আমরা মেয়েরা

জীবন্ত দুর্গা

দূরদর্শনের প্রথম ‘দুর্গা’ তিনিই। কেমন আছেন সেই সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়? খোঁজ দিলেন স্বরলিপি ভট্টাচার্য। 

মনে যে মানুষটি এসে দাঁড়ালেন তিনি প্রায় ছ’ফুটের উপর লম্বা। চওড়া বুকের ছাতি। চেহারায় পারফেক্ট ‘মহিষাসুর’। তাঁর সামনে কলেজে পড়া মেয়েটি দাঁড়িয়ে প্রথমে বেশ ভয় পেল। ভাবল ইনি যদি মহিষাসুর হন, তাহলে তো ওঁর সঙ্গে যুদ্ধটা করাই উচিত নয়। যুদ্ধ শুরুর আগে হেরে গেল ‘দুর্গা’— হাসতে হাসতে আমেরিকা থেকে এ গল্প ভাগ করে নিচ্ছিলেন সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়। মহালয়ার ভোরে দূরদর্শনের পর্দায় দীর্ঘ সময় ধরে যাঁকে দর্শক দুর্গা হিসেবে দেখেছেন। ‘মহিষাসুরের চরিত্রে অভিনয় করতেন নীলকান্ত সেনগুপ্ত। উনি অনেক বড় মাপের অভিনেতা। অত্যন্ত অমায়িক মানুষ ছিলেন। খুব অল্প বয়সে চলে গিয়েছেন। বিশাল লম্বা মানুষটির সামনে প্রথম আলাপে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল ইনি মহিষাসুর হলে আমার যুদ্ধটাই করা উচিত নয়। আমি তো হেরেই গিয়েছি। প্রথম আলাপে ওঁকে দেখে ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে ওঁর স্নেহ পেয়েছিলাম। অনস্ক্রিন কীভাবে ওঁকে মারব সে ব্যাপারে গাইড করতেন,’ মা দুর্গার মতোই হেসে উঠলেন সংযুক্তা।
মহালয়ার ভোর এখনও সংযুক্তার কাছে পুজোর আগমনী। প্রবাসে শিউলির গন্ধ হয়তো নেই। ঢাকের আওয়াজ চাইলেই শোনা যায় না ঠিকই। কিন্তু সপ্তাহান্তের পুজো আছে ঘরোয়া আবেগে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আছে ফেলে যাওয়া কলকাতার মতোই। নতুন প্রজন্মের উৎসাহ আজও একইরকম, ঠিক যেমন কলকাতা শিখিয়েছিল তাঁকে। ছোটবেলায় বাবা, মা, পরিবার, বন্ধুদের সঙ্গে প্যান্ডেলে ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখাই ছিল সংযুক্তার পুজোর রুটিন। তার আগে পুজোর কেনাকাটার ব্যস্ততা থাকত। পরবর্তীকালে নাচের সূত্রে, দূরদর্শনের অনুষ্ঠানের সূত্রে বিভিন্ন খবরের কাগজের মাধ্যমে পুজো প্যান্ডেলগুলোকে সম্মান জানানোর নানা অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। সেই সূত্রে ঠাকুর দেখা হতো। তার দারুণ উত্তেজনা ছিল। বিবাহসূত্রে সংযুক্তা দীর্ঘদিন আমেরিকা নিবাসী। সেখানে পুজোর রং, গন্ধ, সাজ কেমন? ‘উত্তর আমেরিকার পুজোর পরিবেশে বাঙালিয়ানার অনুভূতি আমরা ধরে রাখতে পেরেছি। এখানে শুধু ষষ্ঠী থেকে দশমী পুজো নয়। তিন থেকে চারটে উইকেন্ড ধরে পুজো হয়। বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন শহরে পুজো করে। সেখানে আমার একার, কখনও বা ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে অনুষ্ঠান থাকে। আমার এখানে মহালয়ায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের আদলে লাইভ পারফরম্যান্স হয়। সেটা একটা বিশেষ অনুভূতি। বিশেষ আবেগের জায়গা। সেখানে কখনও পারফর্মার, কখনও দর্শক হিসেবে থাকি। দেখতে ভালো লাগে আজকের প্রজন্ম যারা এখানে জন্মেছে, বড় হচ্ছে, আমার ছেলে বা ছাত্রছাত্রীরা— তারা পুজোয় যুক্ত থাকতে, অংশ নিতে খুব আগ্রহী। ধুতি পাঞ্জাবি বা শাড়ি পরা, অঞ্জলি দেওয়া, ভোগ খাওয়াতে ওদের খুব উৎসাহ,’ 
বললেন তিনি। 
১৯৯৪ নাগাদ মহালয়ার প্রভাতী অনুষ্ঠানে মহিষাসুরমর্দিনী চরিত্রে হঠাৎ করেই সুযোগ পেয়েছিলেন সংযুক্তা। নাচ তাঁর আজন্মের সঙ্গী। নাচের সঙ্গে সখ্যই কার্যত এই সুযোগ এনে দিয়েছিল। সংযুক্তা বললেন, ‘১৯৯৪-এ দূরদর্শন থেকে শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্তর তত্ত্বাবধানে যে প্রোডাকশন হচ্ছিল তার জন্য তাঁরা বেশ কিছু অভিনেতা, অভিনেত্রীকে বাছাই করতে আসেন ‘কলামণ্ডলম’-এ। সেদিন কথাকলি মাস্টার গুরু গোবিন্দন কুট্টি আমাকে ডেকে পাঠান। সেখান থেকেই আমাকে ওই চরিত্রের জন্য বেছে নেওয়া হয়।’ প্রথম বছর ওই অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত কলাকুশলীরা প্রায় মাসখানেকের ওয়ার্কশপ করে তৈরি হয়েছিলেন। স্মৃতির ঝাঁপি উপুড় করে সংযুক্তা বললেন, ‘সেবছর পরিচালক ছিলেন সনৎ মাহাতো। উনি তপন সিনহার সহযোগী পরিচালক ছিলেন। ওঁর তত্ত্বাবধানে পুরো চিত্রনাট্য পড়া বা কোরিওগ্রাফি, কম্পোজিশন, প্রতিটা দৃশ্য ধরে ধরে ওয়ার্কশপ করেছিলাম। তারপরে শ্যুটিং। শ্যুটিংয়ের সময় পুরো কম্পোজিশনের পরিকল্পনা সকলের মাথায় ছিল।’ কিন্তু পরবর্তী ক্ষেত্রে আর টানা ওয়ার্কশপ করার সুযোগ হয়নি। কারণ হিসেবে সংযুক্তা বলেন, ‘আসলে বেশ কিছু পারফর্মার কয়েক বছর টানা কাজ করেছিল। দুর্গা, ইন্দ্রদেব, নারদ, মহিষাসুর এবং অন্যান্য বেশ কিছু দেবতার চরিত্রের অভিনেতাদের বদল হয়নি। কিন্তু পরবর্তীকালে অন্য অভিনেতারা এলেও টানা ওয়ার্কশপ 
আর হয়নি।’
২০১৪-র পর থেকে সংযুক্তাকে আর দুর্গার ভূমিকায় দেখা যায়নি। ধীরে ধীরে অন্যান্য বেসরকারি চ্যানেলেও মহিষাসুরমর্দিনীর নানা অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। এত বছরের চেনা জায়গা ছেড়ে যেতে খারাপ লাগেনি? একটু অন্য ভাবে উত্তর দিলেন সংযুক্তা। ‘১৯৯৪ থেকে ২০১৪ প্রায় আট-ন’বার শ্যুটিং হয়। ফলে দূরদর্শনের কাছে এত ফুটেজ ছিল, তারা সেটা দিয়েই অনেক রকমের অনুষ্ঠান তৈরি করেছিল। এমনও হয়েছে, কোনও বছর রেকর্ডিং করিনি, কিন্তু প্রোডাকশন হয়েছে একদম নতুন। তাছাড়া আমি তখন দেশের বাইরে। আর এতবার একজন দুর্গা করেছে বলে ওরাও হয়তো মহালয়ার প্রভাতী অনুষ্ঠানে নতুন মুখ নিয়ে আসতে চাইছিলেন’, বললেন তিনি।
সংযুক্তা যে সময় দুর্গার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, তখন গ্রাফিক্স এত উন্নত ছিল না। ডিজিটাল মাধ্যমও আসেনি। ফলে তাঁদের কাজ অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল। বিদেশে কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও নরম রোদে ফেলে আসা কলকাতা হাতছানি দেয়। শ্যুটিং ফ্লোরের আড্ডা মনে পড়ে তাঁর। ‘আমাদের সময় যেহেতু গ্রাফিক্স এত উন্নত ছিল না, দশ হাতের কাজটা চ্যালেঞ্জ ছিল। অস্ত্র ধরা, ছাড়ার ব্যাপারটা সম্পাদনায় হতো। আমাকে পজিশন নিতে হতো। আমার কাজের থেকেও সম্পাদকের কাজটা বেশি শক্ত ছিল। প্রথম বছর মাটির হাত নিয়ে করেছিলাম। প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম! ওটা এতটাই ভারী ছিল। কাঠামোর স্ট্রাকচারটা শক্ত করে আমার পিঠে বাঁধা হতো। অতটা ওজন বহন করে চরিত্রের এক্সপ্রেশন ধরে রাখা চ্যালেঞ্জিং ছিল। পরবর্তীকালে ফাইবারের 
হাত তৈরি করা হয়েছিল। সেটা আবার খুব হালকা। এবার বিপরীত চ্যালেঞ্জ। কারণ আমি একটু নড়লেই হাতগুলো নিজের মতো নড়তে শুরু করত। আমাদের মেকআপম্যান ছাড়াও কুমোরটুলি থেকে মৃৎশিল্পী এসে সাজাতেন। ঠিক যেভাবে প্রতিমা তৈরি করেন, সেভাবেই করতেন’, 
বললেন তিনি। 
জীবন এখন তরী বাইছে অন্য পথে। কিন্তু নাচ সংযুক্তাকে কখনও ছেড়ে যায়নি। তাঁর কথায়, ‘বিবাহসূত্রে কলকাতা থেকে উত্তর আমেরিকার বাসস্থান পরিবর্তন করেছি। এখানেও আমার কাজ করে যাচ্ছি। নাচ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করেছি। পিএইডি শেষ করেছি। একইসঙ্গে নিজের ডান্স অ্যাকাডেমি চালিয়েছি। শিক্ষক, কোরিওগ্রাফার, কিউরেটর— যেভাবেই হোক নাচের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কখনও ছিন্ন করিনি। বিভিন্ন বয়সের ছেলেমেয়েদের শেখাচ্ছি। তাদের নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় প্রোডাকশন করছি।’
আবাল্য সাংস্কৃতিক পরিবেশে বড় হওয়ার সুযোগ জীবন গড়তে সাহায্য করেছে বলে মনে করেন সংযুক্তা। সেই চলার পথে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’-তে সুযোগ পাওয়া উপরি পাওনা। শুধু চরিত্র হয়ে ওঠা নয়, মা দুর্গা যেন তাঁর চলার পথের শক্তি। ‘মায়ের বিভিন্ন রূপের আধারেই তো একটি মেয়ের চরিত্র গঠন হয়। আমরা যে এই নানা ভূমিকা পালন করি মেয়ে, মা, মানুষ প্রত্যেকটা চরিত্রের আধার মায়ের রূপ, গুণ থেকেই পাই। জীবনে যখন যা চ্যালেঞ্জ আসছে তখন সেটাকে ধৈর্য ধরে যুক্তি দিয়ে সামলানোর চেষ্টা করার দিকনির্দেশ আমি ওই চরিত্র থেকেই পেয়েছি। বিশ্বাস রেখে কাজটার প্রতি এগনো, সেই কাজটা যখন শেষ করতে পারছি, তার যে আনন্দ, সন্তোষ, যাদের জন্য করলাম তাদের ভালোলাগাটা দেখতে পাচ্ছি, তার থেকে বড় পুরস্কার আর কিছু নেই। ভক্তি, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ভগবানের উপর আস্থা, বিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যাওয়া এই চরিত্রটা করার সূত্রে আরও বেশি করে অনুভব করেছি। সেটা আমার জীবনের অংশ হিসেবে ধরে রাখতে চেষ্টা করছি’, বললেন তিনি।
মহালয়ার ভোর সংযুক্তার জীবনকে এক নতুন দিগন্ত চিনিয়েছে। প্রবাসে ঘরকন্যায় নতুন প্রজন্মকে সেই ঐশ্বর্যের স্বাদ চিনিয়ে যাওয়ার কাজ করে চলেছেন এই জীবন্ত দুর্গা।
 
9Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা