেই ফ্যাক্টরি খুলে ফেলেন উত্তরপ্রদেশে। ১৯৭২ সাল নাগাদ তৈরি হয় সয়া বড়ি। প্রথমে গরিবদের মধ্যে বিলি করা হয়। কিন্তু খুব একটা সাড়া মিলল না। তখন অনেকটা ঘুরিয়ে নাক ধরার মতো করে রংচঙে প্যাকেটে ভরে বাজারে আনা হল নিউট্রি নাগেট। মাংসের প্রক্সি দিতে বাঙালির হেঁশেলে ঢুকে পড়ল সয়া বড়ি। নতুন স্বাদে মজল আমজনতা।
তবে সয়াবিনের পরিচয় কিন্তু আরও অনেক আগে। সালটা ১৯৩০। নিরামিষ খাবারে প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে মহাত্মা গান্ধী তাঁর অনুগামীদের সয়াবিন খাইয়েছিলেন। ডাল, রাজমার মতো ভিজিয়ে, তারপর সেদ্ধ করে খাওয়া হতো সেই সয়াবিন। রবীন্দ্রনাথের শ্রীনিকেতনে যেসব ফসল পরীক্ষামূলকভাবে চাষ হয়েছিল, তার মধ্যেও ছিল সয়াবিন।
তবে সয়াবিনের সঙ্গে যোগ রয়েছে এমন দু’জন বাঙালি বিজ্ঞানীর নাম না করলেই নয়। একজন বীরেশচন্দ্র গুহ, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ছাত্র, অক্ষয় দত্তের ভাগ্নে। বাংলায় তখন মন্বন্তর চলছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত তিনি। দুধের আকাল। বীরেশচন্দ্র সেসময় সয়াবিন ও অন্য কিছু উদ্ভিদ থেকে দুধ প্রস্তুত করেন। চমকে যান সবাই। পরীক্ষা করে দেখা যায় গোরুর দুধের মতোই পুষ্টিগুণ সেই দুধের। অন্য বাঙালি বিজ্ঞানী শশাঙ্ক এস দে। তিনি তখন কাজ করছেন বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সে। ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর গবেষণাপত্র। তাতেই জানা যায়, অনাথ আশ্রম, বস্তি ও সরকারি স্কুলের প্রায় সাড়ে ছ’হাজার শিশুকে সয়াবিনের দুধ খাইয়েছেন তিনি। স্বীকৃতি পেয়েছে সেই দুধের পুষ্টিমূল্য। পরে আমেরিকার এমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এনিয়ে কাজ করেন তিনি। সয়াবিনের দুধকে কীভাবে আরও পুষ্টিকর, সস্তা করা যায়, তা নিয়ে অনেক গবেষণামূলক লেখা লিখেছেন শশাঙ্ক দে। তাঁর সেসব লেখা পথ দেখিয়েছে টোফুকে আপন করে নিতে।
দেখতে অনেকটা একইরকম হলেও টোফু আদতে পনির নয়। তবে দু’টিই স্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবে পরিচিত। বেশিরভাগ মানুষ অবশ্য পনির ও টোফুর মধ্যে পার্থক্য জানেন না। আলাদা করে দু’টিকে চিনতেও পারেন না। অথচ দু’টি খাবারের মধ্যে রয়েছে অনেক পার্থক্য। পুষ্টিগুণেও বিস্তর হেরফের। পনির প্রাণীজ প্রোটিন। আর টোফু উদ্ভিজ্জ। ছাগল, গোরু আর মোষের দুধ থেকে তৈরি হয় পনির। আর টোফু তৈরি হয় সয়াবিনের দুধ থেকে।
অনেকই আছেন যাঁরা দুধ খেতে পারেন না। তাহলে ক্যালশিয়ামের ঘাটতি পূরণ করবেন কী করে। আর ক্যালশিয়ামের চাহিদা পূরণ না হলেও তো ভারী মুশকিল। কারণ, আমাদের শরীরের জন্য এটি একটি অতি প্রয়োজনীয় মৌল। বিশেষ করে হাড় ও দাঁতের স্বাস্থ্যরক্ষায় ক্যালশিয়াম বিশেষ জরুরি। ক্যালশিয়ামের চাহিদা অনেকটাই মিটতে পারে দুধ থেকে। কিন্তু অনেক মানুষই রয়েছেন, যাঁরা ল্যাকটোজ ইনটলারেন্ট অর্থাৎ দুধ সহ্য হয় না তাঁদের।
তাছাড়া এখন অনেকেই ভিগান জীবনধারা মেনে চলেন। বলিপাড়াতেও এখন ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে ভেগানিজম। আলিয়া ভাট থেকে আমির খান, বি টাউনের অনেকেই ভিগান জীবনধারায় বিশ্বাসী। মাছ, মাংস তো দূরের কথা, কোনও ধরনের প্রাণীজ খাবার, এমনকী দুধও খান না ভিগানরা। এ ধরনের জীবনধারায় খাদ্য তালিকা থেকে বাদ পড়ে অনেক কিছুই। ভিগান তাহলে তাঁদের শরীরে পুষ্টির চাহিদা মিটবে কীভাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক্ষেত্রে ঘাটতি মেটাতে পারে তোফু।
দুধ থেকে ঠিক যেভাবে ছানা কাটা হয়, তেমনই সোনালি সয়া বীজ থেকে প্রথমে দুধ বের করা হয়। সেই দুধ থেকে ছানা কাটা হয়। এটিই তোফু। আমাদের শরীরে যে ৯ ধরনের অ্যামাইনো অ্যাসিড অতি প্রয়োজনীয়, তার সবগুলিই রয়েছে তোফুর মধ্যে। বিশেষজ্ঞদের মতে, রোজ তোফু খাওয়া উচিত। কারণ, এটি বহু রোগের মুশকিল আসান। সুস্থভাবে বাঁচতে হলে শরীরের দরকার খনিজ, আয়রন, ক্যালশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ফসফরাস, ম্যাগনেশিয়াম, কপার ও জিঙ্ক। ফ্রেশ তোফু থেকে মিলতে পারে এগুলির সবই। তোফু দিয়ে অনেক কন্টিনেন্টাল রান্নাও হয়। গোটা দুনিয়ার কাছে বর্তমানে এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় খাবার। হালকা ভেজে স্যালাডের সঙ্গেও তোফু খাওয়া যেতে পারে। হট গার্লিক তোফুও একটি লোভনীয় পদ। তোফু আর আলুর ডালনা খেয়ে দেখতে পারেন, মন্দ লাগবে না এটা নিশ্চিত!
ব্রেকফাস্টে সেদ্ধ ডিম খেতে খেতে যদি বিরক্তি ধরে গিয়ে থাকে, তাহলে বদলে ফেলতে পারেন মেনু। ডিমের পরিবর্তে জায়গা দিতে পারেন তোফুকে। প্রায় একইরকম পুষ্টিগুণ সম্পন্ন, ডিমের আদর্শ বিকল্প হতে পারে এটি। সয়াবিনের দুধ থেকে তৈরি এই খাবারটির জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে।
গোরুর দুধের তুলনায় সয়াবিনের দুধে ক্যালশিয়ামের পরিমাণ কিছুটা কম থাকলেও টোফু নিতান্তই উপেক্ষা করার মতো। তাছাড়া এই খাবারে কোলেস্টেরল বৃদ্ধির কোনও আশঙ্কা নেই। শুধু তাই নয়, গোরুর দুধের তুলনায় সয়াবিনের দুধে সম্পৃক্ত ফ্যাটের মাত্রাও অনেক কম। বাঙালির রান্নাঘরে এখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে টোফু। ভালো মানের আধ কাপ টোফু থেকে ক্যালশিয়াম পাওয়া যেতে পারে ৮০০ মিলিগ্রাম, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
পুষ্টিবিদরা বলছেন, পনিরকে কটেজ চিজও বলা যেতে পারে। দুধ থেকে তৈরি হয় বলে পনিরে প্রোটিন ভরপুর। পনিরকে নরম করার জন্য অনেক সময় এতে ক্রিম যোগ করা হয়। কিন্তু এটি শরীরের প্রয়োজনীয় ফ্যাটের চাহিদা পূরণ করতে পারে না। তবে আপনি যদি কোনও সুস্বাদু খাবারের খোঁজ করেন, তা হলে টোফুর বদলে পনিরকেই বেছে নেওয়া সঠিক হবে আপনার।
অন্যদিকে সয়াবিন মিল্ক থেকে তৈরি হয় টোফু। এটি লো ফ্যাটযুক্ত খাবার। আপনি যদি ভিগান হন, তাহলে টোফুকে অনায়াসেই যোগ করতে পারেন আপনার খাবারের তালিকায়।
আপনি যদি ওজন কমাতে চান, কম ক্যালোরি যুক্ত খাবার খেতে চান, তাহলেও টোফুর জুড়ি মেলা ভার।
পনিরের তুলনায় টোফুতে অবশ্য ক্যালোরির পরিমাণ কম। ১০০ গ্রাম পনিরে যেখানে ক্যালোরি পাওয়া যায় ৩২১, সেখানে একই পরিমাণ টোফু থেকে ক্যালোরি মেলে ১৪৪। টোফু আইসোফ্লাভোনের একটি উল্লেখযোগ্য উৎস। যা বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি কমাতে পারে। গবেষণা বলছে, আইসোফ্লাভোন সমৃদ্ধ খাবার নিয়মিত খেলে অস্টিওপোরোসিস, হৃদরোগ ও বেশ কিছু ধরনের ক্যান্সারের আশঙ্কা কমে যায়। পনির ভিটামিন ডি ও ক্যালশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার, যা মহিলাদের জন্য উপকারী বলে ধরা হয়। অন্যদিকে, টোফু সয়া প্রোটিন সমৃদ্ধ, যা কিডনির কার্যকারিতা উন্নত করতে সহায়ক। যাঁরা কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন, কিংবা ডায়ালিসিস চলছে, তাঁদের টোফু খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
পনির সবসময় টাটকা বিক্রি হয়। টোফু প্রসেসড হতে পারে। টোফুতে অবশ্য আয়রনের পরিমাণ অনেক বেশি। অন্যদিকে পনিরে ক্যালশিয়াম বেশি থাকায় আয়রন শোষণে বাধা সৃষ্টি করে। ১০০ গ্রাম টোফু শরীরে ২.৭ গ্রাম আয়রন সরবরাহ করতে পারে। এটা গ্লুটেনমুক্ত, কম ক্যালোরিযুক্ত এবং কোলেস্টেরলবিহীন খাবার হওয়ায় ক্যান্সার, হৃদরোগ ও অস্থিক্ষয় প্রতিরোধে সাহায্য করে।
ফ্যাটের কথা ভাবলে টোফু কিন্তু অনেকটাই এগিয়ে। পুষ্টিবিদরা পনিরকে ওজন কমানোর দিক থেকে সুপার ফুড বলে থাকেন। ১০০ গ্রাম পনিরে ফ্যাট থাকে ২০ গ্রাম।
সেখানে একই পরিমাণ টোফুতে ফ্যাট থাকে মাত্র ২.৭ গ্রাম। তবে পনিরে প্রোটিনের মাত্রা অনেকটাই বেশি। ১০০ গ্রাম পনিরে যেখানে প্রোটিন থাকে ১৮.৩ গ্রাম, সেখানে ওই পরিমাণ টোফুতে প্রোটিন থাকে ৬.৯ গ্রাম। তবে দুধ থেকে তৈরি হয় বলে পনিরে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ বেশি থাকে। টোফুর কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণও যথেষ্টই স্বাস্থ্যকর, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।