আমরা মেয়েরা

মায়ের সঙ্গে প্রাণের খেলা

দুর্গাপুজো ঘিরে নিছক গল্পকথা? নাকি সবটাই জীবনের অংশ? সুদীপা চট্টোপাধ্যায়-এর কাছে পুজোর গল্প শুনে লিখলেন স্বরলিপি ভট্টাচার্য।


সেম্বরের কলকাতা। ২০২২-এর শেষভাগ। শহরে শীত এসেছে নিয়ম মতো। তবে কলকাতার ঘরে ঘরে সেদিন হাওয়া গরম। চায়ের টেবিলে তুফান। বাজি ধরছে ছেলে ছোকরা, বাচ্চা বুড়োর দল। নীল-সাদায় সেজে কলকাতা সেদিন যেন মিনি আর্জেন্টিনা। চলছে বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল ম্যাচ। বল পায়ে সবুজ মাঠে এগিয়ে যাচ্ছেন স্বপ্নের নায়ক। লিওনেল মেসি। যে ছেলেটাকে বড্ড ভালোবাসেন চট্টোপাধ্যায় পরিবারের গৃহকর্ত্রী। ম্যাচ যত এগচ্ছে তত টেনশন বাড়ছে দক্ষিণ কলকাতার বিশেষ একটি বাড়িতে। কারণ? মেসি গোল পেলেই মায়ের মুকুট গড়ানো হবে। মায়ের সঙ্গে মনে মনে সেই বোঝাপড়া করছেন গৃহকর্ত্রী। চোখ টিভিতে। ‘মেসিকে বরাবর সাপোর্ট করি আমরা। গত ফাইনালে মেসি গোল করেনি তখনও। আমি মনে মনে বলি, মা এবছর তোমাকে একটা বড় সোনার মুকুট দেব। তারপরই মেসি গোল করল। তখন মনে মনে ভাবছি, ১৮ ক্যারেটে গড়িয়ে দেব। একটু কম খরচ হবে। যেই না ভাবা, অমনি বিপক্ষ দল গোল দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আবার মনে মনে বললাম, না মা, পুরো সোনার মুকুটই দেব তোমাকে’, হাসতে হাসতে বলছিলেন সুদীপা। চট্টোপাধ্যায় পরিবারের গৃহকর্ত্রী। যাঁর বাড়িতে বছরে পাঁচদিনের জন্য মা আসেন মেয়ে হয়ে। 
গত ১২ বছর ধরে সুদীপা এবং তাঁর স্বামী অগ্নিদেব চট্টোপাধ্যায় কলকাতায় এই পুজো করে চলেছেন। কিন্তু আদতে এটি ১৫২ বছরের পুজো। শুরু হয়েছিল ঢাকা বিক্রমপুরে। সুদীপা জানালেন, অগ্নিদেবের পূর্বপুরুষরা  বাংলাদেশ থেকে যখন চলে এসেছিলেন, তখন কিছু নিয়ে আসতে পারেননি। ঠাকুরের সব গয়না সিন্দুক খুলে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দিয়ে দেওয়া হয়। ‘আমার শ্বশুরবাড়ির পূর্বপুরুষদের কেউ ব্রাহ্ম সমাজের একজনকে বিয়ে করেছিলেন। তাঁদের সকলে শিক্ষিত হলেও ওই পরিবেশে গ্রামবাসীরা পুজো বয়কট করেন। তারপর এপারে চলে আসেন সকলে। এদিকে আসার পর আর পুজো হয়নি। মায়ের একটা গয়না আছে। ভিক্টোরিয়ান যুগেরও আগের একটা জড়োয়ার ময়ূর। ওটারই বয়স ১৪৩ বছর। সেই হিসেবে ১৪০ সংখ্যাটা ধরে নিয়ে আমরা এটা ১৫২ বছরের পুজো বলে জানি। তার আগের কোনও নথি বা হিসেব আমরা পাইনি’, ইতিহাস শোনালেন তিনি। 
‘একটা ছোট মেয়ে বাপের বাড়ি এসে যেমন খেলা করে, উনিও সেটাই করেন। আমাদের বাড়িতে উনি মেয়ে। প্রতি বছর বায়না করে গয়না গড়ান। এভাবে গয়না বাড়তেই থাকে। প্রতি বছর কিছু না কিছু  নিজের গয়না হারিয়ে দেন। কী করে, জানি না! এরকম করে করে মা অনেক গয়না গড়িয়েছেন’, সুখস্মৃতি ভাগ করে নিলেন সুদীপা। তাঁর কথায়, ‘আমাদের মা মাথায় দুটো চাঁদ পরেন। এক বছর চাঁদ হারিয়ে দিলেন। সাজানোর সময় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শিব মাকে দিয়েছিলেন চাঁদ। পরাতেই হবে। তখনই চাঁদ জোগাড় করে এনে পরানো হল। ঠিক সেদিন রাতেই আমার গর্ভধারিণী মা বলল, দেখ তো আমার গয়নার বাক্সে এটা কী চকচক করছে। দেখা গেল ওটা ঠাকুরের চাঁদ। দুটো অর্ধচন্দ্র মিলে একটা গোটা চাঁদ হয়ে যায়। পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করলাম, উনি বললেন, মা চেয়েছেন যখন আমরা কে বলার?’ কোভিডের সময় আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন সকলেই। কিন্তু সেবছর মায়ের মাথায় একটা রুপোর ছাতা দরকার। চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা ভেবেছিলেন, পরের বছর গড়িয়ে দেবেন। ‘আমাদের ওটা অর্ডার করাই ছিল। তবুও মহালয়ার আগের দিন সোনার দোকানে ফোন করে বলি, এবার ওটা নিতে পারছি না। সামনের বছর অবশ্যই নেব। ওমা! পঞ্চমীর দিন দেখি সোনার দোকানের ভদ্রলোক ছাতা নিয়ে এসে হাজির। বললেন, আমার ঘুম হচ্ছে না। আপনি রাখুন। পরে টাকা দিয়ে দেবেন। আমার স্বামী বললেন, উনি যখন নিজে হাতে নিয়ে এসেছেন আর মা বাড়িতে চলে এসেছেন, তুমি না কোরো না।’ গোটা ব্যাপারটাই অলৌকিক যোগাযোগ বলে মনে করেন তাঁরা। শোনা গেল আর একবার সোনার দোকান খুলিয়ে নথ কিনিয়েছেন মা। সে কাহিনি কেমন? সুদীপার কথায়, ‘সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের মূল পূজারি। সেবার হঠাৎ রাত্রিবেলা নথ পাওয়া যাচ্ছে না। পরের দিন মায়ের প্রাণ প্রতিষ্ঠা। প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়ে গেলে আর গয়না পরানো যায় না। সপ্তমী থেকে সব দোকান বন্ধ। সঞ্জয়দা গেলেন নথের খোঁজে। একটিমাত্র গয়নার দোকান খোলা ছিল। তাঁরাও বন্ধ করেই দিচ্ছিলেন প্রায়। তখন সঞ্জয়দা গিয়ে বলেন, মায়ের গয়না। ওরা বলেন, মা গয়না চেয়েছেন! দাঁড়ান, বলে দোকান খুলিয়ে নথ কেনালেন। ঠিক নতুন নথটা মাকে পরানো হল। তারপরই পুরনো নথ পাওয়া গেল। এখন দুটো নথ পরে থাকেন। একটা জড়োয়ার নথও পরেন।’ 
চট্টোপাধ্যায় পরিবারের মায়ের টানা টানা চোখ। সাবেক সাজ। ‘আমাদের মূর্তির বিশেষত্ব হচ্ছে, মায়ের সঙ্গে সঙ্গে সিংহও খুব সাজে। যেহেতু সেও বাপের বাড়ি ফেরে। পার্বতীকে এই সিংহ দিয়েছিলেন তাঁর বাবা। ফলে বাপের বাড়ি থেকে পাওয়া। ওঁর যা যা হয়, সিংহরও হয়। মায়ের হাতের চূড়ের মতো একরকম দেখতে সিংহেরও হাতের চূড় আছে। এক একদিন এক একরকমের মালা পরে আমাদের মা। ভীষণ সাজুনি’, বললেন সুদীপা। মায়ের নানা রকমের বায়নার আরও উদাহরণ দিলেন তিনি। ‘মেয়ের শ্বশুরবাড়ি ফেরার সময় আমার স্বামী যতক্ষণ না মায়ের হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে অনুরোধ করছেন মা আবার এসো, পরের বছর আরও ধূমধাম করে নিয়ে আসব তোমাকে। এখন শ্বশুরবাড়িতে যাও। বাপের বাড়িতে এতদিন থাকতে নেই। লোকে নিন্দে করবে। ততক্ষণ মূর্তি নাড়াতে পারে না কেউ।’
এই পরিবারের দুর্গাপুজো মূলত স্ত্রীআচার কেন্দ্রিক। সুদীপার কথায়, ‘সাবর্ণ রায়চৌধুরীর পরিবারে ত্রিবেণী সঙ্গমে পুজো হয়। আমাদেরও সেটাই। প্রথম বছর বৈষ্ণব মতে পুজো হয় আমাদের। তারপর ঢাকা থেকে আরও কিছু তথ্য সংগ্রহ করি। আমাদের প্রথম পুজো শুরু হয় বৈষ্ণব মতে। সপ্তমীতে শিব আসেন। তখন শৈব মতে পুজো হয়। অষ্টমী নবমীর সন্ধিপুজো থেকে আমাদের তন্ত্রমতে পুজো হয়। এটা খুব কঠিন। স্ত্রীআচার খুব বেশি।’ মায়ের ভোগেও রয়েছে বিশেষত্ব। ভোগে মা এক একদিন এক একরকম চালের ভোগ খান। অষ্টমীতে ঢাকা থেকে আসা চিনিগুড়া চাল আর ঘি দিয়ে তৈরি হয় মায়ের ভোগ। প্রতি বছর ঢাকার কোনও মুসলিম পরিবার থেকে আসে এই সামগ্রী। এটা আজ পর্যন্ত চট্টোপাধ্যায় পরিবারকে কিনতে হয়নি। সেরকমই রায়গঞ্জের তুলাইপাঞ্জি চালে একদিন ভোগ হয়। একদিন রাধাতিলক, একদিন গোবিন্দভোগে ভোগ হয়। সর্বশেষে সেদ্ধ চালের পান্তা হয়। মা সন্ধিপুজোর পর থেকে আমিষ ভোগ খান। ভোগ রান্না করেন মেয়েরা। পরিবেশন করেন ছেলেরা। মায়ের ভোগের পায়েস রান্না করেন কোনও পুরুষ। মাছ রান্না করেন মহিলারা। ‘আমরা যতক্ষণ ভোগ রান্না করি, কথা বলতে পারি না। মুখ বাঁধা থাকে। ইশারায় কথা বলি। দুর্গানাম জপতে জপতে কাজ করি আমরা’, বললেন সুদীপা। 
রথের দিন কাঠামো পুজো হয়। আর রাধাষ্টমীতে যতটা মূর্তি তৈরি হয় তাতে সিঁদুর ছোঁয়ানো হয়। প্রতিদিন নাকি মায়ের রূপ বদলে যায়। সুদীপা বললেন, ‘এটা ছবি তুলে দেখেছি। এক বছর মা আসার পর আমার মনে হচ্ছে ভীষণ রেগে রয়েছেন। মুখটা পুরো হলুদ। হাসি নেই। আমি খুব কান্নাকাটি করি। অনেকে এটা আমার পাগলামো বলবেন। আমাদের মাকে তৈরি করেন মোহন বাঁশি রুদ্রপালের ভাইপো পশুপতি রুদ্রপাল। ওঁকে ডাকা হল সেবার। বাড়িতে এসে অনেকক্ষণ মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, মাকে আপনি একটু রক্ত দিতে পারবেন? আমি বলি, মাকে তো প্রাণও দিতে পারব। সেই বছর থেকে আজ পর্যন্ত সেটাই চলে। মায়ের মুখটা সেই বছর থেকে আমাদের বাড়িতে এসে শেষ করা হয়। রঙের মধ্যে যখনই আমি হাত থেকে একফোঁটা রক্ত দিই, মুখটা পলকে বদলে যায়। মনে হয় এতক্ষণ রক্তশূন্য ছিল।’ 
শুদ্ধমনে ভক্তিভরে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের মায়ের কাছে যা চাওয়া হয়, তাই তিনি দেন, এ দাবি করলেন গৃহকর্ত্রী। সকলের জন্য বছরের এই পাঁচটা দিন মায়ের কাছে অবারিত দ্বার। তারও এমন উদাহরণ দিলেন সুদীপা, যে ঘটনার কোনও ব্যাখ্যা নেই তাঁদের কাছে। ‘কোভিডের সময় তো কাউকে ডাকতে পারিনি। মা এসেছে যখন এত কম লোক, মাকে পাঁচ তলায় তোলা মুশকিল হচ্ছিল। মায়ের ছেলেমেয়েরা  লিফটে উপরে চলে যায়। মা আকারে বড়, লিফটে যেতে পারে না। সেই বছর কয়েকজন রিক্সাওয়ালা এসে বললেন, আমরা কি মাকে ছুঁতে পারি? আমি বললাম কেন নয়? মা তো সবার। সেই থেকে প্রতি বছর আসেন ওঁরা।’ 
বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু হওয়ার পর সুদীপার জীবন বদলে গিয়েছে পুরোটাই। ‘যখন থেকে মা এসেছে তখন থেকে পুজো ঘিরে আমাদের সারা বছরের জীবন। আমাদের ক্যালেন্ডার বৈশাখ বা জানুয়ারিতে শুরু হয় না। আমাদের ক্যালেন্ডার শুরু অক্টোবরে। পুজোর ক’দিন আমার কাছে স্পিরিচুয়াল জার্নি। খুব স্বার্থপরের মতো একা হয়ে যাই। প্রত্যেকেই বোধহয় মায়ের সঙ্গে একটা স্পিরিচুয়াল জার্নিতে থাকে। পরিবারের সঙ্গেও ওই কয়েকদিন তেমন যোগাযোগ থাকে না আমার। সারাক্ষণ মায়ের সঙ্গেই থাকি। ভোগ রান্না, কীভাবে সাজানো হবে। সেই সব নিয়ে ব্যস্ততা চলে।’
মায়ের থুড়ি, মেয়ের আসার সময় হয়েছে। প্রস্তুতি প্রায় শেষ। চট্টোপাধ্যায় পরিবারে নতুন ক্যালেন্ডারের দিন এগিয়ে আসছে। যা সত্যিই শুরু হয় দুর্গাপুজো থেকেই।
9Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা