আমরা মেয়েরা

দুর্গার ঘরের দুর্গারা

মায়ের আরাধনায় মেয়ের হাতের ছোঁয়া কি এড়িয়ে থাকা যায়? কুমোরটুলি ঘুরে মহিলা মৃৎশিল্পীদের সঙ্গে কথায় সুদীপ্ত রায়চৌধুরী।

রতের সকাল। দূরদূরান্তে মেঘের বালাই নেই। চারিদিক ঝকঝক করছে রোদ। নেভি ব্লু আকাশজুড়ে পেঁজা তুলোর মতো সাদা সাদা মেঘদলের দাপট জানান দিচ্ছে, পুজো আসছে। পোড়া ডিজেলের তীব্র গন্ধই হোক বা ট্রাম, বাস, হকারদের ক্যাকোফনি— এই সময়ে সবটাই কেমন আবছা হয়ে আসে। পুজোর গন্ধ পাওয়া যায়। বহু অতৃপ্তি ভুলে যাওয়া যায় দিব্যি। শহরটাকে আবার নতুন করে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। আলগোছে পুজোর সেই গন্ধ গায়ে মাখতে মাখতেই পথ চলা শুরু। পুরনো কলকাতার ভাঙা ইটের দেওয়াল, রংচটা বাড়ি, অবহেলায় মরচে ধরা তালা দেওয়া দরজা পেরিয়ে গন্তব্য কুমোরটুলি।
পুজোর কয়েক মাস আগে থেকেই কুমোরটুলি জুড়ে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। হপ্তাদুয়েক বাকি থাকতে সেই রব বদলে যায় তুমুল ব্যস্ততায়। কথা কম, কাজ বেশি। ঝড়ের গতিতে হাত চলছে সব স্টুডিওর শিল্পীদের। তার মধ্যেই জিজ্ঞাসা করা গেল, মহিলা শিল্পীরা কোথায় ঠাকুর গড়েন? জবাব এল না। দ্বিতীয়বার জিজ্ঞাসা করতেই উত্তর এল বিরক্তির সুরে, ‘এগিয়ে যান সামনের দিকে।’ বেশ কিছুটা গিয়ে এক আচার বিক্রেতার বদান্যতায় খুঁজে পাওয়া গেল চায়না পালের স্টুডিও। কয়েকজন কাজ করছেন। স্টুডিওজুড়ে সোঁদা মাটির গন্ধ। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর দেখা হল চায়না পালের সঙ্গে। কাজের ফাঁকে বাড়ি গিয়েছিলেন। মাকে খাবার দিতে। পরনে সিন্থেটিক শাড়ি, এলোমেলো চুল, কপালে পুজোর টিপ। আঁচলটা কোমরে গুঁজে হাত দিলেন প্রতিমা তৈরির কাজে। হাত চলছে নিপুণ ছন্দে। তার ফাঁকে ফাঁকে জমল আলাপ। কিছু কথা, কিছু স্মৃতি। বাবা হেমন্তকুমার পাল ছিলেন মৃৎশিল্পী। কিন্তু কখনই চাননি যে মেয়ে এই পেশায় আসুক। আসলে সেই সময় অন্য অনেক পেশার মতো এই পেশাতেও ছিল পুরুষের আধিপত্য। কিন্তু ১৯৯৪ সালে বদলে গেল সবকিছু। ‘সেবছর প্রচুর ঠাকুরের বায়না এসেছিল। কিন্তু পুজোর ঠিক আগে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। উপায় নেই দেখে এগিয়ে এসে ব্যবসার হাল ধরি। কিছুদিন পর বাবা মারা গেলেন। কারিগররা দাবি তুললেন, স্টুডিও চালাবেন তাঁরাই। বাধ্য হয়ে আমি তখন কাজ শেখা শুরু করি। কিন্তু কেউই শেখাতে চাইতেন না। ধরুন, ঠাকুরের মুখ তৈরি হবে। সেখানে কোন কোন মাটি কী কী অনুপাতে মেশাতে হবে, তা তো জানতে হবে। আমিও হাল ছাড়িনি। আসলে কাজ শেখা ছাড়া আর কোনও রাস্তাও ছিল না আমার কাছে। সংসার চালাতে হবে তো! বাবা আর মা দুর্গার আশীর্বাদে কাজ শিখলাম। শুধু মূর্তি গড়া নয়, যাঁরা প্রতিমা কিনতে আসতেন, তাঁদের সঙ্গেও কথা বলতাম। সেই সময় কুমোরটুলি আমায় সহজে মেনে নেয়নি। স্টুডিওর বাইরে মূর্তি রাখতাম। অনেকেই রাখতেন। কিন্তু আমার বেলায় সবাই আপত্তি করল। আমি কিছু বলিনি। শুধু কাজ করে গিয়েছি। ২০১৫ সালে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা তাঁদের পছন্দমতো দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরির অনুরোধ নিয়ে এসেছিলেন। কেউ রাজি হচ্ছিলেন না। আমি সেই প্রতিমা তৈরি করি। সেটা কিছু মানুষের ভালো লাগেনি। অনেক সমালোচনা হয়েছিল। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমার মনে হয়, প্রত্যেক মানুষেরই মা দুর্গাকে আরাধনা করার অধিকার আছে।’ লড়াই কঠিন ছিল। কিন্তু নিজের চেষ্টা আর পরিশ্রমেই সফলতা পেয়েছেন চায়না। রাজ্যপালের থেকে পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ২০১৮ সালে সরকার কুমোরটুলির মহিলা মৃৎশিল্পী হিসেবে তাঁকে চীনে পাঠিয়েছিল। কথোপকথনের মধ্যেই নামল বৃষ্টি। বাইরের অঝোর ধারার দিকে তাকিয়ে একটু অন্যমনস্ক চায়না। বললেন, ‘বাংলায় একটা কথা আছে না, ফল দেখলে গাছ চেনা যায়। তেমন শুধু কাজ দেখেও একদিন মহিলা শিল্পী চেনা যাবে।’
বৃষ্টি কমতেই চায়নার স্টুডিও থেকে বেরিয়ে এলাম। পরবর্তী গন্তব্য মালা পালের স্টুডিও। জল-কাদায় মাখামাখি গলির মধ্যে কালো প্লাস্টিকে ঢাকা স্টুডিও। বোঝা গেল, বৃষ্টি থেকে ঠাকুর বাঁচাতেই প্লাস্টিকের আচ্ছাদন। মাথা গলালাম। একমনে কাজ করছেন দাদা গোবিন্দ পাল। বললেন, ‘বোন বাজারে গিয়েছে। একটু বসতে হবে।’ মিনিট দশেকের মধ্যেই এলেন মালা। একহাতে ভেজা ছাতা, অপর হাতে ব্যাগ। সেসব রেখে স্টুডিওর সবাইকে মুড়ি মেখে দিলেন। চা-মুড়ি খাওয়ার ফাঁকেই শুরু হল কথা। ‘এই স্টুডিও ছিল বাবার। আমি সুযোগ পেলেই চলে আসতাম। কিন্তু বাবা চাইতেন না যে আমি এখানে আসি। বলতেন, এ ছেলেদের পেশা, মেয়েদের নয়। মেয়েরা কেন দোকানে আসবে? আমি অবশ্য তাঁর কথা শুনিনি। বাবার মৃত্যুর পর নিয়মিত আসতে শুরু করি। ধীরে ধীরে কাজ শিখি।’ এখন কাজে মালাকে সাহায্য করেন তাঁর দাদা গোবিন্দ পাল, স্বামী ভানুরুদ্র পাল। অভাবের সংসারে মালা বেশি পড়াশোনা করতে পারেননি। এখন মূর্তি গড়ার পাশাপাশি ছোট ছেলেমেয়েদের কাজও শেখান তিনি। নতুন প্রজন্মকে এই কাজে উৎসাহিত করতে কুমোরটুলিতে মৃৎশিল্পী তৈরির এই পাঠশালাটি খুলেছিলেন মালা। শুরু হয়েছিল দু’জনকে নিয়ে। এখন ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ৪০ ছাড়িয়েছে। পটুয়াপাড়ার ঘিঞ্জি জায়গার মধ্যে তাঁর স্কুলে জায়গার অভাব। তাই এখন ঠাকুর গড়া শেখার কাজ চলছে কুমোরটুলি লাগোয়া রবীন্দ্র সরণির একটি বড় ঘরে। বলছিলেন, ‘বাচ্চাদের এই ভালোবাসাই আমাকে রোজ নতুন কাজে উৎসাহ দেয়। তবে একটা আক্ষেপ রয়েছে। আমাদের ঘরের ছেলেমেয়েরা প্রতিমা তৈরি শিখতে চায় না। পরবর্তী প্রজন্ম না এলে কী করে চলবে! মৃৎশিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা হয়।’ 
বাবা-মায়ের উৎসাহে মৃৎশিল্পের পেশা বেছে নিয়েছেন কুমোরটুলির আর এক শিল্পী সুচন্দ্রিমা পাল। কাজ শিখেছেন বাবার কাছে। স্টুডিওর কাজ দেখাশোনার ভার প্রায় নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছেন। ‘আসলে ছোট থেকেই মূর্তি গড়া দেখতে ভীষণ ভালো লাগত। কাদার তাল থেকে কী অপরূপ সৃষ্টি হতে পারে, দেখে অবাক হতাম। আর ভালো লাগত চোখ আঁকা। বাতিল কোনও মুখে নিজে নিজে চেষ্টা করতাম। বাবার সাহস-ভরসায় বড় মূর্তিতে হাত দিই। সেই শুরু।’ বলছিলেন সুচন্দ্রিমাদেবী। এরপর বিয়ে, সংসার, সন্তান। তবু ছেদ পড়েনি কাজে। ‘ঠাকুর গড়ার কাজ বেশ কঠিন। বিশেষত বড় ঠাকুর গড়া। তাই হয়তো মহিলারা এই দায়িত্ব নিতে ভয় পান। তবু কাউকে তো এগিয়ে আসতেই হবে। কাজ জানি যখন, করব না কেন?’ দৃঢ় গলায় প্রশ্ন সুচন্দ্রিমার।  
কথা শেষ। বাড়ি ফেরার পালা। বৃষ্টি শেষে ততক্ষণে ফের ঝকঝকে আকাশ। মনে মনে প্রার্থনা করলাম, শরতের আকাশের মতো মাতৃমূর্তির রঙিন রূপে উজ্জ্বল হয়ে থাকুক এই শিল্পীদের জীবন। মাতৃরূপেণ...।
10Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা