নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: শনিবার দুপুর দুটো। স্বাস্থ্যভবন লাগোয়া অবস্থান মঞ্চে বক্তব্য রেখে চলে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনের অন্যতম মুখ অনিকেত মাহাত বলেছিলেন, ‘মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর পদক্ষেপকে আমরা অত্যন্ত স্বাগত জানাই। আমরা এই মুহূর্তে ওঁর সঙ্গে আলোচনায় রাজি আছি।’ প্রশ্ন ওঠে, ‘আপনারা কি ‘লাইভ স্ট্রিমিং’ বা সরাসরি সম্প্রচার ছাড়া আলোচনা করবেন না?’ উত্তর এড়িয়ে যান অনিকেত। কিছুক্ষণ পরই একই প্রশ্ন করা হয়েছিল জুনিয়র ডাক্তারদের আর এক নেতা সৌরভ রায়কে। তিনিও গোঁ ছেড়ে সাফ জানান, ‘আমরা কোনও নেগেটিভ ভিউ পয়েন্ট নিয়ে যাব না।’ বোঝাই গিয়েছিল, অনড় অবস্থান থেকে সরে অনেকটাই খোলা মনে আলোচনার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা। তাহলে ২-৩ ঘণ্টার মধ্যে এমন কী হল? কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে বহুপ্রতীক্ষিত বৈঠক যখন শুরু হব হব করছে, ঠিক তখনই ফের ‘লাইভ স্ট্রিমিং’ নিয়ে জেদাজেদি কেন হল? প্রথমে ‘লাইভ স্ট্রিমিং’, তারপর ভিডিওগ্রাফি, শেষে যৌথ ‘মিনিটস’-এ দু’পক্ষের সই—এই নিয়েই কেটে গেল তিন ঘণ্টা। কেন এই সময় নষ্ট? কারা কলকাঠি নাড়ল? কয়েকজন আড়কাঠি? কিছু পাকা মাথার সুযোগসন্ধানী বহিরাগত রাজনৈতিক মুখ?
রাজ্য আইএমএ-র প্রথম সারির নেতা সৌরভ দত্ত সাফ জানাচ্ছেন, ‘এই আন্দোলনে বাইরের লোক নেই। সে অর্থে ওদের কোনও নেতা নেই। সিপিএম, এসইউসি, নকশালপন্থী সিপিআইএমএল রেডস্টার, পিডিএসএফ, তৃণমূল সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের ছাত্রছাত্রীরা রয়েছে। তার পাশাপাশি প্রচুর অরাজনৈতিক লোকজনও রয়েছে।’ সূত্র বলছে, আন্দোলনের নেতৃত্বের রাশ এখন অনেকটাই এসইউসির ছাত্র সংগঠন এআইডিএসও-র হাতে। কিন্তু তাঁরা তো লাইভ স্ট্রিমিংয়ের দাবি থেকে সরে এসেছিলেন। তাহলে কারা বাগড়া দিল মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে? এসইউসি সমর্থিত চিকিৎসক সংগঠন মেডিক্যাল সার্ভিস সেন্টারের রাজ্য সম্পাদক ডাঃ বিপ্লব চন্দ্র বলেন, ‘দেখুন, আমাদের সংগঠনের সমর্থকরাই তো সবটা নয়। ভিন্ন মতও আছে।’ ধর্নামঞ্চে রোজ ঘোরাঘুরি করছেন সিপিএমের নেতা-কর্মীরা।
আন্দোলন শুরুর পর থেকে বিভিন্ন জিবি বৈঠকে আদর্শগত অবস্থান নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তর্কাতর্কি হয়েছে জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে। নকশালপন্থীরা বারবার বেঁকে বসেছেন। অন্যদিকে অনিকেত মাহাতর মতো কয়েকজন বরাবরই আলাপ আলোচনার পথ খোলা রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। এই পরিস্থিতিতে শনিবার কালীঘাটে ঝাঁঝালো বক্তব্য রাখতে দেখা গিয়েছে দেবাশীষ হালদারের মতো জুনিয়র ডাক্তার নেতাকে। রাজনৈতিক মহলের দাবি, তিনি পিডিএসএফ সদস্য। সৌতাজ বিশ্বাস নামে সোশ্যাল মিডিয়ায় দ্বিতীয় একটি অ্যাকাউন্টও রয়েছে তাঁর। মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনের বাইরে দাঁড়িয়েই ফেসবুকে তিনি পোস্ট করে গিয়েছেন, ‘কালীঘাটের ময়না যতক্ষণ না নবান্ন ছাড়ছে, ততক্ষণ আমাদের ৩০ জনও এখানেই অবস্থান করবে’, ‘চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য আর মুখ্যসচিব ডাক্তারদের সাথে দুর্ব্যবহার করে একপ্রকার ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলেন।’ কিন্তু এমন কোনও ঘাড়ধাক্কার ঘটনাই ঘটেনি বলে দাবি আন্দোলনকারীদের একাংশের। এ প্রসঙ্গে ডাঃ মাহাত অবশ্য বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়ায় বক্তব্য না দেখে মন্তব্য করব না।’
এই পরিস্থিতিতে রবিবার কালীঘাটে ‘দিদির দরবার’ বসে। এদিন চার রোগীর পরিজন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ জানান, সরকারি হাসপাতালে গিয়েছিলাম, অপারেশন হয়নি। বেসরকারি হাসপাতালে ৮-১০ লক্ষ টাকা বিল দিতে ঘটি-বাটি বিক্রির জোগাড়। এতেই প্রশ্ন উঠছে, তবে কি নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছেন কিছু কর্পোরেট চিকিৎসক? বিশিষ্ট হার্ট সার্জেন ডাঃ কুণাল সরকারের অবশ্য সাফ জবাব, ‘এ ধরনের অভিযোগে বিষয়টা আরও জটিল হয়। যত দ্রুত সমাধানসূত্র বের হয়, ততই মঙ্গল।’ এদিন পুলিসের পক্ষ থেকেও সিনিয়র ডাক্তারদের মাধ্যমে বার্তা দেওয়া হয়েছে, আন্দোলনকারীরা যদি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসতে চান, তাহলে সেই বার্তা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হবে। এদিন বিকেলে সল্টলেকে মহামিছিল আয়োজন করে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্ট’। তার জেরে যানজটে আটকে দুর্ভোগের শিকার হন বহু মানুষ।