বেশ কিছু খাবার আছে যা প্রকৃতপক্ষেই শরীরে ইউরিক অ্যাসিড কমাতে কার্যকরী। পরামর্শে ডায়েটিশিয়ান সুদেষ্ণা মৈত্র নাগ।
শরীরের বিভিন্ন কোষ ভেঙে এবং পিউরিন জাতীয় খাদ্যের আত্তীকরণের ফলে দেহে ইউরিক অ্যাসিড তৈরি হয়। সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড ইউরিনের মাধ্যমে শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। কোনও কারণে শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে গেলে এবং কিডনি সঠিকভাবে শরীর থেকে ইউরিক অ্যাসিড বের করতে না পারলে সেই সমস্যাকে ‘হাইপার ইউরিসিমিয়া’ বলা হয়। এই পরিস্থিতিতে শরীরে অতিরিক্ত মাত্রায় ইউরিক অ্যাসিড থেকে ক্রিস্টাল বা কেলাস তৈরি হয় যা দেহের বিভিন্ন জয়েন্টে জমে যায় এবং গাউট বা গেঁটে বাতের সমস্যা দেখা যায়। গাউট খুবই যন্ত্রণাদায়ক সমস্যা। কিডনিতেও ইউরিক অ্যাসিডের কেলাস জমা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। দেখা দিতে পারে কিডনি স্টোনের সমস্যা। এমনকী সঠিক সময়ে কিডনি স্টোনের চিকিৎসা না হলে কিডনির অসুখ দেখা দেওয়ার আশঙ্কাও থাকে। দীর্ঘদিন ধরে এমন সমস্যার চিকিৎসা না করালে হার্টের সমস্যা দেখা দেওয়ার ভয়ও থাকে। বৃদ্ধি পেতে পারে রক্তচাপ, ক্ষতিগ্রস্ত হয় লিভার। কিছু কিছু সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে, দেহে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বৃদ্ধিতে টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কাও বাড়ে।
ইউরিক অ্যাসিড জানার পরীক্ষা
রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে কি না তা রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমেই জানা সম্ভব। এছাড়া কারও কিডনি স্টোন হলে সেই স্টোনের পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে তা ইউরিক অ্যাসিড স্টোন নাকি অন্য কিছু।
বেশি ইউরিক অ্যাসিড মানেই কি গাউট?
কোনও ব্যক্তি গাউটে আক্রান্ত কি না তা জানতে হলে জয়েন্টে যে জলীয় পদার্থ জমা হয় তার মধ্যে ক্রিস্টাল জমা হয়েছে কি না তা জানতে হবে। বোন ইমেজিং, সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে ইউরিক অ্যসিডের ক্রিস্টাল আছে কি না তা বোঝা যায়। সাধারণভাবে পুরুষদের ক্ষেত্রে ইউরিক অ্যাসিড লেভেল ৭, মহিলাদের ক্ষেত্রে ৬ এবং শিশুদের ক্ষেত্রে ৫.৫-এর মধ্যে থাকাই বাঞ্ছনীয়। এই মাত্রার বেশি ইউরিক অ্যাসিড থাকলে তা অতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিড রয়েছে বলে ধার্য করা হবে।
তবে পরীক্ষার রেফারেন্স রেঞ্জ দেখে নেওয়া দরকার। কারণ কোন পরীক্ষাগারে কোন ধরনের কিট ব্যবহার করা হচ্ছে তার উপরেও ইউরিক অ্যাসিডের ফলাফল নির্ভর করে। তাই বিভিন্ন ল্যাবে ভিন্ন ধরনের ফলাফল দেখে বিভ্রান্ত হবেন না।
কী কী কারণে বাড়ে ইউরিক অ্যাসিড?
• অতিরিক্ত মাত্রায় পিউরিন আছে এমন খাদ্য যেমন প্রাণিজ উৎস থেকে পাওয়া লিভার, ব্রেন, কিডনি, হার্ট-এর মতো অর্গ্যান মিট খেলে বাড়তে পারে ইউরিক অ্যাসিড। রেড মিট, সি ফুড বেশি খেলেও শরীরে বাড়ে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা।
• মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানও রক্তে বাড়িয়ে তুলতে পারে ইউরিক অ্যাসিড। কিছু অসুস্থতা যেমন কিডনির সমস্যা থাকলেও রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বৃদ্ধির আশঙ্কা থেকে যায়। এছাড়া দেহের কোষগুলির অতিরিক্ত ক্ষয়ক্ষতি, কিছু ধরনের ক্যান্সার যেমন লিউকেমিয়া, মাল্টিপল মায়েলোমা, হাইপোথাইরয়েডিজম, ওবেসিটি, পুষ্টির অভাব, শরীরের সিসার বিষক্রিয়া হলেও ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়ে।
• কিছু কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকেও রক্তে বাড়তে পারে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা। উদাহরণ হিসেবে ডাই ইউরেটিক, ওয়ারফেরিন, অ্যাসপিরিনের কথা বলা যায়।
আবার লিউকেমিয়া এবং যক্ষ্মার ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবেও রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়তে পারে।
• অনেকসময় ইউরিকেজ নামে এক ধরনের ডাইজেস্টিভ এনজাইমের অভাবেও অতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিড ক্রিস্টালের আকার ধারণ করে যা শরীরে বিভিন্ন অস্থিসন্ধিতে ধাক্কা দিলে ব্যথা অনুভূত হয়।
এছাড়াও ইমিউনোসাপ্রেসিভ ড্রাগ (শরীরের রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতাকে খানিকটা কমিয়ে দেয়), কেমো এবং রেডিয়েশনের যে সমস্ত রোগী আছে, তাঁদেরও শরীরে ইউরিক অ্যাসিড লেভেল বেড়ে যেতে পারে।
গাউট ও ইউরিক অ্যাসিডের সম্পর্ক
গাউট হল এক ধরনের আর্থ্রাইটিস। এই রোগের পিছনে মূল কারণ হল শরীরে মাত্রাতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিড সঞ্চিত হওয়া।
ইউরিনের মাধ্যমে শরীরের অতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিড বেরতে না পারলে তা শরীরের বিভিন্ন সন্ধিস্থলে ক্রিস্টাল আকারে জমে সমস্যার সৃষ্টি করে। তবে ইউরিক অ্যাসিড বেশি হলেই যে গাউট হবে তা নয়। দেহের মাত্রাতিরিক্ত ওজন, হজমের সমস্যা, রক্ত সঞ্চালনের সমস্যা, দেহের বর্জ্য পদার্থ শরীর থেকে না বেরতে পারলেও গাউট হতে পারে।
পরিবারে এই রোগ হওয়ার ইতিহাস থাকলে গাউট হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। সাধারণত ৩০ থেকে ৫০ বছর বয়সি পুরুষের মধ্যে গাউটের প্রকোপ বেশি দেখা যায়। মহিলাদের ক্ষেত্রে আবার মেনোপজের পরেই গাউটের প্রকোপ বেশি হতে পারে।
অ্যাডভান্সড গাউট
সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করা হলে ত্বকের নীচে ইউরিক অ্যাসিডের ক্রিস্টাল জমে গুটির আকার ধারণ করে যাকে ‘টোফাই’ বলে। এগুলি হাত, আঙুল, পায়ে গুটি গুটি আকারে জমা হতে পারে।
সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায়
প্রথমত ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। কারণ ইউরিক অ্যাসিড যখন ক্রিস্টাল আকারে গাঁটে গাঁটে জমা হয় তখন রোগী অত্যন্ত কষ্ট পান। তার মধ্যে ওজন বেশি থাকলে রোগী আরও কষ্ট পান। তাই ডায়েটের মাধ্যমে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত জরুরি। আর ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার সঙ্গে ইউরিক অ্যাসিডও যাতে আর না বাড়ে তার দিকেও রাখতে হবে খেয়াল।
কী খাবেন? কী খাবেন না?
• ওজন বৃদ্ধিতে বাধা দিতে হলে জটিল শর্করাজাতীয় খাদ্য যেমন দালিয়া, ওটস, সব্জি ইত্যাদি খাদ্য খেতে হবে। এই ধরনের খাদ্যে ফাইবারজাতীয় উপাদান অনেক বেশি থাকায় রক্তে চট করে শর্করার মাত্রা বাড়ে না। শরীরে কার্বোহাইড্রেটের শোষণও কম হয়। এছাড়া যে কোনও সরল কার্বোহাইড্রেটজাতীয় খাদ্য যেমন চিনি, গুড় রক্তে দ্রুত শর্করার মাত্রা বাড়ায়। ফলে এই ধরনের খাদ্য দ্রুত ওজন বাড়িয়ে তোলে। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ভাজাভুজি, ফ্যাট জাতীয় খাদ্য এড়িয়ে চলা অত্যন্ত জরুরি বিষয়। বিশেষ করে স্যাচুরেটেড ফ্যাট, ট্রান্স ফ্যাট দ্রুত ওজন বাড়ায় যা মেলে ঘি, মাখন, প্রিজারভেটিভ দেওয়া খাদ্য, রেডি টু কুক জাতীয় খাদ্যে।
আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড যুক্ত রান্নার তেল ব্যবহার করা দরকার যাতে শরীরের জন্য জরুরি ফ্যাটি অ্যাসিডের ঘাটতি না হয়। উদাহরণ হিসেবে সূর্যমুখীফুলের বীজ থেকে তৈরি তেল, অলিভ অয়েলের কথা বলা যায়। তবে তাই বলে অতিরিক্ত তেল খাওয়া যাবে না।
• প্রোটিন ভেঙে ইউরিক অ্যাসিড উৎপন্ন হয়। তাই শরীরের ইউরিক অ্যাসিডের আধিক্য হলে অতিঅবশ্যই প্রোটিনজাতীয় খাদ্য খাওয়া কমাতে হবে। অর্গ্যান মিট, রেট মিট-এর কথা আগেই বলা হয়েছে। এই ধরনের খাবার যেমন খাওয়া যাবে না তেমনই মাশরুম, সি ফুড খাওয়া এড়িয়ে চলা ভালো। ডালে প্রচুর প্রোটিন থাকে তাই রোজকার খাদ্যে ডাল খাওয়ার মাত্রা কমানোর দরকার পড়তে পারে। সয়াবিন, বাদামজাতীয় খাদ্যও এড়িয়ে চলা দরকার।
মাছ, ডিম খাওয়া যায়। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া বাঞ্ছনীয়।
• খেতে হবে ভিটামিন সি জাতীয় খাদ্য। ভিটামিন সি ইউরিক অ্যাসিডের ক্রিস্টালগুলিকে ভাঙতে সাহায্য করে। তাই ভিটামিন সি যুক্ত ফল যেমন লেবু, পেয়ারার মতো ফল খান প্রতিদিন।
• রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়লে পর্যাপ্ত মাত্রায় জল খাওয়া দরকার। কারণ শরীরে যে ইউরিক অ্যাসিড বা টক্সিন জমা হয় না। মূত্রের মাধ্যমে শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। তাই পর্যাপ্ত মাত্রায় জল পান না করলে শরীর থেকে ইউরিক অ্যাসিড বেরতে পারবে না।
সব্জিও কি বাদ?
ইউরিক অ্যাসিড বাড়লে অনেকে ঢেঁড়শ, টম্যাটোর মতো সব্জিও খাদ্যতালিকা থেকে সম্পূর্ণ বাদ দেন। তবে একাধিক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে ঢেঁড়শ, টম্যাটো, পুঁইশাকে উচ্চ মাত্রার পিউরিন নেই। তাই ডায়েটে অল্পবিস্তর এই ধরনের খাদ্য রাখা যেতে পারে। তবে এই ধরনের খাদ্য আবার অক্সালিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় যা শরীরে প্রদাহ তৈরি করে। তাই কতটা টম্যাটো, ঢেঁড়শ খাওয়া যেতে পারে তা একজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করেই খাওয়া দরকার।
অনুলিখন: সুপ্রিয় নায়েক