বৈদিক বিদুষী অপলা, গার্গী, মৈত্রেয়ীকে আজকের মেয়েরা দেখেননি। দেখেননি ঊনবিংশ শতকের কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় বা কাদম্বরী দেবীকেও। বছর পয়তাল্লিশের ‘দুর্গা’র নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন। শুনেছেন নিশ্চয়ই প্রায় অর্ধশতক আগে তাঁর বাবা ও মায়ের নেওয়া সাহসী সিদ্ধান্তের কথা। যে সাহসের জন্য সংস্কার ভেঙে ‘টেস্টটিউব বেবি’র মাধ্যমে আজ সন্তানের মুখ দেখছেন দেশের লাখো দম্পতি। ঠিকই বুঝেছেন। এই ‘দুর্গা’ আসলে কানুপ্রিয়া (কৃষ্ণ-প্রিয়া অর্থাৎ রাধা)। কানুপ্রিয়া আগরওয়াল।
দেশের প্রথম টেস্টটিউব বেবি। কলকাতার কন্যা এখন থাকেন মুম্বইয়ে। আন্তর্জাতিক নারী দিবস-এর প্রাক্কালে পাওয়া গেল অসমসাহসী পিতা-কন্যাকে। প্রভাত আগরওয়াল এবং কানুপ্রিয়ার সঙ্গে কথা বললেন বিশ্বজিৎ দাস।
প্রতিবেদক: হঠাৎ ‘দুর্গা’? নাম ঠিক করে রেখেছিলেন?
প্রভাত: ১৯৭৮ সালে দেবীপক্ষে জন্মেছিল মেয়ে। আমার বাবা নাম দিয়েছিলেন দুর্গা। ভালো নাম কানুপ্রিয়া। সেটা আমার দেওয়া।
প্রতিবেদক: সেইসময় টেস্টটিউব বেবির সিদ্ধান্ত। পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবরা কথা শোনায়নি?
প্রভাত: ঠিক উল্টো। ও আসায় সবাই খুব খুশি হল। ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, সব ঠিক থাকলে আরও একটি সন্তান পাবেন আপনারা। এত বড় মানুষ। সবসময় হাসছেন। কী ভালো ব্যবহার। সেই উনিই বেশিদিন বাঁচলেন না। মেয়েকে পেয়েছি। কানুপ্রিয়াই আমার ছেলে। আমার মেয়ে। কোনও আফসোস নেই আমার।
প্রতিবেদক: আপনার মতো সাহসী বাবা আজকের মেয়েদের বাবা-মায়েদের প্রতি কী বার্তা দেবেন?
প্রভাত: একটাই কথা বলব—মেয়ের উপর বিশ্বাস রাখুন। ও ঠিক নিজের পায়ে দাঁড়াবে। আকাশ ছোঁবে একদিন। আবার আপনাদেরও দেখবে।
প্রতিবেদক: আপনার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে দুই দেবীর নাম। কানুপ্রিয়া আর দুর্গা। আকাশছোঁয়া প্রত্যাশা নিশ্চয়ই আপনাকে ঘিরে?
কানুপ্রিয়া (দুর্গা): (হাসি) যে কোনও মহিলার মধ্যে হাজারও রূপ দেখবেন। সন্তান, মা, স্ত্রী, সহকর্মী—কতকিছু নিয়ে চলতে হয় আমাদের। আমি আর কী করলাম! যা করল সব তো বাবা-মাই। বাবা শক্ত খুঁটির মতো অবলম্বন হয়েছেন সবসময়। আর মায়ের সম্পর্কে যত বলব, কম বলা হবে। মেয়ে থেকে পরিপূর্ণ নারী হয়ে উঠেছি মায়ের জন্য। একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত যৌথ পরিবারে শত ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যেও আগলে রেখে আমাকে বড় করে তুলেছেন মা। জানি না নিজের মেয়েকে কতটা দিতে পারব।
প্রতিবেদক: ভারত তথা এশিয়ার প্রথম টেস্ট টিউব বেবি আপনি। যতই বড় হয়েছেন, কথা শুনতে হয়েছে আশপাশ থেকে?
কানুপ্রিয়া (দুর্গা): (হাসতে হাসতে) ভাগ্যিস, সেই সময় সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। তাহলে হয়তো অন্য পরিস্থিতি হতো। নাহ্, সিরিয়াসলি আমাকে স্বাগতই জানানো হয়েছিল। এখন তো অনেকে জানেন। চেনেন। কিছুটা সেলিব্রিটি ফেম এনজয়ও করি।
প্রতিবেদক: তখন নিশ্চয়ই খুব ছোট, সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে মনে পড়ে।
কানুপ্রিয়া: মাত্র তিন বছর। না, মনে নেই। কিন্তু প্রফেসর সুনীত মুখোপাধ্যায়, সুভাষ পত্নী নমিতা মুখোপাধ্যায়, টি সি আনন্দ কুমার আমার জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। আমি তো সব জায়গায় বলি, আমি গর্বিত, আমার পাঁচজন বাবা-মা!
প্রতিবেদক: একটার পর একটা হার্ডলস টপকে এগিয়ে চলা আজকের মেয়েদের জন্য কোনও বার্তা?
কানুপ্রিয়া: প্রথম কথা, নিজের মাটিকে ভুলবেন না কোনওদিন। যেখান থেকে সব শুরু হয়েছিল। মাটিতে পা রেখে চলুন। দ্বিতীয় কথা হল, আপনি যেখান থেকেই উঠে আসুন না কেন, কোথায় যাবেন, কেউ ঠিক করে দেয়নি। আর হ্যাঁ, পরিবার হোক বা কর্মস্থল, ব্যক্তিগত সম্পর্ক হোক বা সামাজিক পরিচয়—সব জায়গায় নিখুঁত হতে পারবেন না। তাই নিখুঁত হতে যাবেন না। আপনি যেমন, তেমনটাতেই আপনাকে ভালো লাগে।