শরীর ও স্বাস্থ্য

মধ্যচল্লিশেও হার্ট অ্যাটাক!
এত বিরিয়ানি খাওয়া ছাড়ুন

হার্ট অ্যাটাক হওয়ার গড় বয়স আগের তুলনায় অন্তত ১০ বছর কমেছে। কেন এমন ভয়াবহ চিত্র? বিস্ফোরক বিশিষ্ট হার্ট সার্জেন ডাঃ কুণাল সরকার
 
 ডাক্তার হবেন, ঠিক করেই রেখেছিলেন? 
কিছুটা আত্মগোপন করেই ডাক্তারি পড়া। দাদু ছিলেন বিধানবাবুদের আমলের নামকরা ফিজিশিয়ান। জানি না, কোনওদিন তাঁকে না দেখলেও হয়তো সেটা রক্তের ভিতরে কাজ করত। আমাদের সময়ে ছেলেরা হয় অঙ্ক নিত, নয়তো বায়োলজি পড়ত। আমি বায়োলজি নিয়েছিলাম এক্সট্রা সাবজেক্ট হিসেবে। প্রথমে আইআইটিতে অ্যাডমিশন পাই। তারপর মেডিসিন জয়েন্টে পেলাম। মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারিতে ঢুকলাম। এমবিবিএস শেষ করে সার্জারিতে ঢুকব—এমন একটা বিষয় মাথায় ছিল। প্লাস্টিক সার্জারিতে খুব আগ্রহ ছিল। জানেন, দু’বছর প্লাস্টিক সার্জারি নিয়ে পড়াশোনাও করেছি। 
তখন আটের দশকের শেষ, নয়ের শুরু। চিকিৎসাতেও নতুন কিছু করার হাওয়া বইছে। বি এম বিড়লাতে হার্ট সার্জারির কিছু কিছু কাজ শুরু হয়েছে। আমি বিদেশে। এইসব খবর পাচ্ছি। সিনিয়র দাদারা বলছেন, চর্বিতচর্বন না করে, এইসব নতুন কিছু কর না! নববিস্ময়ের আনন্দ নিয়ে ইংল্যান্ডেই হার্ট সার্জারির পড়াশোনা শুরু করলাম। বলতে পারেন বড় ঝুঁকি নিলাম। কারণ, ওদের পড়াশোনাও ছকে চলে। ফসকে গেলেন তো ট্রাপিজের খেলার একেবারে উপর থেকে নীচে! যাই হোক, ফসকে যাইনি। 
পড়াশোনার পর্ব শেষ করে ১৯৯৬-এ দেশে ফিরলাম। তখন পিজিতে কিছু কাজ হচ্ছে। আর বি এম বিড়লাতে ডাঃ দেবী শেঠি কাজ করছেন। সত্যি বলতে কী, দেশের এই প্রান্তে হার্ট সার্জারির কাজকে প্রথম একটা সিস্টেমের মধ্যে আনলেন ডাঃ শেঠিই। প্রথম ব্যাকরণ দিলেন। বছর তিনেক এদিকওদিক কাজ করে তারপর ওঁর সঙ্গে আর এন টেগোরে কাজ শুরু করলাম। সেটা ২০০১। সদ্য সদ্য আর এন টেগোর শুরু হয়েছে। উনি, আমি আর ডাঃ আশুতোষ রঘুবংশী নতুন ভেঞ্চারে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ফলও মিলল। তিন-চার বছরে আর এন টেগোর হার্টের চিকিৎসা ও অপারেশনে দেশের প্রথম তিন-চারটি সেন্টারের মধ্যে চলে এল। ২০১৩ তে যোগ দিলাম মেডিকায়। 

আপনাদের প্রধান কাজ তো হার্টের রক্তবাহী ধমনী ও শিরা নিয়ে। বাঙালিদের হার্টের ধমনী কি সরু? 
আমাদের সমস্যা আছে। ডায়াবেটিসের প্রাদুর্ভাব, অল্পবয়স থেকেই ধূমপান এবং ছোটখাট শারীরিক কাঠামো হওয়ায় আমাদের হার্টের শিরা-ধমনীও ছোট, সরু। তার মধ্যে অল্পবয়স থেকেই সুগার হানা দেওয়ায় সেগুলি ক্ষয়ে ক্ষয়ে সুতোর মতো হয়ে যায়। 

কোন বয়সে ধমনীতে প্লাক জমা শুরু হয়?
সে তো তত্ত্বগতভাবে ১৪-১৫ বছরেই। কিন্তু আমাদের চিন্তা অন্যত্র। আমাদের চিন্তা হল তিরিশের শেষ, চল্লিশের শুরুতেই প্রচুর যুবকের সুগার ধরা পড়ছে। 

অল্পবয়সিদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকও তো বাড়ছে? সবচেয়ে কম কোন বয়সে পেয়েছিলেন? 
তার ন’বছর বয়স ছিল। সেটা জিনগত। কিন্তু সামগ্রিকভাবেও অবস্থাটা চিন্তার। 

কতটা? 
আসলে কেন হার্ট অ্যাটাক বাড়ছে, তা নিয়ে গত ৫০ বছর ধরে তেমন উল্লেখযোগ্য কাজই হয়নি। আমরা হার্ট সার্জেনরা এতগুলি বছর ধরে হয় অ্যাঞ্জিওগ্রাম, অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি নয়তো বাইপাস করে যাচ্ছি অথবা বড়ি লিখে যাচ্ছি। হার্ট অ্যাটাক নিয়ে আমাদের কথা শুনে দেখবেন, সবই কমবেশি এক টেপ বারবার বাজিয়ে যাওয়া। সেই কোলেস্টেরল, সেই সুগার, মোটা হওয়া, ধূমপান, পরিশ্রমবিমুখতা— এক গান! এই ছকের মধ্যে ১০ জন হার্ট অ্যাটাকের রোগীর মধ্যে বড়জোর ৬-৭ জনকে ফেলা যেতে পারে। কিন্তু ছিপছিপে শরীর, সুগার নেই, লিপিড ঠিক আছে, অল্প বয়স, অনিয়ম করেন না, হৃদরোগের বংশগত ইতিহাস নেই— তাঁদেরও হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে। কেন? সেই উত্তর নেই। এই ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ হার্ট অ্যাটাকের কারণ রহস্যই থেকে গিয়েছে।  
আসলে হার্টের অসুখ নিয়ে মানুষের বিচলিত হওয়ার সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৪৫-এ। যখন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট নিজের অফিসেই মারা গেলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার ঠিক আগে এই ঘটনা তোলপাড় ফেলে দিল। তার আগে মানুষের হার্ট অ্যাটাক নিয়ে অত মাথাব্যথা ছিল না। তখন ‘হার্ট অ্যাটাক’ বলাও হত না। রুজভেল্টের ঘটনাটিকেও বলা হল ‘করোনারি থ্রম্বোসিস’। শুরু হল হইচই। তারপরই হার্টের অসুখ নিয়ে একটি বড় ট্রায়াল শুরু হল। বিশ্ববিখ্যাত ‘ফ্রামিংহাম ট্রায়াল’। তার রিপোর্ট ছয়ের দশকের শেষ লগ্নে প্রকাশিত হল। সেই ট্রায়ালে যেসব কথা বলা হয়েছিল, আজও সেগুলিকেই হার্টের চিকিৎসায় বেদবাক্য মানা হয়। হ্যাঁ, টুকটাক লিপিড প্রোফাইল নিয়ে হয়তো নতুন কিছু বললাম বা সুগারের চিকিৎসা নিয়ে— কিন্তু সামগ্রিকভাবে নতুন বড় কী আর বলতে পারলাম? একটা উদাহরণ দিই। ধরুন গ্যাসট্রিক এবং ডিওডিনাম আলসার নিয়ে কয়েকশো বছর কাটিয়ে দিয়েছি আমরা। আমরা মনে করতাম, শুধু তেল, ঝাল, মশলাদার খাবারই বোধহয় এই আলসারের কারণ। আটের দশকে এল যুগান্তকারী আবিষ্কার। জানা গেল, এইচ পাইলোরি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ রয়েছে আলসারের পিছনে। 
আসলে আমি বলতে চাইছি, আমাদের চিকিৎসাশাস্ত্রে তেমন নতুন কিছু হল না। হার্ট অ্যাটাকের কারণ কি সংক্রমণ, না কি পরিবেশগত, না জিন— এখনও নির্দিষ্ট উত্তর মিলল না। আমরা স্টেন্ট, পেসমেকার, বেলুন কী ধরনের লাগানো হবে, সেইসব নিয়েই পড়ে আছি। গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো করে যাচ্ছি। দেখুন, একটা কোভিড মহামারী কত বড় ধাক্কা দিয়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে আমরা মাইক্রোবায়োলজি, ভাইরোলজি, ইমিউনোলজির আশ্রয় নিলাম। টিকা বেরিয়েও গেল। এরকম কোনও চাড় হার্টের চিকিৎসায় দেখছি না। 

কোভিড কি আমাদের হার্টে চিরস্থায়ী ছাপ রেখে গিয়েছে? 
মনে হয় না। যেটুকু হয়েছে ফাস্ট হার্ট রেট ইত্যাদি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাস তিনেকে ঠিক হয়ে গিয়েছে। কোভিড ছাপ রেখে গিয়েছে ফুসফুসে। 

হার্ট ভালো রাখতে কুণাল সরকারের টিপস কী? 
অল্পবয়সিদের জ্ঞান দেওয়া উচিত নয়। ওরা যথেষ্ট বুদ্ধিমান। তবে বলব বুদ্ধির পাশাপাশি অন্তর্দৃষ্টিটাও বাড়ালে ভালো। পরিবারে হার্টের রোগ ও সুগারের ইতিহাস থাকলে তিরিশ পেরলেই বছরে একবার রুটিন ব্লাড টেস্ট, ইকো, ইসিজি করে দেখে নেওয়া ভালো। চল্লিশ পেরলে তিন-চার বছর অন্তর একবার সিটি অ্যাঞ্জিও করে নেওয়া যেতে পারে। প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে হবে। দেখুন, আধুনিক জীবনযাপন তো অল্পবয়সিরা ছেড়ে দিতে পারবে না। তাও আমি বলি, কতগুলি জিনিস নিয়ে একটু ভেবে দেখতে পারেন। এক, সেক্টর ফাইভের কর্মরতদের বলব, রোজ রোজ বিরিয়ানি খেতেই হবে? ধূমপান মানেই পুরুষালি ব্যাপার— এমন ভাবা ছাড়বেন কবে? আপনারা যথেষ্ট ইন্টালিজেন্ট। একটু ভেবে দেখুন না, এগুলি কি লং রানে ভালো করবে? 
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, হার্ট অ্যাটাকের জন্য যেসব অল্পবয়সিকে অপারেশন থিয়েটারে পাই, তাঁদের সিংহভাগই কিন্তু হয় ধূমপায়ী, নয়তো জানতেনই না, হাই সুগার আছে।   

হার্ট অ্যাটাক হওয়ার গড় বয়স এখন কত? 
মাঝ চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের গোড়া। আগের থেকে ১০ বছর বয়সসীমা কমে গিয়েছে। 

বিতর্ক কুণাল সরকারের পিছু ছাড়ে না। একটু প্রশ্নোত্তর পর্ব হয়েই যাক।         
হোক। 

এত টিভিতে মুখ দেখান কেন? 
আমার ‘জীবনদর্শনের গুরু’ ডাঃ দেবী শেঠির কাছ থেকে শিখেছি, মানুষের সঙ্গে  চিকিৎসকের যোগাযোগ রাখা উচিত। ওঁর সময়ে এত সোশ্যাল মিডিয়া, টিভি চ্যানেল ছিল না। তিনি নিজের মতো করে নিজের দর্শন তুলে ধরেছিলেন। আমিও নিজের মতো করে করি। 

আবার ডাঃ শেঠির কাছে ফিরতে ইচ্ছা করে? 
(হাসতে হাসতে) আমাদের মধ্যে তো নিত্য যোগাযোগ আছে। 

কুণাল সরকার কি রাজনীতিতে নামতে চান? 
চাইলে অনেক আগেই নামতে পারতাম। রাজনীতি নিয়ে অন্ধ নই। তবে হ্যাঁ, এখনই ডাক্তারি ছাড়তে তীব্র অনীহা আছে (হাসি)।

আপনার চড়া ফিজের জন্য কত লোক দেখাতে পারে না। 
সেজন্যই তো মাসে ২-৩ টে হেলথ ক্যাম্প করি। সেখানে তো ফিজ নিই না। 

টিভিতে এত বলেন, কখনও মনে হয় না রাস্তায় নেমে মধ্যবিত্তদের সাধ্যের মধ্যে একটা হার্টের হাসপাতাল করি? 
বহুবার মনে হয়েছে। সেই ঝুঁকি নিতে গিয়েও শেষমুহূর্তে পিছিয়ে এসেছি। 

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের অন্যতম বড় সমালোচক আপনি?
আগেও বলেছি, আবারও বলছি, আমার মতে, স্বাস্থ্যসাথী হল আজকের সময়ের সবচেয়ে বড় বেহিসেবি সদর্থক স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্প। তবে এটাও ঘটনা, স্বাস্থ্যসাথীর জন্য বহু জটিল চিকিৎসা আজ বাংলার মানুষ বাংলাতেই বিনা পয়সায় করাতে পারছেন। আমিও তো অসংখ্য অপারেশন স্বাস্থ্যসাথীতে করি। ভবিষ্যতেও করব।    
11d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

মৃৎশিল্পী, ব্যবসায়ী প্রমুখদের বিশেষ কর্মোন্নতি যোগ প্রবল। পেশাদারি কর্মে শুভ ফল প্রাপ্তি। মানসিক চাঞ্চল্য।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.০৯ টাকা৮৪.৮৩ টাকা
পাউন্ড১০৯.৪৭ টাকা১১৩.০৪ টাকা
ইউরো৯১.০৬ টাকা৯৪.২৫ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা