নিছক মজার ছলেই একবার কানাডা দখলের কথা বলেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। পানামা খালও ফেরত চেয়েছেন তিনি। আর এবার তাঁর নজর পড়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় দ্বীপ গ্রিনল্যান্ডের উপরও। ফিনান্সিয়াল টাইমসের তথ্য অনুযায়ী, দাম উঠেছে এক ট্রিলিয়ন ডলার অর্থাৎ এক লাখ কোটি ডলার।
যে ভাবেই হোক গ্রিনল্যান্ডের উপর আমেরিকার ‘দখল’ চাই! সাফ জানিয়ে দিয়েছেন ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেনকে। প্রায় ৪৫ মিনিটের ফোনালাপে এক রাষ্ট্রনেতা নাকি ‘কড়া বার্তা’ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন অপর রাষ্ট্রনেতাকে! সংবাদসংস্থা ‘দ্য ফিনান্সিয়াল টাইমস’-কে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আধিকারিকরা বলেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা বলার ধরন ছিল ‘ভয়ঙ্কর’। রীতিমতো ‘হম্বিতম্বি’ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট! গ্রিনল্যান্ড কেনার জন্য ট্রাম্প যে মরিয়া মনোভাব দেখিয়েছেন তাতে হতভম্ব ন্যাটো সঙ্গীরাও। গ্রিনল্যান্ড বিক্রি না করলে মিলিটারি পাওয়ারের মাধ্যমে তা দখলের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেননি তিনি। যা দেখে ট্রাম্পকে সতর্ক করেছে জার্মানি ও ফ্রান্স।
নাম গ্রিনল্যান্ড হলেও দেখা মেলে না এক ফোঁটা সবুজের। এখানকার ৮৫ শতাংশ এলাকা তুষারে ঢাকা। ২১ কোটি ৬৬ লক্ষ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এই দ্বীপটির অধিবাসীর সংখ্যা মাত্র ৫৭ হাজারের কাছাকাছি। গ্রিনল্যান্ড উত্তর আমেরিকা মহাদেশের একটি অংশ হলেও ভূ-রাজনৈতিক ভাবে সেটি ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। গ্রিনল্যান্ডের বাসিন্দারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের নাগরিক হিসাবে গণ্য হন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে টাকাও আসে গ্রিনল্যান্ডে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই গ্রিনল্যান্ডে রয়েছে মার্কিন সেনা ঘাঁটি। ওই যুদ্ধে জার্মানির নাৎসি বাহিনী ডেনমার্ক দখলের পর গ্রিনল্যান্ডের দখল নেয় আমেরিকা। ১৯৪৫ সালে তা ডেনমার্ককে ফিরিয়েও দিয়েছিল। তবে আর্কটিক অঞ্চলে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব কমাতে ১৯৪৬ সালে আবার ডেনমার্কের থেকে গ্রিনল্যান্ড কিনতে চেয়েছিল আমেরিকা। সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল ডেনমার্ক। আমেরিকাও এই বিষয়ে আর উচ্চবাচ্য করেনি। তবে, সেখানে মিলিটারি বেস তৈরি এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ১৯৫১ সালে ডেনমার্কের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছিল আমেরিকা। তখন থেকেই ড্যানিশ সেনার পাশাপাশি মার্কিন মিলিটারি বেস রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম আইল্যান্ডে। মার্কিন এয়ারফোর্স স্পেস কমান্ড ও নর্থ আমেরিকান অ্যারোস্পেস ডিফেন্স কমান্ডও সামরিক ঘাঁটিটি ব্যবহার করে থাকে।
গ্রিনল্যান্ড এখন সরাসরি ডেনমার্ক সরকারের অধীন। বাসিন্দারা ডেনমার্কের নাগরিক। তবে স্বশাসনের অধিকার ভোগ করেন। গ্রিনল্যান্ডের নিজস্ব পার্লামেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী থাকলেও, কোনও বিদেশনীতি নেই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বরফে ঢাকা সেই গ্রিনল্যান্ডকেই আমেরিকার অন্তর্ভূক্ত করতে চাইছেন। অবশ্য এই প্রথমবার নয়। গ্রিনল্যান্ডকে নিজেদের আওতার আনার ‘আমেরিকান ড্রিম’ বেশ পুরনো। পরিকল্পনা ছিল ২০১৬ সাল থেকেই। সেই সময় থেকে গ্রিনল্যান্ড নিয়ে ট্রাম্পেরও আগ্রহ শুরু হয়। বরফে ঢাকা দ্বীপে অবতরণ করে নীল রঙের ট্রাম্প লেখা পেল্লায় বিমান। সওয়ারির নাম ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র। গ্রিনল্যান্ডকে মহান বানিয়ে ফানুস ওড়ানোর শুরুটা সেই সময়ই। ২০১৯ সালে ট্রাম্প প্রথমবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ডেনমার্ক ও গ্রিনল্যান্ড— দুই দেশকেই অফার দিয়েছিলেন। দুই দেশই সেই প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছিল। সেই সময় ট্রাম্প বিষয়টি নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করেননি। কিন্তু এখন কেন এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠলেন?
২০১৯ সালেই ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, গ্রিনল্যান্ডের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতার কারণে তিনি ওই অঞ্চল কিনতে চান। তাঁর সেই ইচ্ছে শুনে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন গ্রিনল্যান্ড এবং ডেনমার্কের নেতারা। ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেন বলেছিলেন, ‘গ্রিনল্যান্ডকে কোনও ভাবেই বিক্রি করা হবে না।’ গ্রিনল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিম উপকূলে আমেরিকার মহাকাশ বাহিনীর ঘাঁটি পিটুফিক স্পেসবেস (আগে থুলে এয়ারবেস নামে পরিচিত ছিল) রয়েছে। রয়্যাল ড্যানিশ ডিফেন্স কলেজের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর মার্ক জ্যাকবসেন বলেছেন, ‘রাশিয়া যদি আমেরিকায় নিউক্লিয়ার মিসাইল হামলা করতে চায়, তবে সবথেকে শর্ট রুট হবে উত্তর মেরু ও গ্রিনল্যান্ডের উপর দিয়ে। তাই মার্কিন প্রতিরক্ষার জন্য গ্রিনল্যান্ডের পিটুফিক স্পেস বেস খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’ আর তার জন্যও গ্রিনল্যান্ডের দখল আমেরিকা নিজেদের হাতে রাখতে চায় বলে ধারণা।
নিজের সমাজমাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ ট্রাম্প লিখেছেন, ‘সারা বিশ্বের নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতার স্বার্থে আমেরিকা মনে করে যে, গ্রিনল্যান্ডের মালিকানা এবং নিয়ন্ত্রণ এই মুহূর্তে অত্যাবশ্যক।’ ডিজিটাল লেনদেন সংস্থা পেপ্যালের সহ-প্রতিষ্ঠাতা কেন হাওয়ারিকে ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত হিসাবে ঘোষণা করার সময় এই বিবৃতি দেন ৭৮ বছর বয়সি রিপাবলিকান নেতা। যদিও ট্রাম্পের বিবৃতির পর গ্রিনল্যান্ড স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে, তারা বিক্রি হতে রাজি নয়। গ্রিনল্যান্ডের দখল নিয়ে ট্রাম্পের নতুন মন্তব্যের পর গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মিউট এগেডে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘আমরা বিক্রি হচ্ছি না এবং আমরা বিক্রি হবও না। স্বাধীনতার জন্য আমাদের দীর্ঘ সংগ্রাম ভোলার নয়। তবে অবশ্যই আমাদের সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে, বিশেষ করে আমাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে সহযোগিতা এবং বাণিজ্যের রাস্তা খোলা রাখতে হবে।’
এরপরও কেন এই দ্বীপের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে আমেরিকা?
গ্রিনল্যান্ড পৃথিবীর এমন একটি দেশ যার অধিকাংশ এলাকা বরফে ঢাকা এবং এর বিশাল অংশ এখনও অনাবিষ্কৃত। কিন্তু সেখানে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে দুর্লভ খনিজ পদার্থ এবং খনিজ তেল। ২০২৩ সালে ডেনমার্ক সরকারের একটি রিপোর্টে খনিজ উত্তোলনের সম্ভাবনার বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। কপার, আয়রন, কোবাল্ট, নিকেল, লিথিয়ামের মতো খনিজে ঠাসা এই বরফাবৃত এলাকা। ডিসপ্রোসিয়াম, নিওডিয়ামিনিয়াম আর টারবিয়ামের মতো অপ্রচলিত খনিজের (আর্থ মিনারেল) বৃহৎ মজুত রয়েছে। বিশ্বের ৩৪টি অপ্রচলিত খনিজের মধ্যে গ্রিনল্যান্ডেই রয়েছে প্রায় ২৩টি। উইন্ড টার্বাইন হোক বা ইভি-র ব্যাটারি বা ইলেকট্রনিক্স প্রোডাক্ট— ভবিষ্যতের দুনিয়ায় এই সমস্ত খনিজের চাহিদা থাকবে তুঙ্গে। এই খনিজের দখল রাখা গেলে আগামী দিনে প্রযুক্তির লড়াইয়ে কয়েক যোজন এগিয়ে থাকা যাবে। ডেনমার্কের বিদেশমন্ত্রী রাসমুসেনও মনে করেন গ্রিনল্যান্ডের উপর মার্কিন আগ্রহের যৌক্তিকতা রয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘গ্রিনল্যান্ডে আমেরিকার ইন্টারেস্ট লেজিটিমেট। আমরা দেখছি এই এলাকা নিয়ে রাশিয়া ও চীনেরও আগ্রহ বাড়ছে।’ তাছাড়া জলবায়ুর পরিবর্তনে গ্রিনল্যান্ডের বরফ হু হু করে গলছে। এর জেরে মাইনিং বা খননের পরিস্থিতি অনুকূল হচ্ছে। শক্তিধর দেশগুলির নজর তাই পৃথিবীর উত্তরতম প্রান্তে। ভবিষ্যতের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কনফ্লিক্ট জোন হয়ে ওঠার পোটেনশিয়াল রয়েছে।
আসলে গ্রিনল্যান্ডে ব্যাপকভাবে ফুটপ্রিন্ট তৈরি করে ফেলেছে বেজিং। চীনা কোম্পানিগুলি সেখানে খনিজ সম্পদের অনুসন্ধান, খনন ও প্রক্রিয়াকরণে সক্রিয়ভাবে জড়িত। গ্রিনল্যান্ডের খনিজ শিল্পে বিনিয়োগের ১১ শতাংশ বর্তমানে চীনের হাতে রয়েছে। গ্রিনল্যান্ডের খনিজ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এ ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার পরই চীনের অবস্থান। ২০১৮ সালে নিজেদের আর্কটিক নীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে বেজিং। তাতে বলা হয়েছে, এশিয়া ও ইউরোপে উচ্চাভিলাষী ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে ‘পোলার সিল্ক রোড’ বানানোর পরিকল্পনা রয়েছে চীনের। এই বিষয়ে প্রাক্তন মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা রবার্ট সি ও’ব্রায়েন বলেছেন, ‘ভবিষ্যতে আর্কটিকের স্ট্র্যাটেজিক ইমপর্ট্যান্স বাড়বে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বাণিজ্যপথ হয়ে উঠবে ওই এলাকা।’ বরফ যত গলবে পশ্চিম ইউরোপ এবং আমেরিকার পূর্ব উপকূল থেকে পূর্ব এশিয়া আসার রুটের ব্যস্ততাও তত বাড়বে। এই সব কারণেই বিশ্বের বৃহত্তম আইল্যান্ডের মালিকানা পাওয়া এবং সেখানে নিয়ন্ত্রণ কব্জা করা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষায় ‘অ্যাবসিলিউট নেসেসিটি’! আমেরিকার সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক এবং রাশিয়ার সামরিক প্রভাবের দ্বন্দ্ব কত দূর বিস্তৃত, তার কিছুটা আঁচ পাওয়া যায় এতেই।
শত বছর আগের ইতিহাসে ‘দেশ কেনাবেচার’ এমন উদাহরণ ছিল। আমেরিকা নিজেই ঊনবিংশ শতকে ফ্রান্স থেকে লুইজিয়ানা, স্পেন থেকে ফ্লোরিডা আর রাশিয়া থেকে আলাস্কা কিনে নিয়েছিল। অবিশ্বাস্য মূল্যে এসব ক্রয় আমেরিকাকে কীভাবে লাভবান করেছে, তার একটি উদাহরণ আলাস্কা। ১৮৬৭ সালে রাশিয়ার কাছ থেকে প্রায় ছয় লাখ বর্গকিলোমিটারের আলাস্কা কিনেছিল মাত্র ৭.২ মিলিয়ন ডলারে, বর্তমান অঙ্কে যা ১২৫ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। অথচ এই আলাস্কাতে মজুত খনিজ তেলই রয়েছে ২০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের।
প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জনসনের জমানায় প্রথম গ্রিনল্যান্ড কেনার কথা ভাবা হয় ১৮৬০ সালের দিকে। ১৯৪৬ সালে ১০০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে গ্রিনল্যান্ড কেনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন হ্যারি ট্রুম্যান। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ডিকলোনাইজেশনের যুগে এ কথা আর মুখে তোলেননি কেউ। আর আজ? ড্যানিশ ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের প্রবীণ গবেষক উলরিক গাদের কথায়, চীনের প্রেসিডেন্ট জি জিনপিং যেভাবে তাইওয়ান নিয়ে কথা বলেন এবং রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন যেমন ইউক্রেন নিয়ে কথা বলেন, একই সুরে গ্রিনল্যান্ড নিয়ে কথা বলছেন ট্রাম্প। এটাই অবাক করেছে গোটা দুনিয়াকে!