পরামর্শে পিজি হাসপাতালের অধ্যাপক ডাঃ সরোজকুমার মণ্ডল।
সকাল সকাল বাজারে গিয়েছিলেন পরিতোষ মিত্র। বয়স ৫০-এর কোঠায়। ফিরে এসে স্নানটান সেরে তৈরি হলেন অফিসের জন্য। গিন্নিকে ভাত বাড়তে বলে সবে নিজের ঘরে ঢুকেছেন, হঠাৎ মাথাটা কেমন যেন ঘুরে গেল। চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করলেন পরিতোষবাবু। সঙ্গে বুকে একটা চিনচিনে ব্যথা। মিনিট খানেকের মধ্যেই পরিস্থিতি হাতের বাইরে বেরিয়ে গেল। মেয়েরা মিলে কাছের এক হাসপাতালে তড়িঘড়ি নিয়ে যেতে সে যাত্রা প্রাণে বাঁচলেন পরিতোষবাবু।
তবে সকলে বাঁচেন না! হার্টের অসুখের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়েই হাতে সময় পাওয়া যায় না। তবে হার্টের অসুখের ইমার্জেন্সি তৈরি হলে অবশ্যই কিছু জরুরি বিশয় মনে রাখতে হবে। কী করণীয় তা জানার আগে কিছু মূল বিষয়ের দিকে খেয়াল করা যাক।
হার্ট অ্যাটাক চিনুন
হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গ বলতে বুকে ব্যথা ও অস্বস্তিকেই মূলত বোঝায়। তবে বুকে ব্যথা মানেই যে তা হার্ট সংক্রান্ত জটিলতা থেকে হচ্ছে, এমন সবসময় নয়। তবে আগে থেকে হার্টর অসুখ রোগীর না থাকলে এই ধরনের সমস্যাকে অতটা গুরুত্ব দেন না অনেকে। অকারণ বাড়িতে রেখে কয়েকটা গ্যাসের বড়ি খাইয়ে শুশ্রূষা করে রোগীকে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়, আর এতেই সময় নষ্ট হয়। রোগীর আগে থেকে ডায়াবেটিস থাকলে আরও বেশি করে সতর্ক হতে হবে। যে কোনও দিকে বুকে ব্যথাই হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ হতে পারে। তবে রোগীর বুকে চিনচিনে বা প্রবল ব্যথা, বুকে পাথর চাপা দেওয়ার মতো কষ্ট, চাপা অস্বস্তি, বুক ধড়ফড় অতিরিক্ত বিজবিজে ঠান্ডা ঘাম, শ্বাসকষ্ট, বুকের ডানদিক, বাঁদিক, চোয়াল, নাভির দিক, কখনও কখনও পিঠের দিকে বা হাতের আঙুলের দিকে ব্যথা নামলেও তা চিন্তার কারণ হয়ে উঠতে পারে। এই উপসর্গগুলির বেশিরভাগ উপস্থিত থাকলে দ্রুত পদক্ষেপ করতে হবে।
তবে বুকে ব্যথা শুরু হলেই তাকে হার্টের সমস্যা বলে দেগে দেওয়া নিরর্থক। এমনটা সবসময় হয় না। কিছু বিষয় খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, ব্যথার উৎপত্তি কোথায়। তবে ইদানীং বহু ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাক আগাম কোনও অসুখ বা উপসর্গ ছাড়াই হানা দেয়। ৩০ বছরেরও কমবয়সিরাও হার্ট অ্যাটাকের শিকার হতে পারেন। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অবৈজ্ঞানিক ডায়েট, মানসিক স্ট্রেস, অতিরিক্ত ওজন এই সমস্যার মূল কারণ। তাই উপসর্গগুলি দেখা দিলে অবহেলা করবেন না।
কেন হয় হার্ট অ্যাটাক
হৃৎপিণ্ড বা হার্টের কাজ হল শরীরের সর্বত্র রক্ত সরবরাহ করা। দূষিত রক্তকে শোধন করে শরীরের প্রতিটি অংশে ও কোষের কোনায় কোনায় রক্ত পৌঁছে দেওয়ার জন্য হৃদপেশিগুলি সঙ্কুচিত ও প্রসারিত হয়। এই কাজ সারার জন্য হৃদপেশিগুলির যে শক্তির প্রয়োজন হয়, তা খাদ্যে থাকা অক্সিজেন ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান থেকে আসে। করোনারি আর্টারি বা করোনারি ধমনি এই রক্ত বহন করার দায়িত্বে থাকে। তাই চলারপেথে ফ্যাট বা করোনারি প্লেকে বাধা পেলে আর্টারির পথ অবরুদ্ধ হয়ে যায়। করোনারি আর্টারিতে রক্ত জমাট বাঁধার কারণে রক্তপ্রবাহ হ্রাস পেতে থাকে। তখনই হার্ট অ্যাটাক হানা দেয়।
প্রাথমিক করণীয়
এমন সমস্যা এলে প্রথম এক ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা নিতে হবে। হার্টের অসুখে এই সময়কে ‘গোল্ডেন আওয়ার’ বলে। প্রথম ঘণ্টার মধ্যে রোগীর চিকিৎসা শুরু হলে তবেই হার্টের পেশির ক্ষতি হওয়া অনেকাংশে আটকানো যায়। তাই দ্রুত রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে আসুন। হাসপাতালে নিয়ে আসার আগে ৩০০-৩৫০ মিলিগ্রাম অ্যাসপিরিন চিবিয়ে বা জলে গুলে খাইয়ে দিন রোগীকে। এর সঙ্গে দুটো অ্যান্টাসিডও খাওয়াতে হবে। এতে রক্তের জমাট বাঁধা সাময়িকভাবে আটকানো যায়।
• যদি রোগীর রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে, তাহলে তীব্র বুকে ব্যথা হলে দু’টি অ্যাসপিরিন ও অ্যান্টাসিড যেমন খাওয়াতে বলা হল, তা দিয়ে জিভের তলায় ৫ মিলিগ্রাম সরবিট্রেট দিতে পারেন। তবে উচ্চ রক্তচাপের রোগী হলে সরবিট্রেট দেওয়া উচিত নয়।
• এই সময় রোগীকে কোনও চিকিৎসকের ব্যক্তিগত ক্লিনিকে নিয়ে গিয়ে সময় নষ্ট করবেন না। বরং দ্রুত কোনও হাসপাতাল বা নার্সিং হোমে যান, যেখানে ট্রপ টি ও ইসিজি করার সুযোগ আছে। এই দুই পরীক্ষা থেকে বোঝা যাবে রোগীর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে কি না এবং হলেও এখুনি কী ধরনের চিকিৎসা তার প্রয়োজন।
হার্ট ফেলিওর
হার্ট অ্যাটাকের সঙ্গে হার্ট ফেলকে গুলিয়ে ফেলেন অনেকেই। বেশিরভাগ মানুষের ধারণা, হার্ট ফেল ও হার্ট অ্যাটাক এক। কিন্তু এই দুই অসুখ সম্পূর্ণ আলাদা। নানা কারণে হৃৎপিণ্ডের পেশি দুর্বল হয়ে গেলে তার পাম্প করার ক্ষমতা কমে যায়। ফলে শরীরে রক্ত চলাচল ব্যহত হয়, অক্সিজেনের ঘাটতি পড়ে। একেই হার্ট ফেলিওর। হার্ট ফেলিওরকে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা হয়। ১) হার্ট যখন সঠিকভাবে সংকুচিত হতে পারে না, তাকে বলে রিডিউস ইজেকশন ফ্র্যাকশন। ২) হার্ট সংকুচিত হলেও প্রসারিত হতে পারে না। একে বলে প্রিজার্ভ ইজেকশন ফ্র্যাকশন।
হার্ট ফেল বুঝুন
হার্ট ফেলিওরে শ্বাসের কষ্ট দেখা যায়। রোগের হার্ট বিট বেড়ে যায়। কোনও কাজে তেমন এনার্জি পাওয়া যায় না। শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে। রোগীর গোড়ালি ও পা ফুলে যায়, খিদে কমে যায় ও গা বমি ভাব বাড়তে থাকে। কাশি ও শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় সাঁই সাঁই আওয়াজ হয়। বুক ধড়ফড় ও শ্বাসকষ্ট হয়।
কেন হয় হার্ট ফেলিওর
যে কোনও আবেগের আতিশয্যে যেমন হঠাৎ উত্তেজনা, রাগ, শোক ও নানা আবেগের বাড়াবাড়িতে হার্টকে বেশিবার পাম্প করতে হয়। হাই ব্লাড প্রেশার থাকলে হার্টকে অনেক বেশি পাম্প করতে হয়। সাধ্যের অতিরিক্ত কাজ করতে গিয়ে হার্টের পেশি ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। হার্ট অ্যাটাকের পর ঠিক মতো চিকিৎসা না করলে হার্ট ফেলিওরের শঙ্কা বাড়ে। তাছাড়া হার্ট অ্যাটাকের পর রোগী নিয়ম না মানলে বা সঠিক চিকিৎসা না করলে হৃদপেশি দুর্বল হয়ে পড়ে। হার্ট ফেলিওর হওয়ার শঙ্কা বাড়ে। তাছাড়া করোনারি আর্টারি ডিজিজ বা ক্যাড থাকলে হৃৎপেশিতে অক্সিজেন যুক্ত রক্ত সরবরাহ কমে গিয়ে এই ঝুঁকি কমে। ভালভের সমস্যাও এই রোগ ডেকে আনে। এছাড়া মদ্যপান, ধূমপান ও কেমোথেরাপিতে ব্যবহৃত নানা ওষুধের পর্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় এই অসুখ হয়।
মায়োকার্ডাইটিস হলেও হার্ট ফেলিওরের শঙ্কা থেকে যায়। অতিরিক্ত ওজন ও নাক ডাকার সমস্যা থাকলে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। থাইরয়েড, রক্তের কিছু অসুখ, কিছু অ্যালার্জি হার্ট ফেলিওরের সমস্যা বাড়াতে পারে। ভাইরাসের সংক্রমণ বা অ্যামাইলয়েড ডিপোজিটজনিত অসুখ থেকেও এই রোগ হয়। ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজের কারণেও হার্ট ফেলিওর হয়। তবে বংশগত কারণেও হার্ট ফেলিওর হতে পারে।
কার্ডিওমায়োপ্যাথি
ডায়াবেটিসের কারণে হৃদপেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলে কার্ডিওমায়োপ্যাথি হয়। হার্টের চেম্বার বড় হওয়ার সঙ্গে সংকোচন-প্রসারণের ক্ষমতাও কমে আসে। একে বলে ডায়ালেটেড কার্ডিওমায়োপ্যাথি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অজানা কারণেও এই হার্টের সমস্যা হয়। এই সমস্যাকে বলা হয় হাইপারট্রফি কার্ডিওমায়োপ্যাথি। এক্ষেত্রে মাংসপেশি স্ফীত হয়, কিন্তু হার্টের পেশি সঠিকভাবে প্রসারিত হতে পারে না। হঠাৎ করে ঘটতে পারে প্রাণহানি।
আবার আরও কিছু সমস্যায় হার্টের পেশি প্রসারিত হতে পারে না। তবে এক্ষেত্রে হার্টের পেশি স্ফীত হয় না, হৃদগহ্বর বা হার্টের ক্যাভিটিও বড় হয় না। একে বলে রেসট্রিকটিভ কার্ডিওমায়োপ্যাথি। মায়োপ্যাথি অবহেলা করলে হার্ট ফেলিওর ও মৃত্যইে শেষ পরিণতি হয়।
হার্ট ফেলিওরে কী করবেন
রোগ প্রতিরোধই এই সমস্যার উৎকৃষ্ট সমাধান। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল থাকলে, নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। তবে এক্ষেত্রেও ভালভের অসুখ আছে কি না, রোগী ধূমপান করেন কি না, বংশের ইতিহাসে হার্ট ফেলিওরের সমস্যা ছিল কি না ইত্যাদি বিষয়গুলিও খতিয়ে দেখতে হয়।
হার্ট ফেলিওর হচ্ছে বুঝলে রোগীকে প্রথমেই কোনও হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে প্রথমে করতে হবে ইকো কার্ডিওগ্রাম। হার্ট ফেলের ইঙ্গিত এই টেস্টেই ধরা পড়ে। এছাড়া হার্টের এমআরআই বা হার্টের নিউক্লিয়াস স্ক্যান করেও রোগের স্পষ্ট আভাস মেলে। রিপোর্ট অনুযায়ী শুরু হয় চিকিৎসা। রোগীকে অবশ্যই ধূমপান, মদ্যপান বাদ দিতে হবে। শ্বাসকষ্ট হলে চিকিৎসক ওষুধ দিয়ে বিষয়টি সামলাবেন। পরবর্তী চিকিৎসা ও পেসমেকার বসানো সবটাই নির্ভর করবে রোগীর শারীরিক অবস্থরি উপর। প্রয়োজন বুঝে চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নেবেন।
লিখেছেন মনীষা মুখোপাধ্যায়