বিশেষ নিবন্ধ

গণতন্ত্র রক্ষায় মমতা মডেল
হারাধন চৌধুরী

কোভিড বিধি ভেঙে পার্টিতে যোগ দিয়ে জরিমানার মুখে পড়েছিলেন বরিস জনসন, তাঁর স্ত্রী এবং ঋষি সুনাক। ওই পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন মোট ৫০ জন। জরিমানার নোটিস ধরানো হয় বাকিদেরও। ঘটনাস্থল ব্রিটেন, প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন। সময়টা ২০২০-র ১৯ জুন। বরিস তখন প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী ঋষি। বরিসের জন্মদিনের পার্টি ছিল অতিসংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য। ভয়াবহ মহামারী পরিস্থিতির মধ্যে এমন আনন্দ অনুষ্ঠানের আয়োজনকে কেউই ভালোভাবে নেয়নি। প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন বিরোধীরা। তাঁরা পদত্যাগ না করলেও, মেট্রোপলিটন পুলিস নির্ভয়েই ‘পার্টিগেট’-এর তদন্ত করে। এমনকী, ২০২২-এর ১২ এপ্রিল ৫০ জনকেই ধরানো হয় জরিমানার নোটিস। এরপর প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী ঘটনাটির জন্য অনুতপ্ত বলে জানান এবং দেশবাসীর কাছে ক্ষমাও প্রার্থনা করেন।
ঋষি সুনাক এখন প্রধানমন্ত্রী। ফের জরিমানার মুখে পড়েছেন তিনি। ১০০ পাউন্ড জরিমানা দিতে হল তাঁকে। অপরাধ, সিট বেল্ট ছাড়াই গাড়ি চড়েছেন। তাঁর সাফাই, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারের উদ্দেশ্যে সরকারি প্রকল্পের একটি ভিডিও তৈরি করছিলেন। সেজন্যই কিছুক্ষণের জন্য সিট বেল্ট খুলতে হয়েছিল। কিন্তু এরপরও ব্রিটেনের পুলিস দেশের প্রধানমন্ত্রীকে রেয়াত করেনি। বিরোধী দলের কঠোর সমালোচনাও মুখ বুজে সহ্য করেছেন তিনি। ঘটনাটির জন্য ক্ষমাই চেয়ে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। একইসঙ্গে সকলের উদ্দেশে তাঁর পরামর্শ, সিট বেল্ট পরেই গাড়ি চড়ুন।
গণতন্ত্রের আসন কতটা উঁচু হলে এই জিনিস সম্ভব ভেবে দেখতে হবে। আমাদের দেশের সামান্য একজন পঞ্চায়েত সদস্য কিংবা পুর কাউন্সিলারকেও বোধহয় এইভাবে আইনে বাঁধা সম্ভব হয়নি। এই কলকাতায় প্রতিদিন দেখা যায়, বহু পুলিসকর্তার জন্যও আইন ভিন্ন। ট্রাফিক সিগন্যাল লাল দেখেও তাঁরা গাড়ি ছুটিয়ে রাস্তা পেরিয়ে যান, অনিবার্য কারণ ছাড়াই!
অথচ, আমাদের দেশের সংবিধান, আইন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা আইনের রক্ষকদের যে ক্ষমতা দিয়েছে, তা ব্রিটেনের চেয়ে কম নয়। ১৯৪৭ সালে এক ভাষণে হবু আইএএস’দের একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেন দেশের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার প্যাটেল। প্রশাসনের দায়িত্বে নিযুক্ত অফিসারদের তিনি ‘স্টিল ফ্রেম অব ইন্ডিয়া’ বলে বর্ণনা করেন। বল্লভভাই অতঃপর যা বলেন তার নির্যাস হল, স্বাধীন ভারতের সংবিধান ও আইন সরকারি অফিসারদের এমন ক্ষমতা দিয়েছে যে, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও পরোয়া করার দরকার হবে না তাঁদের। আইনে যেটা সংগত বলে মনে হবে সব অফিসার নির্ভয়ে সেইমতোই কর্তব্য পালন করবেন। তার জন্য জরুরি সতর্কবার্তা রেখেছিলেন তিনি, সিভিল সার্ভেন্টরা অবশ্যই রাজনীতিতে জড়াবেন না এবং সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে চলবেন না।
স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পেরিয়ে এসেছি আমরা। রাত পোহালেই আর একটি সাধারণতন্ত্র দিবস। তাই বৃহত্তম গণতন্ত্রের ভিতরের চেহারায় আর একবার চোখ রাখা যায়। 
আইনে একগুচ্ছ সংশোধনী এনে মোদি সরকার ২০১৮-তে নির্বাচনী বন্ড চালু করে। এই ব্যবস্থায়, যেকোনও পার্টিকে যত-খুশি চাঁদা দিতে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা ব্যাঙ্ক থেকে বন্ড কিনতে পারেন। এই চাঁদা কে, কাকে এবং কত টাকার দিচ্ছেন তা প্রকাশ পাবে না। তবে, ১০ লক্ষ এবং ১ কোটি টাকার বন্ড কেনার বহর থেকে পরিষ্কার যে ক্রেতারা মূলত কর্পোরেট সংস্থাই। বিশেষ রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করার মতলবেই তারা এমন উদারহস্ত বলে সন্দেহ দানা বেঁধেছে। ২০১৮-২০২২ সালের মধ্যে বন্ড বিক্রি হয়েছে মোট ৯,২০৮ কোটি টাকার। তার মধ্যে ৫,২৭০ কোটি টাকা বা প্রায় ৫৭ শতাংশ একাই পেয়েছে বিজেপি! উল্লেখযোগ্য দুটি বিরোধী দল কংগ্রেস এবং তৃণমূল এই প্রশ্নে যথাক্রমে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানে থাকলেও তাদের প্রাপ্তির ভাঁড়ার তুলনায় যৎসামান্য।
ভোটের ঢাকে কাঠি পড়লেই দেশময় টাকা ওড়ে! যেমন ২৩ জানুয়ারির কাগজে পড়া গেল, কর্ণাটকের এক বিজেপি নেতা ভোট-প্রতি ৬ হাজার টাকা দর হাঁকিয়েছেন। রাজ্যের এই প্রাক্তন মন্ত্রীর অভিযোগ, ভোটারদের জন্য উপঢৌকন ঘোষণা করেছে কংগ্রেস। কুড়িয়ে বাড়িয়ে তার দাম তিন হাজার টাকার বেশি নয়। শাসকদলের এই বিধায়ক বলেন, ‘আমরা কোনও উপহার এখনও ঘোষণা করিনি। তবে, মানুষের মন বোঝার চেষ্টা করছি। বিরোধীদের দ্বিগুণ টাকা আমরা দিতে পারি! ৬ হাজার করে টাকা না পেলে আপনারা বিজেপি প্রার্থীকে ভোট দেবেন না।’ এর মধ্যে নির্বাচনী বন্ডের মাহাত্ম্য খোঁজাটি অপ্রাসঙ্গিক হবে? এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, বেলগাভি গ্রামীণ কেন্দ্রের এই বিধায়ক রমেশ জার্কিহোলি এর আগের ভোটে কংগ্রেসের হয়ে গলা ফাটিয়েছিলেন। এবার দায়িত্ব পেয়েছেন কংগ্রেসের মুণ্ডপাত করার! এই ঘটনার দু’দিন আগে বুলডোজার চালাবার হুমকি শুনিয়েছেন বিজেপি-শাসিত মধ্যপ্রদেশের এক মন্ত্রী। রাঘোগড় জেলায় এক জনসভায় পঞ্চায়েতমন্ত্রী মহেন্দ্র সিং শিসোদিয়া বিরোধীদের উদ্দেশে বলেন, ‘ফের ক্ষমতায় আসবে বিজেপি’ই। আস্তে আস্তে বিজেপিতে চলে আসুন সবাই। নইলে, মামাজির (মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান) বুলডোজার তৈরি আছে। খুব সাবধান!’
অথচ এই পার্টিই পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতি করতে নেমে তৃণমূলকে ‘স্বৈরাচারী’ দেগে দেয়। নবান্নকে নাকাল করতে দীর্ঘদিন রাজভবনকেও ব্যবহার করেছে তারা। মনরেগা, আবাসসহ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্প নিয়ে দিল্লির আচরণে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা বানচাল হওয়ার জোগাড়। আবার অম্বিকেশ মহাপাত্র (কার্টুন কাণ্ড) কিংবা শিলাদিত্য চৌধুরী (কৃষক) গ্রেপ্তার ইস্যুতে রাম, বাম, অতিবাম সবাই এক পংক্তিতেই চলে আসে। কিন্তু জেলায় জেলায় মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক বৈঠকের অভিনবত্ব এবং ইতিবাচক দিক নিয়ে তারা স্পিকটি নট! দিদিকে বলো, টক টু মেয়র, দুয়ারে সরকার, পাড়ায় সমাধান, দিদির সুরক্ষা কবচ, দিদির দূত, পুরমন্ত্রীর রাজ্যজুড়ে পুরসভা সফর প্রভৃতি কর্মসূচি যে গণতন্ত্রের অত্যন্ত সৎ ও সাহসী রূপ, তাতে সন্দেহ কী? তবু বিজেপিসহ বিরোধীরা এই কর্মসূচিগুলির মতলবি  বিকৃতি করছে। সমালোচনা একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক পন্থা এবং স্বাগত। কিন্তু এই ধরনের বিকৃতি সমালোচনার গুরুত্বকেই লঘু করে দিচ্ছে। আসলে মমতার জনসংযোগ কর্মসূচি বানচাল করতেই মরিয়া বিরোধীরা।
বস্তুত এই কর্মসূচিগুলির মাধ্যমে শাসক পক্ষ সরাসরি মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। পরের মুখে ঝাল খাওয়ার বদলে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকেই জেনে নিতে চাইছে—তাদের আর কী কী চাহিদা আছে, কোন কোন সমস্যায় রয়েছে তারা ইত্যাদি। সুরাহা দেওয়ার জন্য সমস্যাগুলিই যে জানা দরকার সবার আগে। হাজার কাজ করার পরেও শত সমস্যা থাকবে। কারণ জীবনের মতোই পরিবর্তনশীল চাহিদা ও প্রয়োজন। এ এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। দিদির দূতরা গ্রাম সফরে বেরিয়ে এই প্রক্রিয়াটিকেই সচল রেখেছেন। সরকার ও শাসক দলকে এইভাবে সক্রিয় ও জনমুখী করার কথা অন্তত এই দেশে ইতিপূর্বে কেউ ভাবেননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই পদক্ষেপ যথার্থ গণতান্ত্রিক; একই সঙ্গে অভিনব, প্রশংসনীয় ও ঐতিহাসিক। অন্য দলগুলি মার খাচ্ছে ঠিক এখানেই, গতানুগতিকতার বাইরে বেরবার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি। ফলে তাদের জনবিচ্ছিন্নতার সমস্যা বাড়ছে রোজ।
গণতন্ত্রের এই চর্চা, সুস্থ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অন্তর্হিত হলে, গণতন্ত্র দুর্বল হলে কী হয়—তা আমরা দেখেছি এই বঙ্গেই, ষাট-সত্তরের দশকের দীর্ঘসময় এবং বাম জমানার শেষদিকেও। দু’বারই বেড়েছিল নকশাল কিংবা মাওবাদীদের নামে তুমুল নৈরাজ্য। এই প্রেক্ষাপটে দল এবং প্রশাসন পরিচালনার যে মডেল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সামনে এনেছেন, তা অবশ্যশিক্ষণীয়। সব মিলিয়ে বাংলায় গণতান্ত্রিক পরিসর আজ অনেকটাই চওড়া।
পশ্চিমবঙ্গ পথ দেখাতে পারে, কিন্তু একা সারা ভারতের গণতন্ত্র রক্ষা করতে পারবে না। বাংলাকে অনুসরণ করে উদ্যোগী হতে হবে সব রাজ্যকেই। সবচেয়ে বড় দায়িত্ব কেন্দ্রীয় শাসকদলের। আঞ্চলিক ক্ষেত্রের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য। ভারত পথ দেখাতে পারে, কিন্তু সেটা অনুসরণ করতে হবে প্রতিবেশী দেশগুলিকেও। বিশেষ করে‌ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে। প্রতিবেশী কোনও রাষ্ট্রে দিনের পর দিন গণতন্ত্র নস্যাৎ হতে থাকলে, ভারতও বেশিদিন তার প্রভাবমুক্ত থাকতে পারবে না। কারণ সাদার পিছনেই কালোর চলাফেরা। এমন অনুসরণ নিজে সাদা হওয়ার বাসনায় নয়, সামনের সাদাটাকেও কালো করে ফেলার জন্যে। ভারতসহ পৃথিবীর সর্বত্রই গণতন্ত্রের শত্রু বা স্বৈরাচারীরা সক্রিয়। তাদের পরাস্ত করা একার এবং একবারের কাজ নয়, এর জন্য যৌথ উদ্যোগ এবং ধারাবাহিকতার প্রয়োজন। গণতন্ত্র হল মানসিকতার ব্যাপার।‌ সাধারণতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে, আসুন, আজ সকল ভারতবাসী একযোগে গণতন্ত্রের উন্নয়নে অঙ্গীকারবদ্ধ হই।
18Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা