পরামর্শে পার্কসার্কাসের ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথের অধ্যক্ষ ডাঃ জয়দেব রায়।
শীতকালে পরিবেশ যেমন খুব মনোরম থাকে, তেমনই বাচ্চারা বেশ কিছু সাধারণ অসুখ নিয়েও চেম্বারে হাজির হন। দেখা যাক সেগুলি কী কী—
কাশি: এই সময় পরিবেশে ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ বাড়তে দেখা যায়। ফলে বাচ্চারা কাশতে থাকে। কাশি হলেই অভিভাবকরা বাচ্চাকে কাফ সিরাপ দিয়ে থাকেন।
এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি— জ্বর যেমন একটি রোগের উপসর্গ, তেমনই কাশিও উপসর্গ। তাই কাফ সিরাপ খাওয়ালেই যে কাশির উপশম হবে একথা ঠিক নয়। অসুখটির সঠিক চিকিৎসা করতে হবে।
দেখুন, কাফ সিরাপ বিভিন্ন ধরনের হয়। এই কারণেই ইচ্ছেমতো কাফ সিরাপ শিশুকে দেওয়া যায় না। ধরা যাক কোনও বাচ্চার শুকনো কাশি হচ্ছে, সেক্ষেত্রে একধরনের কাফ সিরাপ দিতে হবে। আবার কোনও বাচ্চার কাশি অ্যালার্জির কারণে হচ্ছে— এমন ক্ষেত্রে তাকে দিতে হবে অন্য ধরনের কাফ সিরাপ।
কোনও বাচ্চার কাশি হচ্ছে হয়তো ব্রঙ্কোস্প্যাজমের কারণে। এমন ক্ষেত্রে নির্বাচন করতে হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের কাফ সিরাপ।
নাকের ড্রপ: শীতের সময় যখন নাক বন্ধ থাকে, অনেকেই অযথা বিভিন্ন ধরনের নাকের ড্রপ শিশুকে দেন। নাকের ড্রপ ব্যবহার করতে হলে চেষ্টা করুন স্যালাইন ড্রপ ব্যবহারের। অন্য যে সকল ড্রপ থাকে তা অল্প কিছুদিন ব্যবহার করতে পারেন। খুব বেশিদিন ব্যবহার করলে ওই ড্রপের কার্যকারিতা সঠিকভাবে বজায় থাকে না।
সর্দি, কাশি এবং অ্যান্টিবায়োটিক: বাচ্চার সর্দি, কাশি হলে অনেকসময় বাড়িতে মা-বাবা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে থাকেন। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এই সময় অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো উচিত নয়।
বেশিরভাগ ভাইরাল ইনফেকশনে অ্যান্টিবায়োটিক লাগে না। শুধু ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন হলে একমাত্র অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হতে পারে। যথেচ্ছ অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারে দেখা দিতে পারে রেজিস্ট্যান্স। এর ফলে পরবর্তীকালে ওই অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হলেও তা সঠিকভাবে কাজ করবে না।
মনে রাখবেন, অপ্রয়োজনীয়ভাবে অত্যধিক অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারে গাট মাইক্রোফ্লোরা বা অন্ত্রে থাকা ভালো ব্যাকটেরিয়াও মারা পড়ে। এই ব্যাকটেরিয়াগুলি খাদ্য হজমে সাহায্য করে। একইসঙ্গে পরিপাকতন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করতেও সাহায্য করে।
তাই ডাক্তার না দেখিয়ে শীতকালে অপ্রয়োজনে বাচ্চাকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়াবেন না।
বরং গরম জলের ভেপার বা বাষ্প সাবধানতার সঙ্গে দিলে বাচ্চা নিতে পারে। তাতে কফ উঠে যেতে পারে।
জলপান: শীতকালে এমনিতেই বাচ্চারা জলপান পছন্দ করে না। তার ওপর শরীর খারাপ হয়ে গেলে খুদেরা জলপান আরও কমিয়ে দেয়। অথচ এই ঋতুতেই যথাযথভাবে জলপান করানো দরকার। এমনকী দরকার পড়লে ঈষদুষ্ণ জলও পান করানো যায়। এইভাবে ডিহাইড্রেশনের আশঙ্কা দূর করা যাবে।
ত্বকের খেয়াল: এই সময় শিশুর ত্বক ভালো রাখার জন্য বেবি ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা যেতে পারে। বেবি ময়েশ্চারাইজার স্নানের সময় বা শোওয়ার সময় মাখানো যায়।
খেলাধুলা: এই ঋতুতে আমরা বাড়ির লোকেদের বলি, শিশুকে খুব সকালের দিকে বাড়ির বাইরে বেরতে দেবেন না। তবে একটু দুপুর গড়ানোর পর খেলতে গেলে মন্দ হবে না। বরং শারীরিক কসরত চালু থাকলে শিশুরা সুস্থ থাকবে।
শীত পোশাক: এই যে জামাকাপড় পরানো হয় শিশুদের, এমন ক্ষেত্রে অবশ্যই মনে রাখবেন, পোশাক যেন নিয়মিত পরিষ্কার করা হয়। নানা সময়েই শীতকাল বলে শিশুর জামাকাপড় সঠিকভাবে পরিষ্কার করা হয় না। আর হ্যাঁ, ক্যালেন্ডার দেখে পোশাক পরাবেন না।
শীতে পরিবেশে রোজ একইরকম তাপমাত্রা থাকে না। কখনও তাপমাত্রা বেশি কমে যায়, কখনও বা বাড়ে। এখন শীতকাল বলে রোজই বাচ্চাকে মোটা গরম জামা পরিয়ে রাখলে চলবে কেন! তাই বাইরের পরিবেশের যেমন তাপমাত্রা, সেই অনুসারে তাকে পোশাক পরান। ভালো হয় দু’টো পাতলা পোশাক পরাতে পারলে। যাতে একটু গরম পড়লে একটা জামা খুলে দেওয়া যায়। তাতে শিশু আরাম পাবে। আর হ্যাঁ, কখনওই উলের গরম পোশাক সরাসরি বাচ্চাকে পরাবেন না। কারণ উলের পোশাক ত্বকের সরাসরি স্পর্শে এলে অ্যালার্জির কারণ হতে পারে।
শ্বাসকষ্ট: শীতকালে বহু বাচ্চাই শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকে। বিশেষ করে যাদের অ্যাজমা রয়েছে, তাদের এইসময় অ্যাজমার সমস্যা বেড়ে যাতে থাকে। এমন সমস্যায় ভুগছে বাচ্চাদের অভিভাবকদের বলব, ঘরবাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন।
বাড়িতে পোষ্য থাকলেও তার থেকে অ্যালার্জি হয়েও দেখা দিতে পারে শ্বাসকষ্ট। সেক্ষেত্রেও যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
এই শীতে শুধু অ্যালার্জেনই নয়, অন্যান্য বহু ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয় আমাদের নাক মুখ দিয়ে ঢোকে ও শরীর খারাপ করায়। তাই প্রয়োজনে মাস্ক ব্যবহার করুন। জন সমাগমের জায়গা এবং অতিরিক্ত ভিড়ের জায়গা এড়িয়ে চলাই উচিত। ঘরে আলোবাতাস ঢোকার ব্যবস্থাও রাখতে হবে। শীতে যে সমস্ত জিনিস আমরা ব্যবহার করি যেমন বালিশ, কাঁথা, তোষক— সেগুলি নিয়মিত দিতে হবে রোদে।
মনে রাখবেন পোশাক, বিছানার চাদর ও বালিশের তোশক নিয়মিত কাচা দরকার। তাতে ওই সমস্ত জিনিস থেকে অ্যালার্জেন দূর হবে ও অ্যালার্জেনজনিত অ্যাজমার কষ্ট কমবে।
ইনহেলার: অ্যাজমার জন্য কি ইনহেলার নিতে হচ্ছে শিশুকে? কোনও মতেই বন্ধ করা যাবে না। দুই ধরনের ইনহেলার রয়েছে— প্রিভেন্টার এবং রিলিভার। রিলিভার ইনহেলার ব্যবহার করা হয় যখন শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা বেশি হয়।
কয়েকদিন ব্যবহারের পর এই ইনহেলার হয়তো বন্ধ করা যায়, তবে প্রিভেন্টার ব্যবহার চালিয়ে যেতে হবে। এছাড়া এড়িয়ে চলতে হবে ধুলো, ফলের রেণু, ধূপের ধোঁয়া। কারণ এগুলিও অনেকের ক্ষেত্রে অ্যালার্জেন হিসেবে কাজ করে।
আর হ্যাঁ শ্বাসকষ্ট শুরু হলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে বাচ্চাকে নিয়ে যান। এখন বাচ্চার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তা বোঝা যাবে কীভাবে? বিশেষত যদি দেখা যায়, শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত হয়ে হচ্ছে, ইন্টারকস্টাল সাকশন হচ্ছে, বক্ষের নীচের দিকটা ভিতরের দিকে ঢুকে যাচ্ছে, শিশু একেবারেই খাবার খাচ্ছে না, নেতিয়ে পড়েছে, বাচ্চার জ্বর কিছুতেই কমছে না, ইউরিনের মাত্রা কমে গিয়েছে এমন হলে এই ধরনের বাচ্চাদের দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শমতো বিভিন্ন রোগ নির্ণায়ক পরীক্ষা করিয়ে মূল কারণ চিহ্নিত করে সেইভাবে চালাতে হবে চিকিৎসা।
ভ্যাকসিন: নিউমোনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো ভ্যাকসিনগুলি শীতকালে নিয়ে নেওয়া যায়। দরকার পড়লে চিকেন পক্স-এর মতো প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিনগুলিও নিয়ে নেওয়া দরকার।
অন্যান্য কিছু আবশ্যিক নিয়ম
খাদ্যাভ্যাস: প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য খাওয়ান শিশুকে। প্রোটিনজাতীয় খাদ্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে।
হাত ধোওয়া: প্রতিবার খেতে বসার আগে অভিভাবক ও শিশুর উচিত ভালো করে হাত ধুয়ে নেওয়া। এই সমস্ত নিয়মগুলি মানলেই শিশু সারা বছরই থাকবে সুরক্ষিত।
লিখেছেন সুপ্রিয় নায়েক