এক ঘৃণ্য মানসিকতার প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে উঠছি আমরা। দেশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করার চেষ্টা চলছে। অবাক কাণ্ড! একই সময়ে আমাদের পাশের রাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারও সে দেশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করছে। দুই দেশের ক্ষমতাবানদের এই ভীমরতি দেখে দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ। একদা সাভারকর, হেডগেওয়ার, গোলওয়ালকররা যে মনোভাব ব্যক্ত করতেন, এখন সেই ভাষাতেই কথা বলছেন মোহন ভাগবত। এমন বেআক্কেলে কথায় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের লড়াই, আবেগ, আত্মবলিদানকেও অসম্মান করা হয়। ক্ষুদিরাম, নেতাজি, ভগৎ সিং, গান্ধীজি, কানাইলাল, বিনয়, বাদল, দীনেশদের অসম্মান করার অধিকার তাঁকে কে দিয়েছে? তাহলে কি সত্যিই এতদিনে ঝোলা থেকে বেরিয়ে পড়ল বেড়াল? বোঝা গেল গেরুয়া বাহিনীর দেশভক্তির প্রকৃত তলটাকে?
অথচ নেতাজিকে নিয়ে ইদানীং তাদের কত গদগদ ভাব! কত ড্রামাবাজি! নেতাজি এবং আরএসএসের সখ্য নিয়ে সম্প্রতি তারা নানা ভুয়ো ইতিহাসের অবতারণা করে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন, নেতাজি তাঁদের আদর্শের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। কিন্তু প্রকৃত ইতিহাস বলছে, নেতাজির মধ্যে কোনও মৌলবাদ বা সাম্প্রদায়িক চেতনা ছিল না। তাই তিনি সাভারকর বাহিনীকে মোটেই ভালো চোখে দেখতেন না। তিনি মনে করতেন এই ধরনের শক্তি, দেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিপজ্জনক। নিজেদের দেশপ্রেমী সত্তাকে স্বচ্ছরূপে প্রকাশ করতে সেই সত্যকে আজ মুছে ফেলতে চাইছে আরএসএস, বিজেপি। কিন্তু তা মুছে ফেলা সম্ভব নয়। ইতিহাস বলছে, একদিকে ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দেশভক্তি, অন্যদিকে ছিল হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএসের প্রভুভক্তি। একদিকে যখন বিপ্লবীরা প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতার লড়াইয়ে নেমেছিলেন, অন্যদিকের নেতারা তখন নানাভাবে ইংরেজদের সহায়তা দানে ব্রতী হয়েছিলেন। তাঁদের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। সাভারকর জেল থেকে ব্যক্তিগতভাবে মুক্তিলাভের প্রত্যাশায় ইংরেজদের ‘প্রভু’ সম্বোধন করে একের পর এক মুচলেকা পত্র লিখেছেন। এর মূল বক্তব্য ছিল, আমাকে দয়া করে ক্ষমা করুন, আর কোনওদিন স্বাধীনতার কথা উচ্চারণ করব না। বরং আপনাদের সাহায্য করব। এদের সঙ্গে কি কখনও নেতাজির তুলনা করা চলে?
আজ বিজেপি তাদের দেশপ্রেম নিয়ে আত্মজাহিরের পথে নেমেছে। কিন্তু তাঁদের রাজনৈতিক পূর্বপুরুষদের দেশপ্রেম সম্পর্কে ভাবাবেগ ও আন্দোলনের প্রতি অনুগত্য সন্দেহাতীত ছিল না। পর পর কয়েকটি তথ্য সাজিয়ে দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। ১৯১৫ সালে মদনমোহন মালব্য যে হিন্দু মহাসভা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তার ভাবনায় ছিল ব্রিটিশদের হাত থেকে দেশের হিন্দুদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখা। কংগ্রেসের সঙ্গে সেই আদর্শের কোনও বিরোধ ছিল না। পরবর্তীকালে সাভারকররা বুঝেছিলেন, হিন্দু মহাসভাকে কংগ্রেসের দোসর করে রাখলে তাঁদের মূল উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না। ১৯২০ সালে গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলন সারা দেশকে এক জাতীয়তাবোধের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ইংরেজরা বুঝেছিল, শুধু প্রশাসনিক শক্তির মাধ্যমে দমন পীড়ন করে এই আন্দোলনকে স্তব্ধ করা যাবে না। অন্য কৌশলও নিতে হবে। ১৯০৫ সালে তাদের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল। তাই তারা সুযোগ খুঁজছিল সাম্প্রদায়িকতার পালে হাওয়া দিতে। তার জন্য ইংরেজরা বিশেষ ব্যক্তির সন্ধানে ছিলেন। বারবার মার্সি পিটিশনের আবেদন দেখে ইংরেজরা বুঝেছিলেন, সাভারকরই সেই ব্যক্তি, যাঁকে ব্যবহার করে আন্দোলনের বিরুদ্ধাচরণ করা যায়। ১৯২৪ সালে মুক্তি পেলেন সাভারকর। পরের বছর ১৯২৫ সালে নাগপুরে আর কানপুরে সাহেবদের অনুপ্রেরণায় ও আনুগত্যে কয়েকদিনের ব্যবধানে জন্ম নিল দু’টি সংগঠন। একটি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ এবং অন্যটি কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া। গোপন শর্ত ছিল, নানাভাবে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধতা করে ইংরেজ শাসন ব্যবস্থাকে দৃঢ় ও সুনিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এলোমেলো হাওয়াটাকে কাজে লাগিয়ে নেতাজি যখন সেটাকে স্বাধীনতা অর্জনের কাজে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন, তখন ইংরেজদের পাশে দাঁড়িয়েছিল আরএসএস এবং কমিউনিস্ট পার্টি। আর বর্তমানে কী অবস্থা! আজ সেই বিরুদ্ধরাই নেতাজিকে নিয়ে নাচানাচি করছে, তাঁর স্তুতিগানে গগন ফাটাচ্ছে। ‘মন্দিরে তারা এসেছে ভক্ত সাজি।’
ইংরেজদের বিরুদ্ধে বাহিনী গঠন করে নেতাজি যখন ইম্ফল সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢুকে সার্বিক লড়াইয়ের পথে নেমেছিলেন, তখন সাভারকর ভারতীয় হিন্দু যুবকদের সেই লড়াইকে পর্যুদস্ত করতে ইংরেজদের বাহিনীতে দলে দলে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টি তখন তাদের ‘পিপলস ওয়্যার’ পত্রিকায় একের পর এক নেতাজির অসম্মানজনক কার্টুন ছাপছে, ব্যঙ্গ ও কুৎসা করেছে। সেই ঘৃণ্য ইতিহাস মুছে ফেলা যাবে না। অন্যদিকে কংগ্রেসও নেতাজির উত্থানকে ভালো চোখে দেখেনি। তারাও চায়নি আন্দোলনের রাশ কংগ্রেসের হাত থেকে নেতাজির হাতে চলে যাক। সুতরাং নেতাজিকে এতগুলি বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছিল। তিনি বুঝেছিলেন, কোনওভাবে ভারতে ফিরলে তথাকথিত দেশপ্রেমীদের হাতে তিনি খুন হয়ে যাবেন, তাই তিনি আত্মগোপন করার কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। সেই কৌশলই হয়তো ছিল সাজানো বিমান দুর্ঘটনা। এতেই বোঝা যায়, সেই মুহূর্তে ভারতের সমস্ত নেতার চেয়ে তিনি ছিলেন অনেক বেশি বুদ্ধিমান, দূরদর্শী। মেজর জেনারেল জি ডি বক্সি তাঁর ‘বোস: দ্য ইন্ডিয়ান সামুরাই— নেতাজি অ্যান্ড দ্য আইএনএ মিলিটারি অ্যাসেসমেন্ট’ বইতে লিখেছেন, ‘নেতাজি বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হননি। আসলে নেতাজি যাতে নিরাপদে সোভিয়েত ইউনিয়নে পৌঁছে যেতে পারেন, সেটা প্রমাণ করতেই জাপানি গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে তা প্রচার করা হয়েছিল।’
নেতাজি জানতেন, এদেশে স্বাধীনতার পথে সব থেকে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ধর্মান্ধতা। একদিকে হিন্দু মহাসভা, অন্যদিকে মুসলিম লিগ। তিনি বললেন, হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লিগের মতো সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলি আগের থেকে অনেক বেশি সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠেছে।’ তিনি আরও বললেন, ‘ধর্মের সুযোগ নিয়ে ধর্মকে কলুষিত করে হিন্দু মহাসভা রাজনীতির ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে। হিন্দু মাত্রেরই তার নিন্দা করা উচিত।’ সারা জীবন তিনি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের নিন্দা করে এসেছেন। এমনকী নেতাজি তাঁর বাহিনী গঠনের সময় সমস্ত প্রথা ভেঙে দিয়েছিলেন। সেনাবাহিনী গঠন করা হতো ধর্ম, জাতি ও আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে। কিন্তু নেতাজি যে বাহিনী গঠন করলেন, সেখানে সকলকে একসঙ্গে মিশিয়ে দিলেন। তাঁদের বোঝালেন, তোমরা একে অপরের ভাই। বাহিনীতে ধর্মের পার্থক্য মুছে দিতে না পারলে কাজের ক্ষতি হবে। বাড়বে পারস্পরিক বিদ্বেষ। কিন্তু কখনওই তিনি মানুষের ধর্মীয় আবেগকে আঘাত করেননি। নিজের ধর্ম পালন করতে গিয়ে অন্য ধর্মকে আঘাত করা এক ধরনের কুশ্রী মানসিকতা, অজ্ঞতা। তাঁর নির্দেশমতো বাহিনীতে সকল ধর্মের অনুষ্ঠানে সকলে একসঙ্গে যোগদান করতেন। বাহিনীতে হিন্দুরা পরস্পরের সঙ্গে দেখা হলে বলতেন, ‘রাম রাম’, মুসলিমরা বলতেন, ‘সেলাম’। নেতাজি দেখলেন, এর মধ্য দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার এক অশুভ চেতনা, যা বাহিনীর ভিতরের শক্তিকে দুর্বল করতে সক্ষম। তাই নেতাজি নির্দেশ দিলেন, একে অপরকে সম্ভাষণ জানানোর জন্য ‘জয় হিন্দ’ বলবেন।
সিঙ্গাপুরে থাকাকালীন তিনি অর্থ সাহায্যের জন্য চিঠি লিখলেন চেট্টিয়ার মন্দিরের অছি পরিষদকে। তাঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন নেতাজির ভক্ত। তাই তাঁরা বললেন, নেতাজি যদি তাঁদের মন্দিরে এসে বক্তৃতা দেন, তবে তাঁরা নেতাজিকে সাহায্য করবেন। নেতাজি তাঁদের জানালেন, চেট্টিয়ার মন্দিরে হিন্দু ছাড়া অন্য কোনও ধর্মের প্রবেশাধিকার নেই বলেই তিনি জানেন। কিন্তু মন্দির কর্তৃপক্ষ যদি ধর্মনির্বিশেষে তাঁর বাহিনীর সব অফিসারকে মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি দেয়, তবে তিনি যেতে রাজি। মন্দির কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে রাজি না হলে তিনি যাবেন না, এমনকী টাকাও তিনি চান না। এরপর মন্দির কমিটি নেতাজির দাবি মেনে নিলেন। নেতাজি তাঁর বাহিনীর সমস্ত হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান অফিসারকে নিয়ে মন্দিরের গর্ভগৃহ পর্যন্ত চলে যান। সকলে কপালে তিলক কাটলেন, প্রসাদ খেলেন। নেতাজি সকলকে এভাবেই ধর্মনিরপেক্ষতার পাঠ দিয়েছিলেন। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, মন্দিরে ঢোকায় যেমন হিন্দুত্ব খতরে মে পড়ে যায় না, তেমনই কোনও ধর্মই খাটো হয়ে যায় না। এখানেই ধর্মের উদারতা। এই শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন স্বামীজির আদর্শ থেকে। বুঝেছিলেন, রাজনীতির কবল থেকে ধর্মকে মুক্ত করতে পারলে তার শুচিতা বাড়ে। নেতাজির এই শিক্ষা আমরা ভুলতে বসেছি। তার মূলেও আছে রাজনীতি। তাই সবসময় প্রয়োজন রাজনীতি বিমুক্ত ধর্ম। রাজনীতি বিমুক্ত হলেই ধর্ম কল্যাণকামী ও মানবিক হয়ে ওঠে।
আজ দেশের এই বিপন্ন সময়ে নেতাজির আদর্শই পরম মহৌষধি। মনে রাখা দরকার, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে মৌলবাদের দাঁত যত বেশি ধারালো হবে, ততই এদেশে বাড়বে হিন্দু মৌলবাদের শক্তি। দু’টোই আধুলির এপিঠ আর ওপিঠ। দুই শক্তিই দুই দেশে সাধারণ মানুষের জীবনে অশনিসংকেত ডেকে আনছে। ভাত দেওয়ার সরকার যখন তার কাজে ব্যর্থ হয়, তখনই সে ধর্মীয় উস্কানি ছড়ানোর গোঁসাই হয়ে ওঠে। এটাই সত্য শাশ্বত।