খাওয়াদাওয়া নিয়ে সুগার রোগীদের নানা সমস্যা। আলু কি খাব? চিনি খেলে কতটা? রসগোল্লা পুরো বাদ? এমন নানা দরকারি প্রশ্নের উত্তর দিলেন এসএসকেএম হাসপাতালের এন্ডোক্রিনোলজি বিভাগের প্রধান ডাঃ প্রদীপ মুখোপাধ্যায়। লিখছেন মনীষা মুখোপাধ্যায়।
• সুগার রোগীর জন্য ভাত ভালো না রুটি?
•• ডায়াবেটিস হলেই অনেকে ভাবেন, ভাত খাওয়া বোধহয় একেবারে ছেড়ে দিতে হবে। অথচ ভাত ও রুটিতে ক্যালোরির দিক থেকে বড় কোনও ফারাক নেই। দু’টিই শর্করা গোত্রের খাবার। তবু কেউ কেউ ভাত বাদ দিতে বলেন কারণ ভাতের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স রুটির চেয়ে একটু বেশি। তাই ভাত খেলে রক্তে গ্লুকোজ তাড়াতাড়ি মেশে। তবে পরিমাণ বুঝে ভাত খেলে কোনও ক্ষতি হয় না। ভাত বা রুটি, যা-ই খান না কেন, অল্প পরিমাণে খান। বরং তার বদলে শাকসব্জি, ডিম, মাছ-মাংস খান বেশি করে। খাবার পাতে ডাল, সব্জির পরিমাণ বাড়ান। এমনিতে ভাত একান্ত না ছাড়তে পেরে অনেকেই ভাত- রুটি মিশিয়ে খান। তাতেও অসুবিধা নেই। তবে মিশিয়ে খেলে খাবারে ক্যালোরির পরিমাণ অত বুঝে খাওয়া যায় না।। ফলে ক্যালোরি বেড়ে যায়। তাই মিশিয়ে খেতে বারণ করা হয়। তবে পরিমাণ বুঝে খেলে সমস্যা নেই।
• সুগার মানেই মিষ্টি বাদ?
•• মিষ্টি খেলেই সুগার হয় না। আপনি যা-ই খান, শর্করা, প্রোটিন ও ফ্যাটের বাইরে তো কিছু খেতে পারবেন না। আমাদের প্রাথমিক শক্তি মবলত জোগান দেয় শর্করা জাতীয় খাদ্য। সুগার হলে যে মিষ্টিতে রাশ টানতে বলা হয়, তার কারণ তবে মিষ্টি রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে। ওজনও বাড়াতে সাহায্য করে। তাই সুগার হলে মিষ্টির ক্ষেত্রে আঁটসাঁট নিয়ম বেঁধে দেওয়া হয়। এমনকী, যাঁরা প্রি-ডায়াবেটিক, তাঁদেরও মিষ্টি জাতীয় খাবার কম খেতে বলা হয়।
তবে এখানে একটা মজা আছে। অনেকে আছেন, সুগার হয়েছে বলে মিষ্টি থেকে শত হস্ত দূরে থাকেন, একটাও রসগোল্লা-সন্দেশ খাচ্ছেন না। কিন্তু তিনি রোজ চিনি দিয়ে বানানো তরকারি খান, নানা মিষ্টি বিস্কুট, আইসক্রিম, কেক, কোক, কৃত্রিম চিনি মেশানো শরবত বা ফ্রুট জ্যুস খান— এগুলোও কিন্তু চিনির মতোই ক্ষতি করে। ভারতীয় নানা খাবারে মিষ্টির ভাগ এমনিই বেশি। তাই তাই ডায়াবেটিস ধরা পড়লে মিষ্টির পরিমাণ কমাতে বলা হয়। তবে কোনও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী যদি নিয়ম মেনে প্রতিদিন খাওয়াদাওয়া করেন, তাহলে সপ্তাহে এক দিন একটা রসগোল্লা, অল্প চিনি দিয়ে চা-ও খেতে পারেন। গরমে মাঝেসাঝে এক চাকলা আমও তখন ক্ষতি করবে না। তবে এই ‘মাঝেসাঝে’-কে নিজেরা ‘রোজ’-এর অভ্যাসে পরিণত করে ফেললে মুশকিল। আবার খুব নিয়ম মানি বলে একই দিনে রসগোল্লা, চিনি দিয়ে চা, এক চাকলা আম সব খেয়ে ফেললাম— এমন হলেও বিপদ বাড়বে। তাই মিষ্টি যতটা পারবেন, এড়িয়েই চলুন।
• মিষ্টির মতোই ক্ষতিকর আর কী?
•• ‘মিষ্টির মতো’ নয়, মিষ্টির চেয়েও ক্ষতিকর তেল। ১ গ্রাম গ্লুকোজে ৪ ক্যালোরি থাকলে ১ গ্রাম তেলে আছে ৯ ক্যালোরি। তেলকে বলে হল হিডেন ক্যালোরি। অর্থাৎ ডিপ ফ্রাই হয়তো এড়িয়ে চলছেন, কিন্তু রোজই চানাচুর বা ঝুরিভাজা দিয়ে মুড়ি খাচ্ছেন, বাড়িতে চিপস এলে খাচ্ছেন এগুলো তেকেও শরীরে তেল ঢোকে। তেলেভাজা জিনিস খেলে সুগার হওয়ার ঝুঁকি মিষ্টির চেয়েও অনেক গুণ বেড়ে যায়।
• সারা মাসে কতটুকু তেল তাহলে?
একজন সুস্থ পূর্ণবয়স্ক মানুষের জনপ্রতি সারা মাসে তেলের পরিমাণ ৬০০-৭০০ মিলিলিটার বরাদ্দ করুন। এর মধ্যে ঘরের খাবার, নেমন্তন্ন বাড়ি, রেস্তরাঁর খাবার সব ধরা আছে। বাড়িতে ৭০০ মিলিলিটার পেরচ্ছে না কিন্তু প্রতি সপ্তাহে বাইরে প্রচুর তেল ঝাল খেয়ে এলেন, এতে শরীরে কিন্তু বরাদ্দের বেশি তেল ঢুকল। তাই বাইরে যেদিন খাবেন, তার পরের জু’জিন বাড়িতে হালকা খান। অল্প তেলে মাছ ভাজুন। সম্ভব হলে ব্লটিং পেপারে ভাজা মাছ মুড়ে রাখুন, যতটা সম্ভব তেল বের করা যায় আরকি! আর কোনও কোনও দিন যদি মেনুতে পকোড়া, লুচি এসব থাকে, তাহলেও পরের কয়েকদিন হালকা খান। যেসব খাবার তেলে চুবিয়ে ভাজার বিষয় আছে, সেসব এড়িয়ে চলাই ভালো। একান্ত খেতে হলে পরের দু’দিন হাল্কা খেয়ে তেলের পরিমাণগত ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।
• আচ্ছা, আলু একদম বাদ?
• একেবারেই আলু বাদ নয়। আবার এটুকু পড়েই অনেক আলু খেয়ে ফেললাম, তাও চলবে না। অনেকে আবার ভাবেন, আলু সেদ্ধ করে জল ফেলে দিয়ে খেলেই আমি নিরাপদ! এমন কোনও কথা নেই। শর্করা অর্থাৎ আলুর স্টার্চ তাতে চলে যায় না। তাই ওষুধ খেলে ও নিয়ম মানলে মাঝেসাঝে আলু খান। তবে অবশ্যই অল্পস্বল্প খান।
• চিনি না গুড়, কোনটা ভালো?
•• গুড় একটু মন্দের ভালো আরকি। আসলে দুটোই মিষ্টি। তবে গুড়ের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স চিনির চেয়ে কম। তাই গুড় খান অনেকে। তবে চিনি বাদ দিয়ে অনেকটা গুড় খেয়ে ফেললে চিনির মতোই ক্ষতি হবে। তাই গুড় খান, তবে অল্প খান। অনেকে আবার সুইটনার, সুগার ফ্রি এসবও খান। এগুলো আবার কৃত্রিম চিনি। এসব দিনের পর দিন খেয়ে গেলে ক্ষতি বেশি। তার চেয়ে অল্প গুড় ব্যবহার করুন। তবে শুধু সুগারের জন্যই চিনি খেতে বারণ করা হয় না। আধুনিক কিছু গবেষণায় দাবি, চিনি থেকে ক্যান্সারেরও ঝুঁকি থাকে। তবে তা নিয়ে নিশ্চিত কোনও ধারণায় বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকমহল এখনও পৌঁছননি। তাই সুগার রোগী বাড়িতে থাকলে যে কোনও ধরনের মিষ্টিই কম ব্যবহার করুন।