পাঁচের দশকের একদম শুরুর দিকের কথা। সিংহি পার্কের বিজয়া সম্মিলনি। নাটক, আধুনিক গান আর শাস্ত্রীয় সঙ্গীত মিলিয়ে তিনদিনের জমজমাট অনুষ্ঠান। দেখা গেল, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি পাড়ার মানুষদের আগ্রহ সবথেকে বেশি। সই দেখে পাড়ার যুবকরা ঠিক করলেন, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বার্ষিক অনুষ্ঠান করতে হবে। যেমন ভাবনা তেমনি কাজ। ১৯৫২ সাল। গুটি গুটি পায়ে পথচলা শুরু করল ‘দ্য ডোভারলেন মিউজিক কনফারেন্স’। শীতের রাতে ডোভারলেনের রাস্তা মুখরিত হয়ে উঠল পণ্ডিত রবিশঙ্করের সেতার আর উস্তাদ আলি আকবর খানের সরোদে। দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে ৭২ বছর। দীর্ঘদিনের এই যাত্রায় এসেছে নানান বাধা-বিপত্তি। তবে থেমে থাকেনি সুর-তালের মেহফিল। চাররাত্রী ব্যাপী এই বার্ষিক সঙ্গীত সম্মেলন আজও চলছে স্বমহিমায়।
শীতের কলকাতার অন্যতম আকর্ষণ সঙ্গীতের এই মহোৎসব। রাত শুরু হচ্ছে রাগেশ্রী দিয়ে। আর ভোরের আলো ফুটতেই কানে ভেসে আসে ভৈরবীর করুণ সুর। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও নৃত্য জগতের হেন শিল্পী নেই যাঁরা এখানে অনুষ্ঠান করেননি। তালিকা দীর্ঘ। পণ্ডিত রবিশঙ্কর, উস্তাদ বিলায়েত খান, উস্তাদ আমির খান, পণ্ডিত ভীমসেন যোশি, পণ্ডিত বিরজু মহারাজ, পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, উস্তাদ জাকির হুসেন। সাত দশক ধরে ডোভারলনের মঞ্চকে সমৃদ্ধ করেছেন এই মহিরুহ শিল্পীরা।
৩ ডোভারলেন। গড়িয়াহাট অঞ্চলের এই ঠিকানায় প্রথম অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। ঠিক যেন পাড়ার বার্ষিক সম্মেলন। নবীন-প্রবীণের যুগলবন্দি। সারা বছর ধরে চলত ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের লড়াই। ইলিশ-চিংড়ি নিয়ে টানাটানি। নানান বিষয় নিয়ে কথা-কাটাকাটি। তবে বছরের এই সময়টা এলেই গোটা পাড়া মেতে উঠত উৎসবের আনন্দে। মিটে যেত যাবতীয় বিভেদ, ঝগড়া। তখন পাড়ার তিরিশটি পরিবার যেন এক বৃহত্তর যৌথ পরিবার। একে অপরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হৈ হৈ করে উতরে যেত বার্ষিক সঙ্গীত সম্মেলনের আসর। আজ যুগ পাল্টেছে। মানুষের হাতে সময় কম। বহু পুরনো সঙ্গীত সম্মেলন আজ আতীত।তবে ডোভারলেনের প্রদীপ নেভেনি।প্রথমে হাল ধরেছিলেন অজিত ঘোষ, লক্ষ্মী শীল, প্রমুখ। তারপর দায়িত্ব নেন রতু সেন। দেখতে দেখতে ব্যাটন এসে পৌঁছেছে তৃতীয় প্রজন্মের হাতে। উৎসাহে অবশ্য একটুও ভাটা পড়েনি। সাধারণ সম্পাদক মনোতোষ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘উনাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের জেরেই আজ ডোভারলেন এতো পরিচিতি পেয়েছে। সেই পথ অনুসরণ করে আজও এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। রতু সেন, অজিত ঘোষের মতো মানুষ না থাকলে ডোভারলেনের যাত্রার এতোটা সুদীর্ঘ হতে পারত না।’
সিংহি পার্ক, হিন্দুস্তান পার্ক, বিবেকানন্দ পার্ক হয়ে আজকের নজরুল মঞ্চ। সাত দশকের এই দীর্ঘ যাত্রায় বারবার ঠিকানা বদলেছে ডোভারলেন। শুরুর দিকে অনুষ্ঠান হতো খোলা প্যান্ডেলে। পাড়ার কোনও বাসিন্দার ঘরের দরজা খুলে দেওয়া হতো শিল্পীদের জন্য। সেটাই হয়ে যেত গ্রিনরুম। সেতার, সরোদ, হারমোনিয়াম, তবলা নিয়ে চলত শেষ মুহূর্তের মহড়া। সেটাই হয়ে উঠত ছোটখাটো এক বৈঠকী। তারপর মূল অনুষ্ঠান। পাড়ার বাসিন্দাদের জন্য কোনও টিকিট লাগত না। যত আগে আসা যাবে প্রিয় শিল্পীকে তত কাছ থেকে দেখার সুযোগ মিলবে। তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে প্যান্ডেলে চলে আসতেন বাসিন্দারা।
আজ নজরুল মঞ্চ চারিদিক দিয়ে বন্ধ। তবে নব্বইয়ের দশকে তেমনটা ছিল না। ফলে শীতের সময় তাপমাত্রার জন্য শিল্পীদের যন্ত্র মাঝেমধ্যে বেসুরো হয়ে যেত। সিংহি পার্ক, ডোভারলেন, বিবেকানন্দ পার্কেও এই চিত্র চোখে পড়ত। এই প্রসঙ্গে প্রয়াত সেতার শিল্পী উস্তাদ বিলায়েত খানের একটি ঘটনার কথা না বললেই নয়। ভোররাতের অনুষ্ঠান। বাজনার মাঝখানে বেসুরো সেতারের সুর মেলাতে লাগলেন শিল্পীরা। শ্রোতারা ভাবলেন, উস্তাদজির বাজনা শেষ হয়ে গিয়েছে। একে একে বেরিয়ে যেতে লাগলেন। এই দৃশ্য দেখামাত্রঅত্যন্ত বিরক্ত হলেন সেতার শিল্পী। সেতার মঞ্চে রেখে স্পষ্ট বলে উঠলেন, ‘যাঁরা যেতে ইচ্ছুক তাঁরা চলে যেতে পারেন। আর যাঁরা আমার অনুষ্ঠান শুনতে চান তাঁরা আসন গ্রহণ করুন। সবকিছু শান্ত হওয়ার পর আমি আবার অনুষ্ঠান শুরু করব।’ সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড়িয়ে আসন গ্রহণ করলেন বিভ্রান্ত শ্রোতারা। আজকের দিনে অবশ্য এমন ভুল হওয়ার সুযোগ নেই।
৭২ বছরের এই যাত্রায় এসেছে হাজার বাধা-বিপত্তি। মাঝে ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বন্ধ ছিল মিউজিক কনফারেন্স। ১৯৭৮ সাল থেকে আবার নতুন করে পথ চলা শুরু। তারপর আর থামতে হয়নি। কোভিড পর্বে নির্ধারিত সময়ের পরে অনুষ্ঠান করতে হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু চাকা থেমে থাকেনি। এই প্রসঙ্গেআশির দশকের একটা ঘটনা বলা যাক। ১৯৮৮ সাল। প্রথম রাতে অনুষ্ঠান করবেন ভীমশেন যোশি। সকলেই খুব উৎসাহী। নির্ধারিত অনুষ্ঠানের কয়েক ঘণ্টা আগে ফোনে শিল্পী জানালেন, অসুস্থতার কারণে তিনি আসতে পারছেন না। শেষদিনে আসবেন। এদিকে উদ্যোক্তাদের তো মাথায় হাত। এতো কম সময় বিকল্প শিল্পীর হদিশ মিলবে কীভাবে। সেবছর শেষদিনের শিল্পীদের তালিকায় ছিলেন পণ্ডিত মানস চক্রবর্তী। শিল্পীর বাড়িতে ছুটলেন উদ্যোক্তারা। মানসবাবুকে প্রায় ঘুম থেকে তুলে এনে মঞ্চে বসিয়ে দেওয়া হল। বাকিটা ইতিহাস। ডোভারলেন মিউজিক কনফারেন্সের বর্তমান চেয়ারম্যান ব্রতীন্দ্র মুসতাফির কথায়, ‘কণ্ঠের জাদু দিয়ে সকলের মন জয় করে নিয়েছিলেন মানসদা। সেই অভিজ্ঞতা আজও ভোলার নয়।’ আরও একবার শেষ মুহূর্তে অনুষ্ঠান বাতিল করেছিলেন এক প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। তখনকার দিনে তো আর মোবাইল ফোন ছিল না। যোগাযোগের মাধ্যম বলতে শুধুই ল্যান্ডলাইন। আমেদাবাদে অনুষ্ঠান শেষ করে মুম্বই ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। হোটেলেই ফোন করলেন কর্মকর্তারা। শিল্পীকে সন্ধ্যায় কলকাতায় অনুষ্ঠান করে মুম্বই ফিরে যাওয়ার আবেদন জানানো হল। হাসিমুখে রাজি হয়ে গেলেন হরিজি। এলেন। বাঁশির সুরে মুগ্ধ করলেন দর্শকদের। তারপর ফিরে গেলেন বাণিজ্য নগরি।
ডোভারলেন নিয়ে এমন একাধিক ঘটনা রয়েছে। একবার কণ্ঠসঙ্গীত পরিবেশন করছেন পণ্ডিত ভীমশেন যোশি। গাইতে গাইতে উল্টোদিকে ঘুরে গেলেন শিল্পী। বুঝতেও পারলেন না যে শ্রোতারা তাঁর পিছনে রয়েছেন। চোখ খুলতেইদেখলেন, মঞ্চের পিছনের পর্দা। বলে উঠলেন. পর্দা সরিয়ে না দিলে আমার শ্রোতাদের দেখব কীভাবে! এই মঞ্চেই শেষবার সেতারে ঝড় তুলেছিলেন পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়। সেদিনের দরবারি কানাড়ার আলাপ হয়তো আজও শ্রোতাদের কানে বাজছে।
বহুবার অনুষ্ঠানের মাঝে নিজের বাজনা থামিয়ে সহ শিল্পীর তারিফ করেছেন আরেক শিল্পী। একবার পণ্ডিত রবিশঙ্কর সেতার বাজাচ্ছিলেন। তবলায় সঙ্গত করছিলেন উস্তাদ জাকির হুসেন। হঠাৎ সেতার থামালেন পণ্ডিতজি। উল্টোদিকের তরুণ যুবকটি তখন তবলায় ঝড় তুলেছে। সেতার রেখে কিছুক্ষণের জন্য জাকিরের একক তবলা বাদন উপভোগ করলেন রবিশঙ্কর। তবলার বোল থামতেই হাততালিতে ফেটে পড়ল গোটা প্রেক্ষাগৃহ।
নিজের অনুষ্ঠান না থাকলেও অন্য শিল্পীদের শুনতে ডোভারলেনে এসেছেন বহু উস্তাদ ও পণ্ডিত। একবার বিমানবন্দর থেকে নেমে হোটেলে যাচ্ছেন পণ্ডিত যশরাজ। যেতে যেতে শুনতে পেলেন পণ্ডিত ছন্নুলাল মিশ্রের গান। গাড়ি থেকে নেমে সোজা চলে গেলেন গান শুনতে। সারারাত ধরে অনুষ্ঠান। এটাই যেন ডোভারলেনের ইউএসপি। এই আমেজ হয়তো খুব কম জায়গায় মেলে। তাই তো টিকিট না পাওয়া রাস্তায় বসে শিল্পীদের অনুষ্ঠান শুনেছেন শ্রোতারা। একবার তো বিবেকানন্দ পার্কের গেট পর্যন্ত খুলে দিতে হয়েছিল। কোষাধ্যক্ষ শান্তনু চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘সে এক মজার ঘটনা। সেদিন শেষদিকের শিল্পী ছিলেন পণ্ডিত ভীমশন যোশী, উস্তাদ বিলায়েত খান ও উস্তাদ জাকির হুসেন। একাট সময় পর দেখা গেল। গেটের বাইরে ভিড় জমিয়েছেন অসংখ্য শ্রোতা। বাধ্য হয়েই গেট খুলে দেওয়া হল। অনেকেই মাটিতে কাগজ পেতে বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করেছলেন।’
সদ্য প্রয়াত হয়েছেন উস্তাদ জাকির হুসেন। অতীতের বহু প্রতিষ্ঠিত শিল্পী পাড়ি দিয়ছেন সুরলোকে। বার্ষিক সম্মেলনের পাশাপাশি নবীন প্রজন্মের উদীয়মান শিল্পীদের খোঁজার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ডোভারলেন। মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতা আর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এই কর্মকাণ্ডের অন্যতম অংশ। মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতার সেরা শিল্পীরা পরবর্তীতে ডোভারলেনের মুল মঞ্চে অনুষ্ঠানের সুযোগ পান। বার্ষিক শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সম্মেলনেও চোখে পড়ে নবীন-প্রবীণের সহাবস্থান। এভাবেইভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে ডোভারলেন মিউজিক কনফারেন্স।