বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ

শেষ হাসি হাসবে সংবিধানই
হিমাংশু সিংহ

বীর নেতাজি সুভাষ দেশে ফেরেননি কার চক্রান্তে এবং কোন অভিমানে, তা সবারই জানা। নেতাজি দেশের জন্য জীবন সঁপে দিয়েছিলেন, গদিতে বসে ক্ষমতা ভোগের জন্য লালায়িত হননি। ব্রিটিশ শাসকের হাত থেকে দেশ বাঁচাতে রাতের অন্ধকারে বাড়ি ছেড়েছিলেন। প্রাসাদোপম অট্টালিকা বানানোর জন্য দেশপ্রেমের নাটক করেননি। কোনও শিল্পপতিকে হাজার কোটির সুবিধা পাইয়ে দিয়ে নিজের ব্যাঙ্ক ব্যালান্স বাড়ানোর চতুর লক্ষ্যের পিছনেও ছোটেননি তিনি। ১৯৪৭ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল ৩৬ কোটি, আর আজ তা ১৪২ কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে। স্বাধীনতার পর ৭৭ বছর কেটে গিয়েছে। কোন পথে লোকতন্ত্র চালিত হবে তার দিশা দেখানো আম্বেদকরের সংবিধান পা দিয়েছে ৭৫ বছরে। অনেক সরকার এসেছে, চলেও গিয়েছে কালের নিয়মে। অনেক ভাষণ, হাততালির আড়ালে নির্মম ভণ্ডামির সাক্ষী থেকেছে দেশের জনগণ। অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ বুঝেছে গরিবি হটাও স্লোগান দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে নয়, স্রেফ রাজনীতির জন্য।  দুর্ভাগ্য আমাদের আর একটা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, আর একটা চিত্তরঞ্জন দাশ, আর একটা বাঘাযতীনের সন্ধান আমরা পাইনি। ভোটসর্বস্ব এদেশে আজ কথা না রাখার ছলনাই নেতানেত্রীদের একমাত্র ধ্রুবপদ।    
আজকের দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পূর্বসূরি বিজেপির সর্বমান্য নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ি সংসদে একাধিকবার তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন, দল ক্ষমতায় আসবে যাবে, সরকার তৈরি হবে, বিদায় নেবে, কিন্তু দেশ, দেশের লোকতান্ত্রিক কাঠামো যেন অক্ষুণ্ণ থাকে। না-হলে বিপদ অনিবার্য। গঠনমূলক বিরোধিতা, যুক্তিনির্ভর বিতর্ক আর সমালোচনা সংসদীয় রাজনীতির প্রাণ। সরকার পক্ষ যতই শক্তিশালী হোক, ভারতের সংসদ কিন্তু বিরোধীদের। তাকে কোনওভাবে লঘু করে দেখানোর চেষ্টা হলে, বিরোধীদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হলে গণতন্ত্র বিপন্ন হতে বাধ্য। আর গণতন্ত্র বিপন্ন হওয়ার অর্থ, সংবিধানও খাদের কিনারায়। 
মাত্র গত ডিসেম্বরের কথা। হাজার কোটি ব্যয়ে নির্মিত পাঁচতারা নতুন সংসদ ভবনে চলছে সংবিধান নিয়ে বিতর্ক। একের পর এক সংসদ সদস্য বক্তব্য রাখছেন। উত্তাপ বাড়ছে, কখনও তা শালীনতার সীমাও অতিক্রম করছে। কারণ কেউ দেশের ভালোর কথা বলছেন না। আত্মত্যাগের প্রস্তাব, দেশমাতৃকার জন্য জীবন উৎসর্গ করার আহ্বান কিংবা নিদেনপক্ষে নিজেদের ভুল স্বীকারেও রাজি নন কেউ। শুধু উতোরচাপান আর পরস্পরকে ঘৃণ্য দোষারোপ। এককথায় বাজারি খেউড়! সঙ্গে আত্মপ্রচারের হরেক ফিরিস্তি। ভাবটা এমন, আমি থাকলে এমন পরিস্থিতি তৈরিই হতো না, স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়ে যেত। লোকসভা ও রাজ্যসভা দুই কক্ষেই একই অবস্থা। বিরোধীরা বলছেন, মোদি সরকার ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রধান ভিত্তি ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো’কে পদে পদে অসম্মান করেছে। এবং সংবিধানের মূল যে ভিত্তি ‘ইন্ডিয়া ইজ এ ইউনিয়ন অব স্টেট’ তাকে খারিজ করতেই এক দেশ এক নির্বাচনের জুজু দেখানো চলছে। ধর্মনিরপেক্ষতা বিপন্ন। সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ নেমে আসছে। ভোটে উন্নয়ন নয়, মেরুকরণই প্রধান ইস্যু, যা উস্কে দিয়েছে সুতীব্র সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে। ফিকে হয়ে গিয়েছে কবির ‘একই বৃন্তে দু’টি কুসুম, হিন্দু-মুসলমান’-এর গৌরবোজ্জ্বল সহাবস্থান। গরিব আরও গরিবই হয়নি, দেশের সিংহভাগ সম্পদ কুক্ষিগত করেছে কতিপয় ধনকুবের। সরকারি বদান্যতায়। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বন্দর থেকে বিমানবন্দর হস্তগত করেছে ঘনিষ্ঠরা। আর অপরাধী বুঝে গিয়েছে, ভোটের দিন বুথ কব্জা করতে যখন আমারই ডাক পড়ে, তখন আমরাই-বা কেন সরাসরি নির্বাচনে জিতে ‘রাজা’ হব না। গণতন্ত্রে ধনী- গরিব, সৎ-অসৎ-এর ভোটের মূল্য এক। মধ্যবিত্ত উচ্চ হারের করের বোঝায় বেসামাল। শিক্ষা নেই, চাকরি নেই, জিনিসের দাম বাড়ছে লাফিয়ে। কর্পোরেটমুখী এই সরকারের লক্ষ্য সংবিধান বদলে রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বাধীন নয়া ব্যবস্থার প্রবর্তন। সংবিধানকে নানাভাবে রক্তাক্ত করার চক্রান্ত চলছে বলেই সরব বিরোধী শক্তি। তাদের অভিযোগ, ২০২৯ কিংবা ২০৩৪ সালে যদি লোকসভার সঙ্গে একসঙ্গে সবক’টি রাজ্য বিধানসভার ভোট হয় তাহলেই দেশের রাজনৈতিক মানচিত্র অনেকটা বদলে যাবে।
বসে নেই মোদি-অমিত শাহের গেরুয়া শিবিরও। এসবই ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’য়ের প্রচার, এমনই তোপ দেগে তারা পাল্টা আক্রমণ শানাতে ছাড়েনি। দেশের সর্বময় ক্ষমতায় থাকার সুবাদে তাঁদের চুপ করে থাকার কথাও নয়। পত্রপাঠ নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর অনুচররা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন কংগ্রেস, থুড়ি, গান্ধী পরিবারের সংবিধান ও গণতন্ত্র বিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে। এদেশে গণতন্ত্রের অবমাননার প্রসঙ্গ উঠলেই জরুরি অবস্থার কালো দিনগুলির কথা স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে। মোদিজির পাল্টা আক্রমণ, নিজের গদি বাঁচাতেই সংবিধানের ঠিক ২৫ বছর পূর্তির বছরে মোক্ষম আঘাতটি নামিয়ে আনেন ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন। জরুরি অবস্থা জারি করে আম্বেদকরের পবিত্র পুঁথিকেই পঙ্গু করে দেন। দেশবাসীর মৌলিক অধিকার খর্ব হয়। বিচারব্যবস্থা কার্যত নীরব দর্শক হয়ে যায়। ইন্দিরা গান্ধীর শাসনে জরুরি অবস্থা জারি ও মৌলিক অধিকার থেকে দেশবাসীকে বঞ্চিত করা ভারতীয় সংবিধানের উপর প্রথম বড় আঘাত। কালা কানুন ‘মিসা’ জারি করে দেশের তাবৎ বিরোধী নেতানেত্রীদের একতরফা গ্রেপ্তার করে রাখা হয়েছিল। দেশ জেলখানায় পরিণত হয়। এমনকী সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের উপরও নেমে আসে আঘাত। স্বাধীনতার পর ইন্দিরা জমানাতেই ভারতীয় সংবিধান প্রথম বড় ধাক্কা খেয়েছিল। তবে শুরুটা নেহরু আমলে। স্বাধীনতার পর প্রথম পাঁচ বছর সাধারণ নির্বাচন হয়নি। তখন থেকেই দেশ একটি বিশেষ পরিবারের নিয়ন্ত্রণে। সেই থেকে ইন্দিরার জরুরি অবস্থা পেরিয়ে শাহ বানু মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়কে উল্টে দিতে রাজীব গান্ধীর নয়া আইন প্রণয়ন, সব কিছুতেই আম্বেদকরের সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ারই মরিয়া চেষ্টা।
আগেই বলেছি, সংবিধান লিখতে আম্বেদকর ও তাঁর সহযোগীরা সময় নিয়েছিলেন দু’বছরেরও বেশি। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে শুরু করে ১৯৪৯’এর শেষার্ধ পর্যন্ত সংবিধান লেখার কাজ চলে। সংবিধান লেখা শেষ ও গৃহীত হয় ১৯৪৯’এর ২৬ নভেম্বর। আর তা কার্যকর করা শুরু হয় ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি। সেই থেকে ২৬ জানুয়ারি দিনটি ‘সাধারণতন্ত্র দিবস’ হিসেবে পরিচিত। মোদি সরকার এসেই ২০১৫ থেকে ২৬ নভেম্বর দিনটি পালন করছে ‘সংবিধান দিবস’ নামে। তার পরও প্রায় এক দশক কাটতে চলেছে। কিন্তু, সংবিধানের মূল আত্মা ভালো আছে কি? আজ এই প্রশ্নের মুখে গোটা দেশ এবং দেশের মানুষ। সংবিধান নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কিছু কম হয়নি। কংগ্রেস সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার সুবাদে একাই ৭৫ বারের বেশি সংশোধন করেছে। পিছিয়ে নেই মোদিজিও। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেই নরেন্দ্র মোদি কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি ঘটান। রদ করেন মধ্যযুগীয় তিন তালাক প্রথা। ৩৭০ এবং ৩৫এ ধারার সৌজন্যে স্বাধীনতার সময় থেকেই জম্মু ও কাশ্মীর বিশেষ মর্যাদা পেয়ে আসছিল। সেই বিশেষ মর্যাদা শুধু কেড়েই নেওয়া হয়নি, পূর্ণ রাজ্যটিকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভেঙে দেওয়া হয়। আর তা করতে গিয়ে মাসের পর মাস উপত্যকায় সংবিধানের দেওয়া মৌলিক অধিকারগুলিকেই কেন্দ্র হরণ করে রাখে। বন্ধ থাকে ইন্টারনেট পরিষেবাও। যার দরুণ সুপ্রিম কোর্টকে পর্যন্ত বলতে হয়, ইন্টারনেট পরিষেবা মানুষের মৌলিক অধিকার। সেইসঙ্গে আটক করে রাখা হয় শতাধিক কাশ্মীরি নেতানেত্রীকে। কোনও শুনানি ছাড়াই তাঁরা কার্যত দীর্ঘসময় গৃহবন্দি ছিলেন। সেই তালিকায় ছিলেন ওই রাজ্যের তিন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীও। সামগ্রিকভাবেই একের পর এক ঘটনা পরম্পরা গণতন্ত্র রক্ষার মানদণ্ডে ভারতের অবস্থানকে নীচের দিকে ঠেলে দিয়েছে। যেখানে শীর্ষ নেতানেত্রীরাই নিরাপদ নন, তাঁদের স্বাধীন চলাফেরাটুকুও নিয়ন্ত্রিত, সেখানে কীসের গণতন্ত্রের বড়াই! সংবিধানের লম্বাচওড়া লেখাজোখারই-বা দাম দেবে কে? এই প্রশ্ন কি অবান্তর? 
পদার্থবিদ্যা একটু আধটু যা পড়েছি, তাতে দেখেছি স্থিতিস্থাপকতার (ইলাস্টিসিটি) একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে। চাপ, তাপমাত্রা এবং বাইরের বলপ্রয়োগে (টেম্পারেচর, প্রেশার অ্যান্ড এক্সটারনাল ফোর্স) যে কোনও জিনিসের আকার ও চরিত্রের সাময়িক পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু তা সরে গেলেই আবার পুরনো অবস্থায় ফিরে যায়। এটাই পদার্থের ধর্ম। আমাদের সংবিধানও তাই—যত ক্ষমতাবান ধুরন্ধর শাসকই আসুন না কেন সাময়িক পরিবর্তনের চেষ্টা হলেও অন্তরাত্মাকে তা স্পর্শ করে না। বাইরের পরিস্থিতি বদলালেই আবার যে কে সেই! এটাই বি আর আম্বেদকরের সংবিধানের মাহাত্ম্য। এইখানেই আম্বেদকর সাহেব দেশের প্রধানমন্ত্রী না-হয়েও ইন্দিরা গান্ধী থেকে নরেন্দ্র মোদি, নেহরু থেকে অটলবিহারী বাজপেয়ির চেয়েও শক্তিমান। 
বিজেপি সরকারের পরবর্তী লক্ষ্য ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ ও ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’ চালু করা। তাহলেই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র থেকে ধীরে ধীরে ভারতকে আগমার্কা হিন্দুরাষ্ট্রের দিকে নিয়ে যাওয়ার ষোলোকলা পূর্ণ হবে। তবে, একটা জিনিস পরিষ্কার যে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিসর্জন দিয়ে যেইমাত্র আমরা কট্টর হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের দিকে ছুটব, তখনই উদারবাদের পথটি হারিয়ে ভারত কানাগলিতে আটকে যাবে। আমাদের গর্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের অহঙ্কার খসে পড়বে। আপাতত ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চরিত্রটিকে অটুট রাখাই সর্বস্তরের মানুষের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। সেইসঙ্গে সাধারণতন্ত্র দিবসে সংবিধান রক্ষারই শপথ গ্রহণ করুক প্রতিটি ভারতবাসী। নেহরু-ইন্দিরা-রাজীব পারেননি। নরেন্দ্র মোদিও পারবেন না। সব আশঙ্কা উড়িয়ে জয়ী হবে সংবিধান। মহান ভারতীয় গণতন্ত্রের জয় এখানেই। 
1d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

আকস্মিক মাথার যন্ত্রণায় বিব্রত হতে পারেন। কাজকর্মে অপেক্ষাকৃত শুভ। সন্তানের উচ্চশিক্ষার জন্য ব্যয় বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৫.৪৮ টাকা৮৭.২২ টাকা
পাউন্ড১০৫.০৯ টাকা১০৮.৮১ টাকা
ইউরো৮৮.৪৭ টাকা৯১.৮৫ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
25th     January,   2025
দিন পঞ্জিকা