বাংলাদেশ ‘বিছরা হুয়া’ ভাই! কথাটা বলেছিলেন, পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও বিদেশমন্ত্রী মহম্মদ ইসহাক দার। ‘বিছরা হুয়া’-র অর্থ, হারিয়ে যাওয়া। ২ জানুয়ারি ইসলামাবাদে সাংবাদিক সম্মেলন করে এই পাক মন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশকে সম্ভাব্য সব উপায়ে সহযোগিতা করবে পাকিস্তান।
বাংলাদেশের যাঁরা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, ইসহাক দারের মন্তব্যে তাঁদের প্রতিক্রিয়া কী? পাকিস্তানি সেনাদের হাতে অত্যাচারিত হয়ে ১৯৭১ সালে কত মা-বোন ট্রমায়-রাগে-ক্ষোভে-লজ্জায়- অপমানে বোবা হয়ে গিয়েছিলেন, সেই হতভাগ্যদের পরিবারগুলির প্রতিক্রিয়া কী? পাক সেনাদের এলোপাথাড়ি গুলিতে যে লাখ লাখ মানুষের পিঞ্জর দুমড়িয়ে হৃদপিণ্ডটা টুকরো টুকরো হয়ে ছিটকে গিয়েছিল, তাঁদের পরিবার? যাঁরা ভয়ঙ্কর মৌলবাদীদের খপ্পড়ে পড়া দেশটায় মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন, তাঁরা নিশ্চিত জানেন, ইসহাক দারের কথার মর্মবস্তু! আসলে, ‘পাকিস্তান আজও মনে করে বাংলাদেশ তাদের গোয়াল থেকে ছুটে যাওয়া হারানো গোরু। সত্যিই তো, একাত্তরের আগে বাংলাদেশ ছিল ওদের গোয়াল ঘরে রশি দিয়ে বাঁধা। ইসলামাবাদ প্রতিদিন দুধটা নিয়ে যেত, আর রশিতে বাঁধা গোরুটা গোয়াল ঘরে শুয়ে শুকনো ঘাস চিবাত। ইসহাক দার হয়তো এতদিনে সেই ‘হারিয়ে যাওয়া’ গোরুটাকে খুঁজে পেয়েছেন। এবার চেষ্টা চলছে যদি রশি দিয়ে আবার বাঁধা যায়!’ বলেছিলেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক সালেহউদ্দিন আহমদ।
এই পাকিস্তানের জল্লাদ বাহিনীই তো মুক্তিযুদ্ধের সময় লক্ষ লক্ষ প্রাণ কেড়েছে। পুড়িয়ে দিয়েছে হাজার হাজার গ্রামের ঘরবাড়ি। ধর্ষণ করেছে এদেশের মা-বোনকে এবং তাদের আল-শামস ও আল-বদর বাহিনী দিয়ে হত্যা করেছে বাংলাদেশের হাজারো সন্তানকে। এসব ভুলিয়ে দেবেন মহম্মদ ইউনুস আর তাঁর সরকারের গুটিকয়েক ‘পাকিস্তান-প্রেমী’ মাতব্বর?
পাকিস্তান তো বাংলাদেশে রপ্তানির পথ খুলতে চাইবে নিজের স্বার্থেই। রপ্তানি করে তারা বিদেশি মুদ্রা পাবে। এর বাইরে তাদের কী আছে বাংলাদেশকে সাহায্য করার মতো? তাদের দেশে রাজনৈতিক যে অস্থিরতা ও গণতন্ত্রহীনতা, তা ওই দেশের জন্মের পর থেকেই আলোচনার বিষয়। সেসব থেকে অন্তত বাংলাদেশের কিছু শেখার নেই। অর্থনৈতিকভাবে তারা বাংলাদেশের চেয়েও রুগ্ন। তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২০২২ সালে ৯.৯ বিলিয়ন ইউএস ডলার, ২০২৩ সালে ১৩.৭৩ ইউএস বিলিয়ন ডলার এবং ২০২৪ সালে ১৬.০ ইউএস বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের রিজার্ভ ওই বছরগুলিতে আরও ভালো ছিল। জিডিপি বৃদ্ধিতেও বাংলাদেশ এগিয়ে। বিশ্বব্যাঙ্কের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের হার ৫.৮ শতাংশ এবং পাকিস্তানের হার -০.০ শতাংশ। সুতরাং পাকিস্তান থেকে সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে যে বাংলাদেশিরা বিরাট স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন, তারা প্রতারিত হবেন। একদিন তারা টের পাবেন, তাদের গোয়ালের দুধটা চুরি করে নিয়ে গিয়েছে পাকিস্তান। পড়ে রয়েছে শুধু শুকনো ঘাস। এটাই বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের ইতিহাস!
২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত আওয়ামি লিগ সরকারের আমলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত শীতল ছিল। কূটনীতিতে ‘রাজনৈতিক যোগাযোগ’ ছিল অত্যন্ত কম। ২০১০ সালে শেষ বিদেশ সচিব পর্যায়ের বৈঠক এবং ২০১২ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রীর ঢাকা সফর ছাড়া তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য যোগাযোগ ছিল না। মানুষে-মানুষে যোগাযোগ অর্থাৎ ভিসা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে জটিলতা, অশুল্ক বাণিজ্য বাধাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতাও ছিল। মোটা দাগে শুধু কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখা ছাড়া অন্যান্য যোগাযোগ ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সেই সম্পর্কের নতুন রসায়নের আভাস মিলেছে। ৫ আগস্টের পর সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির একটা আলোড়ন তৈরি হয়েছে। সঙ্গে পাকিস্তানের পক্ষ থেকেও নানাভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বিনির্মাণের একটা আকাঙ্ক্ষা দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে পাকিস্তানের দূতাবাসও বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে। পাক হাইকমিশনার দেখা করেছেন ইউনুস সরকারের উপদেষ্টাদের সঙ্গে। দেখা করেছেন বিএনপির নেতাদের সঙ্গেও। একইসঙ্গে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা ফি বাদ দিয়েছে ইসলামাবাদ। তারা সরাসরি ফ্লাইট চালু করার আগ্রহ দেখিয়েছে। বাংলাদেশের মাটিতে তারা স্টেশনও খুলতে চাইছে। যার অর্থ পাক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের অবাধ বিচরণ। গত সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদ অধিবেশনের সাইডলাইনে প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুসের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের ‘সৌজন্য বৈঠক’ হয়েছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে প্রাক্তন কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে কৌশলগত রোডম্যাপ তৈরি করেছেন বলেও জানা যাচ্ছে। ইউনুসের সঙ্গে আলোচনায় আরও নিবিড় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়ে আগ্রহ জানানো হয়েছে বলে সোশ্যাল মিডিয়া এক্সে পোস্টও করেছিলেন শরিফ। এরপরই উচ্ছ্বসিত বাংলাদেশের বিদেশ উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, হাসিনার আমলে ‘পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছুটা ইচ্ছাকৃতভাবে এবং অনেকটা আমাদেরও স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, এমন ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছিল।’ এদের প্রতিটি কথা প্রতিটি দিন লিপিবদ্ধ হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে।
প্রশ্ন হল, ইউনুস সরকার কাদের সঙ্গে এত মাখামাখি করছেন? কাদের আলিঙ্গনে নিজেদের বিশুদ্ধ প্রমাণ করতে চাইছেন? গত এক দশকে সেই পাকিস্তান সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের ধারণা কী? কখনও ‘দুর্নীতিপরায়ণ রাষ্ট্র’ তো কখনও ‘অনিরাপদ রাষ্ট্র’। কখনও ‘ক্লাইন্ট রাষ্ট্র’ তো কখনও ‘রগ স্টেট’। আবার কখনও ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’। ‘দুর্নীতিপরায়ণ রাষ্ট্র’ মানে দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা। এই বিশেষণের প্রমাণ সর্বশেষ দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই)। এই সিপিআই সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে পাকিস্তানের অবস্থান ১৩৩তম। পাকিস্তানকে ‘অনিরাপদ রাষ্ট্র’ বলার প্রমাণ ২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক শান্তি সূচক। এই শান্তি সূচকে দুই ধাপ উন্নয়ন করেও পাকিস্তানের অবস্থান ১৪০। সেখানে আট ধাপ কমেও বাংলাদেশের অবস্থান ৯৩। গত এক দশকে পাকিস্তানের আমেরিকা ও আন্তর্জাতিক সংস্থার উপর সামরিক ও আর্থিক নির্ভরশীলতা দেখে বোঝাই যায়, কেন তাদের ‘ক্লাইন্ট রাষ্ট্র’ বলে ব্যঙ্গ করা হয়। আর ‘রগ’ বা ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’ বলতে এমন একটি রাষ্ট্রকে বোঝায় যারা আন্তর্জাতিক শান্তির ক্ষেত্রে বড় বিপদ। ২০২২ সালে আমেরিকার ‘ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট’-এর প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, জঙ্গি অর্থায়নের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ পাকিস্তান। নোবেল জয়ী ইউনুস সাহেবের পাকিস্তান সম্পর্কে কোন বিশেষণটা পছন্দ হয়েছে? তিনি কী জানেন না, এই ধরনের রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা হবে আত্মহত্যার শামিল? নাকি, তিনি উপমহাদেশের এই অংশে আগুন জ্বালাতে চাইছেন?
ভৌগোলিক পরিধির বিবেচনায় পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ প্রতিবেশী ভারত ও আফগানিস্তান। তারপরেই রয়েছে ইরান। পাকিস্তানের সঙ্গে এই তিন প্রতিবেশীর কারো সঙ্গেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নেই। সম্পর্কটা সাপে-নেউলে। ভারতের সঙ্গে একটা ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব তো রয়েছেই। তার সঙ্গে বর্তমান আফগানিস্তানের সঙ্গেও পাকিস্তানের সম্পর্ক অত্যন্ত শত্রুভাবাপন্ন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হলে ভারতের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত একটা সুবিধা রয়েছে। কিন্তু তা বহুলাংশে লাভের চেয়ে ঝুঁকির পরিমাণ বাড়াবে। কারণ, এই চাপ সামলাতে ভারতও তার পাল্টা ব্যবস্থা নিতে চাইবে। আবার ভারতের সঙ্গে ইরান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো, সেটা বাংলাদেশের জন্য আঞ্চলিক রাজনৈতিক বলয়ে আরও কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে আরও চ্যলেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে।
এসবের পিছনে আরও একটি খবর বাংলাদেশে এখন বহু আলোচনার কেন্দ্রে। বিবিসির খবর, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এই প্রথম পাকিস্তানের করাচি থেকে কন্টেনার বহনকারী জাহাজ সরাসরি এসে ভিড়েছে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে। পাকিস্তানের করাচি থেকে ছেড়ে আসা ‘এমভি ইউয়ান জিয়ান ফা ঝং’ নামে ওই জাহাজটি গত ১৩ নভেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরে এসে ভিড়েছিল। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পণ্য খালাস হয়ে গেলে পরদিনই জাহাজটি বন্দর ত্যাগ করেছে। নতুন করে এই জাহাজ ভেড়ানোর খবর দু’দেশের সম্পর্কের উষ্ণতার ইঙ্গিত দিচ্ছে।’
উষ্ণতার ইঙ্গিত? পাকিস্তান থেকে কিছু শিল্পের কাঁচামাল, চুনা পাথর ও গাড়ির যন্ত্রাংশ আনতে পেরে বাংলাদেশিরা কি উষ্ণতায় মজে যাবে? এই সেই চট্টগ্রাম বন্দর যেখানে এই জাহাজ আসার আগে পাকিস্তান থেকে শেষ জাহাজ এসেছিল ১৯৭১ সালের মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে। গোটা জাহাজটা ভর্তি ছিল অস্ত্রশস্ত্রে। যা ব্যবহৃত হয়েছিল গণহত্যায়। পঁচিশে মার্চ এবং তার পরবর্তী নয় মাস ধরে। চট্টগ্রাম বন্দরের শ্রমিকরা তখন অস্বীকার করেছিল ওই জাহাজের অস্ত্রশস্ত্র খালাস করতে। পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লোক এনে সেই অস্ত্র ক্যান্টনমেন্টগুলিতে নিয়ে যায়। বাংলাদেশের যাঁরা উষ্ণতা জানাতে চান, তাঁরা কি জানেন না— আজও পর্যন্ত পাকিস্তান বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমা চায়নি। তাঁরা কি জানেন না, স্বাধীনতার ঠিক আগে বাংলাদেশের যে সম্পদ পাকিস্তান লুঠ করে নিয়ে গিয়েছিল, তা ফেরত দেওয়া তো দূরের কথা, আজও পর্যন্ত তার কোনও হিসেব দেয়নি।
এরপরও বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়া কাঁপানো লেখক ফাহাম আবদুস সালামদের মতো কেউ কেউ মনে করেন, ‘গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ সরকার ভারতের চোখ দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করেছে এবং ১৯৭১ সালকে ঘিরে বিভাজনের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করেছে। যেটা সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না।’ কী বলবেন একে— পাকিস্তানের দালালি? নাকি ভারতের সঙ্গে বেইমানি? আসলে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠলে সেখানকার ‘উগ্র ধর্মবাদ’ বাংলাদেশেও প্রভাব বিস্তারের সুযোগ চাইবে। যা মনেপ্রাণে চাইছে জামাত সহ বাংলাদেশের মৌলবাদী সংগঠনগুলি। ড. ইউনুসের প্রশ্রয়ে এই মৌলবাদীরাই এখন গিলে ফেলছে গোটা দেশকে। দ্রুত।
আর কুর্সিতে বসা ইস্তক যতটা ভারত-বিরোধী, তার থেকে অনেক বেশি পাকিস্তান-প্রেমী হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাও। দেখে মনে হবে যেন, মনেপ্রাণে মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ই চেয়েছিলেন মহম্মদ ইউনুস!