আমরা মেয়েরা

মেয়েদের ফুটবলে ফিটনেসের জাদুকর

অশোকনগর কলকাতা থেকে কিছু দূরে বটে, তবে ভারতের মহিলা ফুটবল দলে সুস্থ থাকার চাবিকাঠি সেখানে থেকেই নিজের হাতে সামলেছেন পৌলমী ঘোষ। কীভাবে এলেন এই কাজে? ভবিষ্যৎ ভাবনাই বা কী? লিখছেন মনীষা মুখোপাধ্যায়।
 
জ ভোর ৫.০৪-এর ট্রেনে শহরে আসে অঞ্জু। সুদূর নৈহাটি থেকে শিয়ালদহে পৌঁছে তারপর ফের ধর্মতলা ক্লাব হাউসের টেন্ট। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা নিয়মের নড়চড় নেই। বাঁ পায়ে ভালো কাজ আছে অঞ্জুর। গতি আর থ্রো-এ আর একটু যত্ন নিলেই ফিনিশিং ভালো হতে বাধ্য। রোজ সেই ফিনিশিংয়ের খোঁজেই অন্ধকার থাকতে উঠে শহরে আসে সে। বাড়িতে তার ফুটবল খেলার কথা শুধু বাবা-মা জানে। পাড়া-প্রতিবেশীরা যাতে বিশেষ বুঝতে না পারে, সেই শঙ্কা থেকেই প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড হিসেবে বেছে নিয়েছে কলকাতাকে। অঞ্জুর স্বপ্ন তার থ্রো-এ করা গোলে একদিন অলিম্পিকে সোনা পাবে ভারত! করিমগঞ্জের মুসকানের গল্পটা আবার একটু আলাদা। তাকে কলকাতা ছাড়তে হয়েছিল ফুটবল খেলার অসুখের জন্য। তার চারপাশে মেয়েদের বিয়ে হয় বয়স ১৭-১৮ হলেই। বয়স লুকিয়ে আরও কম বয়সে বিয়ে দেওয়ার ঘটনা গোপনীয় হলেও মিথ্যে নয়। এমন পরিবেশে দাদাদের দেখে ফুটবল খেলার সাধ হয়েছিল মুসকানের। মেজদা বোনের ইচ্ছে শুনে কলকাতায় রেখে খেলা শিখতে সাহায্য করছিলেন। ভর্তি করে দিয়েছিলেন কলকাতার কলেজে। বাদ সাধল বাবার জেনে ফেলা! প্রায় ঘাড় ধরে মেয়েকে গ্রামে ফিরিয়ে আনলেন। পুরুষালি খেলা খেলার অপরাধে তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। মুসকান ফুটবল ছেড়ে দিয়েছে। তবে ফুটবল ওকে এখনও ছাড়তে চায় না। নিজের তিন বছরের ছেলেকে এ যাবৎ শুধু ফুটবলই কিনে দেয় তার খেলাপাগল মা!
এই-ই আমাদের চারপাশ। এমন এক সমাজ, যেখানে ‘ধন্যি মেয়ে’ সিনেমাটা খুব হিট। তার চেয়েও হিট সেই সিনেমার ‘সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল’ গানটি। কিন্তু বাস্তবে ফুটবল ভালোবাসা ধন্যি মেয়ে-দের ধন্য ধন্য করার লোকের বড় অভাব। বরং পায়ের জোর, গায়ের জোর আর গতিশক্তি বাড়িয়ে যে মেয়ে ফুটবল খেলতে চায়, তার সেই ইচ্ছের আগুনে জল ঢেলে দেয় তারই ঘনিষ্ঠ পরিবার। এমন সব মেয়ের কথাই ভাবতে চেয়েছিলেন অশোকনগরের ডঃ পৌলমী ঘোষ। কোন পথে এগলে পায়ের জোর বাড়বে, কোন মেয়ের ফিটনেসে কোথায় খামতি, কেন বিপক্ষের ট্যাকল সহ্য করতে না পেরে বারবার কাউকে মাঠ ছাড়তে হচ্ছে সেসব খুঁটিনাটি ভালোবেসে শিখতে চেয়েছিলেন পৌলমী। একেবারে প্রথাগতভাবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে। তাই অর্থনীতিতে স্নাতক হওয়ার পরেও উচ্চশিক্ষায় বেছে নিয়েছিলেন ফিজিক্যাল এডুকেশনকে। বিশেষ পত্রে বেছেছিলেন মহিলা ফুটবলারদের ফিটনেস সংক্রান্ত খুঁটিনাটি। ছেলেবেলায় বাবা অশোককুমার ঘোষের সঙ্গে মাঠে যাওয়া শুরু পৌলমীর। শান্ত হয়ে পুতুল খেলার চেয়ে মাঠে গিয়ে দাপাদাপিই তাঁকে টানত বেশি। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সদস্য হওয়ার দরুণ বাবা-দাদুর কাছ থেকেও মিলত অবিশ্রান্ত উৎসাহ। জীবনের পাঠকে তাই পঠনপাঠনে মেলালেন পৌলমী। 
প্রথম চাকরি একটি সরকারি উচ্চ-মাধ্যমিক স্কুলে। তবে শুধু ‘টিচার’ হয়ে চাকরি করেই দিনাতিপাত করতে চাননি পৌলোমী। নিজের পছন্দের বিষয়ে নিরন্তর পড়াশোনা ও খোঁজখবর নিয়ে তৈরি করছিলেন ভারতীয় মহিলা ফুটবল-এর থিসিস পেপার। বিষয়: মহিলা ফুটবলে ফিটনেস। তাঁর পিএইচডি শেষ হওয়ার আগেই সেই পেপার শুনে চমকে যায় অল ইন্ডিয়া ফুটফল ফেডারেশন। ভারতীয় মহিলা দলের সঙ্গে ফিটনেস অ্যানালাইজার হিসেবে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পান পৌলমী। জাতীয় দলের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন একটানা চার-পাঁচ বছর। সেখানেই মহিলা ফুটবলের সমস্যা, ভালো-মন্দ সব খতিয়ে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন সরেজমিনে। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই নিজের মতো করে কিছু অবদান রাখতে চান ভারতীয় মহিলা ফুটবলে। কথা হচ্ছিল, কেন ভারতের মেয়েরা ফুটবলে সেভাবে দাগ কাটতে পারছে না, তাই নিয়ে। পৌলমীর সোজাসাপটা জবাব, ‘স্ট্রেংথ ও স্পিডই ফারাক করে দিচ্ছে বিদেশি দলের সঙ্গে।’ ব্যাখ্যাও দিলেন তিনি। ‘ভারতীয় মেয়েদের মধ্যে মণিপুর বরাবরই ফুটবল ও অন্যান্য খেলায় ভালো ফল করে। তার কারণ ওঁদের পরিবেশগত স্ট্রাগল। জন্মের পর থেকে বেঁচে থাকার পাঠে পাহাড়ি অঞ্চল ওঁদের যে শক্তির জোগান দেয়, আমাদের রাজ্যে তার অভাব আছে। সঙ্গে অভাব পরিকাঠামোর উপযুক্ত ব্যবহার ও সদিচ্ছার। বহু ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরিকাঠামো স্রেফ পড়ে পড়ে নষ্ট হয়। মেয়েদের নিজস্ব কিছু সমস্যাও রয়েছে। কারও বাড়িতে ফুটবল ছাড়িয়ে বিয়ে দেওয়ার তোড়জোর চলছে, কোথাও আবার বাড়ি থেকে বিশেষ কোনও সমর্থন নেই। কারও আবার সম্পর্কজনিত জটিলতা আছে। ফুটবল দলগত খেলা। সেখানে দলের মধ্যে ভালো বোঝাপড়া না থাকলে তার প্রভাব খেলায় পড়তে বাধ্য। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, মেয়েরা ব্যক্তিগত প্রেম-অপ্রেম নিয়ে এত ইমোশনাল, তার প্রভাব এসে পড়ছে খেলার মাঠে। আরও একটি সমস্যা হয়। খুব কড়া অনুশাসনে থাকতে থাকতে সামান্য ছাড় পেলেই মেয়েরা উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়তে পারে। বয়সও কম থাকে। ভালো-মন্দ সবসময় যে বুঝে উঠতে পারে, এমন নয়! তার মধ্যেও দু’-একজন  থাকে, যাঁরা শুধু ফুটবল ভালোবাসে, খুব কড়া নিয়মে থেকেও খুব একটা উচ্ছৃঙ্খল হয় না। তাছাড়া আমাদের দেশের মেয়েদের নানা পরিবেশে গিয়ে মানিয়ে নেওয়া এবং সহ্য করার ক্ষমতা অন্য দেশের মেয়েদের চেয়ে বেশি। বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চলের মেয়েরা এক্ষেত্রে আরও পারদর্শী।’ 
তাই মেয়েদের ফিটনেসের খামতি ঢাকার রূপরেখা কী হবে, দেশ-বিদেশের বহু মাঠে তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন পৌলমী। তাঁর কথাতেই তৈরি হয়েছে এক এক জনের জন্য এক এক রকম ডায়েট। কার কেমন প্রশিক্ষণ হবে তা নির্ধারণ করা। গতি ও শক্তি বাড়ানোর লড়াইয়ে তিনি চেয়েছিলেন ভারতীয় মেয়েরা হয়ে উঠুক ইংল্যান্ড বা জাপান-সম। স্ট্রেংথের হাত ধরেই বাড়ুক থ্রো, পাস, ড্রিবল সামলানোর ক্ষমতা বা ট্যাকল করার কৌশল। তবেই দলগত খেলায় সেই উন্নতির ছাপ পড়বে। নিজের এলাকা অশোকনগরেও নিজ উদ্যোগে মেয়েদের ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করেছেন পৌলমী। পাশে দাঁড়িয়েছেন অশোকনগর স্টেডিয়ামের কর্মকর্তারা। সম্প্রতি মেয়েদের ফুটবলের উপর একটি বইও লিখেছেন পৌলমী। ‘ভারতীয় নারী ফুটবল মাঠে’, প্রকাশনায় অহর্নিশ। 
মেয়েদের পারিবারিক বাধা ও সামাজিক বাধাও একটা বড় সমস্যা বলে মনে করেন পৌলমী। ‘এমন বহু পরিবার আছে যেখানে ধরেই নেওয়া হয়, একে মেয়ে, তায় আবার ফুটবল, কী হবে খেলে? ফুটবল খেলেও যে চাকরি পাওয়া যায়, দেশের হয়ে খেললে যে টাকার অভাব হয় না এই বোধ এখনও আমাদের ঘরে ঘরে পৌঁছয়নি। তাই মেয়েরা খেলছে জানলে এখনও প্রত্যন্ত অঞ্চল এমনকী শহুরে বহু রক্ষণশীল পরিবারে দেখেছি আপত্তি তৈরি হয়। মেয়েটি মার পর্যন্ত খায়। জোর করে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা তো আকছার ঘটে।’ কথাগুলো ভাগ করার সময়ই আক্ষেপ ঝরে পড়ছিল পৌলমীর গলায়। যে দিদিমণি নিজে এত ফুটবল ভালোবাসে, খেলাটা বোঝে, সে নিজে কখনও চায়নি নিজের ছাত্রীরা ফুটবল খেলুক?
ফোনের ওপ্রান্তে দীর্ঘশ্বাস পড়ার জন্য সামান্য অপেক্ষা। তারপরেই মুখর পৌলমী। ‘কী জানেন, আমার সঙ্গে যখন তাদের দেখা হয়, বেশিরভাগেরই তখন বিয়ের বয়স হয়েছে। বাড়ি থেকে আর নতুন করে ফুটবল শুরু করতে দিচ্ছে না, তারা বিএড পড়ছে চাকরি পাওয়ার জন্য। খেলাধুলো ভালোবাসে হয়তো মন থেকেই। খোঁজখবরও রাখে। কিন্তু নিজে খেলা শুরু করার সেই সাহস ও তাগিদ এই বয়সে 
এসে আর পায় না। তার মধ্যেই এক-আধজনকে পাই যারা খেলে। তাদের উৎসাহ দিই, ফিটনেস বাড়াতে সাহায্য করি সাধ্যমতো!’
সাহায্যের সেই স্বপ্ন নিয়েই আগামী ডিসেম্বরে বনগাঁ থেকে দমদম অঞ্চল ও অশোকনগর নিকটবর্তী আরও কিছু অঞ্চলে যেসব মেয়ে ফুটবল খেলেন, তাঁদের ফিটনেস ক্যাম্প আয়োজন করতে চলেছেন পৌলমী। ভালো ফিটনেস আছে এমন কিছু মেয়েকে যাতে আরও উন্নত জায়গায় পৌঁছে দেওয়া যায় সেই ব্যবস্থাও করার চেষ্টা জারি থাকবে এই ক্যাম্পে। তাই নামী কিছু প্রতিষ্ঠানকে এই ক্যাম্পে আমন্ত্রণ জানানোর ইচ্ছেও আছে পৌলমীর। 
ড্রিবল, ট্যাকল, পায়ের ছন্দ আর অধ্যবসায় এই চার ম্যাজিকের সঙ্গে অশোকনগরের এই কন্যে মিশিয়ে দিতে চায় ফিটনেসের খুঁটিনাটি। যার উপর ভর করে মজবুত হয় ভারতীয় ফুটবলের ভবিষ্যতের উড়ান! পৌলমীর সঙ্গে আমরাও স্বপ্ন দেখি, মাঠ চিরে গোলের উল্লাস ছড়িয়ে পড়ছে স্টেডিয়ামের পরতে পরতে। স্পেন, জাপান, ইংল্যান্ড, আর্জেন্টিনা ব্রাজিলের সঙ্গে টক্কর দিয়ে খেলছে ভারতীয় মেয়েরা! ভিকট্রি ল্যাপে একবারও কি উড়বে না আমাদের পতাকা?
অলঙ্করণ: সুমনকুমার সিংহ
8Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা