বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ

বাঁধা সাঁকো ভেঙে ফেলব আমরা?
হারাধন চৌধুরী

‘ভাঙা সংসার ছাড়া আর সবই জুড়ে দিতে পারে’—বাংলারই একটা পণ্যের অত্যন্ত জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনী ক্যাচলাইন এটা—তৈরি হয়েছে বাঙালির মনস্তত্ত্ব ঘেঁটেই। কেননা, বাঙালি বেঁচে আছে বস্তুত ভাঙাভাঙির ভিতর দিয়ে। তার দেশ যে কতবার ভেঙেছে, তার খতিয়ান মনে রাখা দুঃসাধ্য! একইভাবে ভেঙেই চলেছে বাঙালির সংসার। বাঙালির যৌথ পরিবার নিশ্চিহ্নপ্রায়। অথচ একটা সময় এটাই ছিল পরিবারগুলোর যুগপৎ সৌন্দর্য ও শক্তি। আর এখন ‘তুমি আর আমি আর আমাদেরই সন্তান, এই আমাদের পৃথিবী!’ এই ‘সুখী পরিবার’ যে আমাদের জন্য কোনও ‘সুখী গৃহকোণ’ রচনা করতে পারেনি, তা আমরা বুঝি পারিবারিক অ্যালবামের বিবর্ণ ছবিগুলোর উপর হাত বুলিয়ে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
নবাব সিরাজ উদ্দৌলার আমলে বাংলা (উভয় বঙ্গ), বিহার (বর্তমান ঝাড়খণ্ড-সহ) ও উড়িষ্যা (‘ওড়িশা’ তখন বলা হতো না) একান্নবর্তী ছিল। এই সুবিশাল রাজত্ব পরিচালিত হতো মুর্শিদাবাদ থেকে। পলাশির যুদ্ধে সিরাজের পতনের পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পুরো এলাকা কব্জা করে, এমনকী বক্সার যুদ্ধের পর তারা দেওয়ানি পায় দিল্লির সম্রাটের থেকে। সমগ্র অঞ্চল পরিচিত হয় ‘বেঙ্গল প্রেসিডেন্স‍ি’ নামে। ১৯১২ সালে বিহার ও উড়িষ্যা প্রদেশ বেরিয়ে যায় বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি থেকে। এমনকী, প্রশাসনিক সংস্কারের দোহাই দিয়ে লর্ড কার্জন অবশিষ্ট বাংলাকেও ভেঙে ফেলার ষড়যন্ত্র করেন। তাঁর সিদ্ধান্ত মতো ১৯০৫ সালে তৈরি হয় পৃথক ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ প্রদেশ। এর বিরুদ্ধেই গড়ে ওঠে ‘বঙ্গভঙ্গ’ বিরোধী তীব্র গণআন্দোলন। ব্রিটিশ সম্রাটের নির্দেশে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত ১৯১১-য় বাতিল হলেও চরম মূল্য দিতে হয় আমাদের। ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় সুদূর দিল্লিতে! কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হয়নি, ১৯৪৭ সালে বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশকে যূপকাষ্ঠে চড়ানোর শর্তে মেলে ‘স্বাধীনতা’। পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় পূর্ববঙ্গ। কিন্তু ‘পাকিস্তান’ রাষ্ট্র ‘পূর্ব পাকিস্তান’ প্রদেশ বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের কাছে পরাজিত হয় ঠুনকো ‘ইসলামিক ঐক্য’—১৯৭১-এ সৃষ্টি হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। শুধুমাত্র বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে একটি আস্ত রাষ্ট্রের পত্তনের এই দৃষ্টান্ত বিশ্ব ইতিহাসে অভূতপূর্ব। 
তবে বাংলা নিয়ে ভাঙাভাঙির খেলা কি শেষ হয়েছে আদৌ? না। এপার, ওপার—বাংলার দু’দিক থেকেই মাঝেমধ্যে বিচ্ছিন্নতার হুংকার কানে আসে। জোড়ার সম্ভাবনা নিয়ে আপাতত কেউ ভাবে না। বরং কাঁটাতার কেন মজবুত নয় এবং এখনও কত কিমি কাঁটাতার বাকি—দুই বাংলার ‘অরক্ষিত’ সীমান্ত ঘিরে তারই রাজনৈতিক তরজা জারি থাকে অহরহ।
‘ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই’ মেনে নিয়েছে বাঙালি—অতঃপর, পরিবারিক বন্ধনের বিকল্প উপায়ও বার করেছে—পারিবারিক অনুষ্ঠান। সুযোগ যেন ‘মিস’ না-হয়, এমন আন্তরিকতায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনেক সদস্য দেশ-বিদেশ থেকে এসে একত্র হয়। একই প্রবণতা ফিরে এসেছিল বাঙালির বৃহৎ পরিসরেও। দুই বাংলা রাজনৈতিকভাবে এবং রাষ্ট্রিক পরিচয়ে পৃথক হলেও বারবার প‍্রমাণ দিয়েছে যে, এসব বাহ্য। আত্মিক পরিচয়ে আমরা প্রত্যেকেই বঙ্গজ, বঙ্গসন্তান। আমাদের ভাষা, শিক্ষা, খাদ্যরুচি, পোশাকআশাক, উৎসব-সংস্কৃতির মধ্যে কোনও প্রভেদ নেই। বাংলা বর্ষবরণ দিয়ে শুরু হয়ে, কয়েক দশক যাবৎ তার মধুর পরিসমাপ্তি হয় বইমেলাতে। এপারে ‘আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা’ তো ওপারে ‘অমর একুশে বইমেলা’। তেরো পার্বণের অন্যতম এই উৎসব, বিশেষ করে, বইপাগল বাঙালির একান্ত আপন। 
কলকাতা বইমেলার সুবর্ণ জয়ন্তী অদূরেই। এবার ৪৮ বর্ষ। প্রত্যেক বছর কোনও একটি দেশকে ‘ফোকাল থিম কান্ট্রি’ বেছে নিয়ে মেলা সেজে ওঠে। যেমন ২০২৫-এ জার্মানি, এবং তাদেরকে এই সম্মান প্রদান প্রথমবার। আমরা জানি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি পূর্ব ও পশ্চিম দুই ভাগে আলাদা হয়ে যায়। এমনকী সমৃদ্ধ পশ্চিম জার্মানিতে পূর্বাঞ্চলের অভিবাসীদের ‘অনুপ্রবেশ’ রুখতে ১৯৬১ সালে বার্লিনে তুলে দেওয়া হয় সুউচ্চ প্রাচীর! কিন্তু জার্মান জাতির সৌভাগ্য যে ওই মজবুত প্রাচীরও স্থায়ী হতে পারেনি। ১৯৮৯ সালে জার্মানরাই নিজেদের হাতে সোল্লাসে ওই প্রাচীর গুঁড়িয়ে দেয়। এমনকী একবছর পর দুই জার্মানি জুড়ে গিয়ে গঠিত হয় ফেডারেল রিপাবলিক অফ জার্মানি। 
অর্থাৎ একসময় ভেঙে গিয়েও জুড়ে গিয়েছে যে দেশ, সেই জার্মানিই আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা ২০২৫-এর ফোকাল থিম কান্ট্রি। অন্যদিকে, এবারের বইমেলায় অনুপস্থিত বাংলাদেশ! এই কাকতালীয় বৈপরীত্য অনেক পাঠককেই যে আহত করেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৯৯৬ সাল থেকে কলকাতা বইমেলায় বাংলাদেশের দুঃখজনক অনুপস্থিতি এই প্রথমবার। অথচ এতদিন এই সুবৃহৎ মেলায় ঢুকলেই দেখা যেত ‘বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন’, যেটা সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। ২০-২৫টি দেশের বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা তাদের গ্রন্থসম্ভার নিয়ে এখানে আসে। যেমন এবার থাকছে জার্মানি, আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইরান, রাশিয়া, স্পেন এবং আর্জেন্টিনা, পেরু, কোস্টারিকা-সহ লাতিন আমেরিকার অনেকগুলো দেশ। থাকছে দিল্লি, অসম, ত্রিপুরা, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, তামিলনাড়ু, গুজরাত, হরিয়ানা, ইউপি, মহারাষ্ট্রের কিছু স্টল। প্রতিবার দেশি-বিদেশি বইয়ের স্টলের সংখ্যা থাকে কমবেশি এক হাজার। কিন্তু তার মধ্যে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন এপার বাংলার অসংখ্য পাঠকের আবেগের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এই আবেগ কতখানি অন্তরের, বাংলাদেশের স্টলগুলোতে উপচে পড়া ভিড়েই মিলত তার প্রমাণ। অথচ এবার তারা নেই, যারা টানা ২৯ বার এপার বাংলার পাঠকের মন কেড়ে নিয়েছে। 
১৯৯৬ সালে প্রথম একটি প্যাভিলিয়ন নির্ধারিত হয় বাংলাদেশের জন্য। ১৯৯৯-এ বাংলাদেশ ‘ফোকাল থিম কান্ট্রি’ হওয়ার সুবাদে দুই বাংলার সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন আরও দৃঢ় হয়। বইমেলায় একটি দিন পালিত হয় ‘বাংলাদেশ দিবস’ হিসেবেও। ১৯৯৯-এ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন প্রধান অতিথি। মেলার উদ্বোধন করেন কবি শামসুর রাহমান। তারপর থেকে ২০২৪ পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে বাংলাদেশের উজ্জ্বল উপস্থিতি কলকাতা বইমেলাকে সমৃদ্ধ করেছে। পড়শি দেশটি ফোকাল থিম কান্ট্রি নির্বাচিত হওয়ার দুর্লভ সম্মান পেয়েছে দু’বার (১৯৯৯ ও ২০২২)।
রাজনৈতিক ভাবে না-হলেও আমরা অন্তর থেকে জুড়ে আছি। ভাষা, সংস্কৃতির সেতু আমাদের সুপ্রাচীন—মায়ের নাড়ির টান যেমন! আমরা কি সেটাই ছিন্ন করতে এত ব্যগ্র হলাম ভ্রান্ত রাজনীতির চক্করে পড়ে? ২০২৪-এ কলকাতা মেলায় প্রায় ২৩ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়। নানা বয়সি কমবেশি ২৭ লক্ষ বইপ্রেমী মানুষ মেলায় এসেছেন এবং কেনাকাটা করেছেন। এবার সেই রেকর্ড ছাপিয়েও যাবে 
হয়তো, কিন্তু অসম্পূর্ণতাও রয়ে যাবে একটি দগদগে ক্ষতের মতোই। 
বিশ্বজগৎ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে একান্ত আত্মোন্নতির সুযোগ আগেও ছিল না এবং এখনও নেই, বরং কমেছে। বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধির মধ্য দিয়েই বিশ্ব দেবতার অন্বেষণ সম্ভব বলে উপলব্ধি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ:
“বিশ্ব সাথে যোগে যেথায় বিহারো/ সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারো।/ নয়কো বনে নয় বিজনে/ নয়কো আমার আপন মনে/ সবার যেথায় আপন তুমি, সেথায় আপন আমারো।” 
তাঁর আরো উপলব্ধির কথা তিনি বিশ্ববাসীর সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন এইরকম: 
“সবচেয়ে দুর্গম যে-মানুষ আপন অন্তরালে,/ তার কোনো পরিমাপ নাই বাহিরের দেশে কালে।/ যে অন্তরময়/ অন্তর মিশালে তবে তার অন্তরের পরিচয়।”
রবীন্দ্রনাথ নতুন কোন কথা বলেননি বস্তুত এটাই ভারতের অন্তরাত্মার বাণী। তবু আমরা এই উপমহাদেশের লোকজন, বিশেষত বাঙালিরা তাঁর কথা কতটা কাজে লাগিয়েছি? লাগাতে পারিনি বলেই বাংলাদেশের শ্রদ্ধেয় কবি শামসুর রাহমানকে একসময় আক্ষেপ করতে হয়েছিল: 
“বাঁধতে পারি নি কোনো সাঁকো,/ অথচ আমার আশেপাশে/
সাঁকো নেই বলে আমি মূক হয়ে থাকি,/ নিজেকেই প্রিয়-সম্ভাষণে করি প্রীত, নিজের হাতেই/ হাত রাখি। কিন্তু শুধু আয়নায় নিজের মুখ দেখে/ নিজের সঙ্গেই মেতে কথোপকথনে/ নিজেকে আদর করে চাদরে সর্বাঙ্গ ঢেকে সকল সময়/ থাকা দায়। অন্য কারো হাত/ ছোঁয়া চাই, সোনা চাই অন্য কারো স্বর—/ মানে সাঁকো থাকা চাই। ... নিপুণ বাঁধতে গিয়ে সাঁকো তবু আমি/ ব্যর্থ হয়ে যাই,/ বারবার ব্যর্থ হয়ে যাই ...” 
এই ব্যর্থতা কেন সে কি বিশদে বলার প্রয়োজন আর পড়ে?
সৌহার্দ্যের পরিবেশ, আগামীতে সমস্ত কল্পনাকে অতিক্রম করবে বলেই আমরা মনে করেছি। সেই সম্ভাবনার অঙ্কুর বিনষ্ট হয়নি। আবার আলো বাতাস জল পুষ্টি দিয়ে তাকে বাঁচাতেই হবে। আমরা প্রত্যাশায় থাকব, পরবর্তী বইমেলায় বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নের মর্যাদার প্রত্যাবর্তনই ঘটবে।
1d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পদার্থ ও রসায়নিক বিদ্যার অনুশীলনে বিশেষ উন্নতি।প্রায় সম্পূর্ণ কাজে বাধা আসতে পারে। বিকেল থেকে মানসিক...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৫.৭৮ টাকা৮৭.৫২ টাকা
পাউন্ড১০৫.৯৮ টাকা১০৯.৭২ টাকা
ইউরো৮৮.৭৪ টাকা৯২.১১ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা