বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ

নেতাজিকে আত্মসাৎ করা সহজ নয়!
মৃণালকান্তি দাস

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এবং আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার— উভয়েরই মধ্যেই ‘গভীর সম্পর্ক ছিল’। এমনই দাবি করেছিলেন সঙ্ঘ নেতা অজয় নন্দী। তাঁর দাবি, হেডগেওয়ার এবং নেতাজি, দু’জনেই দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন। একজন আরএসএস তৈরি করেছেন আর অন্যজন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (আইএনএ) গঠন করেছিলেন। যদিও এই প্যারালালিজমের ইতিহাস অন্যকথাই বলে। আসলে স্বাধীনতা সংগ্রামে সঙ্ঘের অবদান নেই বলে যে ঐতিহাসিক প্রচার রয়েছে, তারই কাউন্টার ইমেজ তৈরি করার কৌশলগত লড়াই শুরু করেছে সঙ্ঘ পরিবারের নেতারা। উদ্দেশ্য, একদিকে বাংলার মানুষের কাছে ‘বাঙালির দেশপ্রেম’কে গুরুত্ব দেওয়ার কৌশল। অন্যদিকে, বাঙালিকে বার্তা দেওয়া ‘আমরা তোমাদেরই লোক’।
রাজনৈতিক মহলের মতে, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আরএসএসের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সেই অস্বস্তি কাটাতে গেরুয়া শিবির কখনও বিবেকানন্দ, কখনও নেহরু-গান্ধীর বিপরীতে বল্লভভাই প্যাটেলকে আঁকড়ে ধরেছে। সেই সূত্রেই নেতাজিকে। আর তাই ২০২৩-এ জন্মজয়ন্তীতে শহিদ মিনারের মঞ্চে লাগানো হয়েছিল নেতাজির বিশাল ছবি। কী বলবেন একে, আরএসএসের নেতাজি-পুজো? নাকি সবটাই ভোটের খেলা? নয়তো সেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে সঙ্ঘ প্রধান ভাগবত কেন বলবেন, ‘আমাদের পথ আলাদা হলেও লক্ষ্য ছিল অভিন্ন। সুভাষবাবু শুধু দেশকে স্বাধীন করার জন্য লড়াই করেননি, এক মহান ভারত গড়ে তোলা ছিল তাঁর স্বপ্ন। আরএসএস নেতাজির লক্ষ্যপূরণে তাঁর আদর্শ অনুসরণ করে চলছে।’ গত বছরও কলকাতায় এসে ভাগবতজির কথায় ছিল একই সুর। বলেছিলেন, ‘নেতাজির বৈশিষ্ট্য তাঁর উগ্র দেশভক্তি। তাঁর মন্ত্র ছিল, আমার অহঙ্কার, আমার স্বার্থ, আমার কল্যাণ নয়। দেশের কল্যাণেই আমার কল্যাণ। শিবাজীর মতোই ব্রিটিশ পুলিসের চোখে ধুলো দিয়েছিলেন নেতাজি। ভারত গড়ার ক্ষেত্রে নেতাজির স্বপ্ন এখনও অধরা রয়েছে। তা আমাদেরই পূরণ করতে হবে।’
অথচ, ইতিহাস বলছে, কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার পরেও কংগ্রেসের ভিতরে অতিদক্ষিণপন্থীদের প্রতি ন্যূনতম প্রসন্ন ছিলেন না সুভাষ। হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লিগের যেসব সদস্য কংগ্রেসে ছিলেন, তাঁদের ঘাড় ধরে বের করে দিতে হবে বলে স্পষ্টই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি। আর সেটাই ছিল তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান। নেতাজি হিন্দু মহাসভার তীব্র সমালোচনা করে বলেছিলেন, তারা ‘ধর্মের সুযোগ নিয়ে ধর্মকে কলুষিত করে।’ এমনকী তিনি হিন্দু মহাসভাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দালালও বলতে ছাড়েননি। সুভাষচন্দ্র বসুর মহাসভা বিরোধী কঠোর মনোভাব দেখে হিন্দু মহাসভার এবং পরে বিজেপির শীর্ষনেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ভয় পেয়ে তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন, সুভাষ ক্ষমতায় এলে তাঁদের নির্বংশ করে ছাড়বেন।
আর বিনায়ক দামোদর সাভারকর? চল্লিশের দশকের গোড়ায় স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত দিনগুলিতে নেতাজি ও তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজের সশস্ত্র পথে স্বাধীনতার উদ্যোগকে পিছন থেকে ছুরি মেরেছিল আরএসএস। নেতাজি যখন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বাহিনী গড়ছেন, তখন সাভারকরের নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভা তথা আরএসএস ব্রিটিশদের পক্ষে তীব্র প্রচার গড়ে তুলেছিল। তাঁরা প্রচার করেছিলেন, যুদ্ধ যখন দোরগোড়ায় এসে হাজির হয়েছে তখন হিন্দুরা সেই সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করুক। ব্রিটিশ বাহিনীর সব উইং-এ ব্যাপকভাবে নাম লেখাতে হবে, আর এক মিনিটও দেরি না করে বিশেষত বেঙ্গল ও অসম প্রদেশ থেকে হিন্দুদের যুক্ত করতে হবে। ব্রিটিশদের প্রতি পরম আনুগত্য রেখে যুদ্ধ করতে হবে।
শুধু ভাষণ বা প্রচার নয়, সদলবলে কাজেও ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সাভারকর। পরবর্তী কয়েক বছর ধরে সাভারকর ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপোষকতায় রীতিমতো রিক্রুটমেন্ট ক্যাম্প সংগঠিত করে ব্রিটিশ বাহিনীতে ‘হিন্দু’-দের নিয়োগ করতে থাকেন, যারা দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ধরে এগিয়ে আসা আজাদ হিন্দ বাহিনীকে আটকাবে। এই রিক্রুটমেন্টের জন্য এমনকী একটি কেন্দ্রীয় বোর্ডও গঠন করে ফেলেন সঙ্ঘের নেতারা। যে বোর্ড ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগে কাজ করেছিল। লক্ষাধিক ‘স্বয়ংসেবক’ রিক্রুট হয়। সাভারকরের এই উদ্যোগ আজাদ হিন্দ বাহিনীকে রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে বিধ্বস্ত করতে ব্রিটিশদের অত্যন্ত সহায়ক হয়।
এছাড়াও ব্রিটিশ বাহিনীতে হিন্দুদের রিক্রুট করার এই উদ্যোগের পিছনে সাভারকরের আরও একটি গূঢ় উদ্দেশ্য ছিল। তা হল, হিন্দুরা সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলে তা পরবর্তীকালে একটি মিলিট্যান্ট হিন্দুরাষ্ট্র গঠনে প্রভূত সাহায্য করবে। বস্তুত সাভারকরের স্লোগানই ছিল ‘সমগ্র রাজনীতির হিন্দুকরণ ও হিন্দুদের সামরিকীকরণ’। সাভারকরের এইসব রিক্রুটরা যুদ্ধশেষে সেনা থেকে বাদ পড়ে জঙ্গি হিন্দু বাহিনী গঠন করে এবং পার্টিশন পর্বে ইউপি-বিহারের বড় বড় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাগুলি সংগঠিত করতে মূল ভূমিকা রাখে।
আরএসএস ও হিন্দু মহাসভার উদ্যোগের ফলে ভারতীয় সেপাইদের আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া সহজ হয়েছিল। কেবল যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, যুদ্ধবন্দিদের ঠান্ডা মাথায় হত্যা করার ক্ষেত্রেও। ড্যানিয়েল মার্সটন তাঁর ‘দ্য ইন্ডিয়ান আর্মি অ্যান্ড এন্ড অব রাজ’ গ্রন্থে লিখেছেন, সেই সময় ব্রিটিশ অফিসাররা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল আইএনএ-র যুদ্ধবন্দিদের নিয়ে। আইনি পথে বিচার করার আগেই ধ্বংস করে দিতে চাইছিল তাঁদের অস্তিত্ব। অফিসাররা সেপাইদের বোঝাতে সক্ষম হয়, আইএনএ আসলে দেশদ্রোহী। বারাকপুর-বারাসাতের নীলগঞ্জ বন্দি শিবিরে ১৯৪৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বরের কুখ্যাত গণহত্যা ছিল তারই রেজাল্ট। গোটা রাত হেভি মেশিনগানের শব্দ শোনা গিয়েছিল। পোড়া শবের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল বহুদূর। পরদিন নোয়াই খালে রক্তবন্যা বয়ে যেতে দেখেছিল স্থানীয় মানুষ। অনেকের মতে, সেদিন অন্তত তিন হাজার যুদ্ধবন্দিকে হত্যা করা হয়েছিল। আরএসএসের হাতে যে আজাদ হিন্দ ফৌজের রক্ত লেগে আছে তা ভুলিয়ে দিতে চাইছেন। কিন্তু সেই ইতিহাস বাঙালিরা ভুলবে কীভাবে?
স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে আরএসএস-এর দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে গোলওয়ালকর বলেছিলেন, ‘ব্রিটিশ বিরোধিতাকে ভাবা হচ্ছে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের সমার্থক। এই প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সমগ্র স্বাধীনতা আন্দোলন, তার নেতৃবর্গ ও সাধারণ মানুষের উপর বিনাশকারী প্রভাব ফেলেছিল’ (চিন্তাচয়ন, ১ম খণ্ড, পৃ ১২৫)। গোলওয়ালকরের মতে, ‘আমাদের দেশের হাজার হাজার বছরের ইতিহাস এই কথাই বলে যে, সব কিছু করেছে একমাত্র হিন্দুরা। এর অর্থ কেবল হিন্দুরাই এই মাটির সন্তান হিসেবে এখানে বসবাস করেছে’ (চিন্তাচয়ন, ২য় খণ্ড, পৃ ১২৩-২৪)। এই বক্তব্য ভারতীয় জাতি গঠনের ইতিহাসের সম্পূর্ণ বিরোধী। এমনকী বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথও এই বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন। আরএসএস বাহিনীর মতবাদটাই হল, মুসলিম শাসকদের হাত থেকে যে মুহূর্তে দেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, পরে সরাসরি ব্রিটিশ রাজশক্তি ভারতের শাসনভার দখল নিল, সেটাই নাকি ভারতের স্বাধীনতালাভ। কারণ, মুসলিম শাসকরা নাকি বাইরে থেকে এসেছিলেন, তাঁরা নাকি ভারতের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে নষ্ট করেছেন। যদিও তাঁদের চোখে ব্রিটিশরা ‘বহিরাগত’ দোষে দোষী নয়। তাই সাভারকর থেকে গোলওয়ালকারের অনুচররা চিরকাল ব্রিটিশদের প্রতি অপার প্রভুভক্তি দেখিয়ে এসেছেন। স্বাধীনতাকামী দেশের নেতারা তাঁদের চোখে ছিলেন ঘৃণ্য। অন্যদিকে নেতাজি মনে করেছেন তাঁর প্রধান শত্রু ব্রিটিশ। আজাদ হিন্দ বাহিনীর একমাত্র উদ্দেশ্য স্বাধীন ভারত। বিশ্বযুদ্ধের শেষপর্বে যখন জাপান আত্মসমর্পণ করেছে, আজাদ হিন্দ বাহিনীও প্রায় বিধ্বস্ত, তখন বাহিনীর উচ্চস্তরের কয়েকজন নেতাজিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এবার তাঁরা কী করবেন? তিনি জবাব দিয়েছিলেন, যুদ্ধে তাঁদের পরাজয় হলেও আজাদ হিন্দের লড়াই ভারতের স্বাধীনতাকে অন্তত কুড়ি বছর এগিয়ে দিয়েছে।
বিশ্বাসঘাতকতা, ব্রিটিশদের চরবৃত্তি করাই স্বাধীনতা সংগ্রামে আরএসএস-বিজেপি ধারার মূল কাজ ছিল। তাই মিথ্যা ইতিহাস তৈরি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে হিন্দুত্ববাদীদের। ক্ষমতায় এসে তাঁরা ঐতিহাসিক দলিল দস্তাবেজকে বিকৃতও করছে বলে জানিয়েছেন অনেক ইতিহাসবিদ। অধ্যাপক রাম পুনিয়ানির ভাষায়, ‘বিজেপি যে কেবল জনসাধারণের আত্মপরিচিতিকেই ম্যানিপুলেট করছে তাই নয়, তারা ঐতিহাসিক আইকনদের পরিচিতিকেও ম্যানিপুলেট করছে।’ আর তাই আজাদ হিন্দ ফৌজিদের টুপি পরে নেতাজিকে আত্মসাৎ করতে নেমেছে গেরুয়া শিবির। বাংলায় প্রভাব বিস্তার ও ক্ষমতা দখলের জন্য নেতাজিকে নিয়ে টানাটানি করছে বিজেপি।
কিন্তু তাঁরা কি জানেন, বাংলায় তাঁদের প্রধান আইকন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কপাল ফাটিয়ে দিয়েছিল সুভাষচন্দ্র বসুর দলের কর্মীরাই? নেতাজির প্রত্যক্ষ নির্দেশেই এই বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন সেই তরুণরা। কলকাতায় হিন্দু মহাসভার সাম্প্রদায়িক প্রচারসভাকে একাধিকবার বিক্ষোভ দেখিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিল সুভাষচন্দ্রের যুব বাহিনী। শেষে শ্যামাপ্রসাদ নিজেই ময়দানে নামলে তাঁকেও সেই বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়। হিন্দুত্ববাদীদের হীন রাজনীতি ও বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে ১৯৪০ সালের ১৪ মে এক জনসভায় নেতাজি বলেছিলেন, ‘সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের ত্রিশূল হাতে ভোট ভিক্ষায় নামিয়ে দিয়েছে হিন্দু মহাসভা। ত্রিশূল ও গেরুয়া বসন দেখলেই তো হিন্দুরা ভক্তিতে মাথা নোয়ায়। ধর্মের সুযোগ নিয়ে, ধর্মকে হেয় করে হিন্দু মহাসভা রাজনীতির বৃত্তে প্রবেশ করছে। একে ধিক্কার জানানো সমস্ত হিন্দুদেরই কর্তব্য... জাতীয় জীবন থেকে এই বিশ্বাসঘাতকদের বিতাড়িত করুন। কেউ ওদের কথায় কান দেবেন না।’
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, গেরুয়া শিবিরের নেতারা আজ যে পথে চলছেন, তা কি নেতাজির পথ বলে মনে হয়? ইতিহাস সাক্ষী, তাঁদের আর নেতাজির পথ ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। এই রূঢ় বাস্তবকে সঙ্ঘের নেতারা কি শুধু নেতাজি স্তুতি দিয়ে ঢাকতে পারবেন?
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

গৃহে শুভ অনুষ্ঠানের আয়োজন। সন্তানের আবদার মেটাতে অর্থব্যয় বাড়তে পারে। মনের অস্থিরতা-উত্তেজনা দমন করুন।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৬.০৮ টাকা৮৭.১৭ টাকা
পাউন্ড১০৫.৪২ টাকা১০৮.৩৩ টাকা
ইউরো৮৮.৮৮ টাকা৯১.৫৮ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা