বিশেষ নিবন্ধ

দেউচা-পাঁচামি ও কিছু অঙ্ক
তন্ময় মল্লিক

মহম্মদবাজারের দেওয়ানগঞ্জে মেঠো রাস্তার ধারে লুলু টুডুর ছোট্ট চায়ের দোকান। দোকান নয়, ঝুপড়ি বলাই ভালো। এলাকায় বসতি তেমন নেই। গাছগাছালির ভিড়ে অরণ্যের আবহ। পাথর বোঝাই গাড়ির ড্রাইভার, খালাসিরাই তাঁর খদ্দের। তাই বিক্রিবাটা কোনওদিন ৩০০ টাকা, আবার কোনওদিন বউনি পর্যন্ত হয় না। তবুও আশি ছুঁইছুঁই লুলুবাবু প্রতিদিন দোকান খোলেন। বিঘা পাঁচেক জমি থাকলেও সেভাবে চাষ হয় না। ফলে দোকানই ভরসা। তাই কয়লা খাদানের জমি দিতে খুব একটা আপত্তি তিনি করেননি। তবে, সবচয়ে খুশি হয়েছেন তাঁর ছেলেরা। বড় ছেলে সুকুমার এখন বারাকপুরে পুলিসে চাকরির ট্রেনিং নিচ্ছেন। 
লুলুবাবু বলেন, সরকার কিছুটা জমি নিয়েছে। তারজন্য টাকাও দিয়েছে। বড় ছেলে পুলিসে চাকরির জন্য ট্রেনিং নিতে গিয়েছে। ছোটটা পড়াশোনা করেনি। বাড়িতেই থাকে। বাকি জমিটা নিয়ে ছোটটাকে একটা চাকরি দিলে ভালো হতো। আমি আর ক’দিন?
লুলুবাবুর দোকানের কিছুটা দূরেই দেউচা-পাঁচামি কয়লা প্রকল্পের বোরিং চলছে। পুলিসের সতর্ক নজরদারি সর্বত্র। লুলুবাবুর সঙ্গে কথা বলছি দেখে পাশে দাঁড়ালেন এক সিভিক ভলান্টিয়ার। দৃষ্টি তাঁর দূরপানে, কিন্তু কান ছিল আমাদের কথায়। নাম কার্তিক মারিয়া। জমির বিনিময়ে চাকরি? প্রশ্ন শুনে গর্বিত সিভিক ভলান্টিয়ার কার্তিক জানান, তিনি ফুটবলার। মার্শাল ক্লাবের হয়ে জঙ্গলমহল কাপে রানার্স হওয়ার পুরস্কার স্বরূপ তাঁর এই চাকরি। বোরিং চলছে। তাই ডিউটি এখন কয়লা প্রকল্প এলাকায়।
দেওয়ানগঞ্জের পাঁচু মুদি, যতন মুদিরা একসময় কয়লা প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, আদিবাসীদের জমি নেওয়া যাবে না। তাতে ধ্বংস হবে পরিবেশ। নষ্ট হবে ভারসাম্য। তাঁদের মুখে ছিল আরও অনেক কঠিন কঠিন কথা। সহজসরল জীবনে অভ্যস্ত বহু আদিবাসী সেই সব কথার অর্থ বুঝতেন না, তবুও বলতেন। এমনকী, ‘শহুরে বাবু’দের উস্কানিতে সরকারি অফিসারদের তাড়াও করেছেন, কখনও আটকে দিয়েছেন গ্রামে ঢোকার রাস্তা। টিভির পর্দায় সেই সব ফুটেজ দেখে উল্লসিত হতো বিরোধী শিবির। তাড়া খেয়েও প্রশাসন ভয়ে পিছিয়ে আসেনি। উল্টে প্রকল্প চালুর লক্ষ্যে হয়েছে আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। প্রশাসনের কর্তারা জমির মালিকদের বুঝিয়েছেন, তাঁদেরই জমির নীচে রয়েছে ‘কালো হীরে’র বিশাল পাহাড়। পরিমাণ প্রায় ২১ কোটি ২০ লক্ষ টন। এত কয়লা দেশের কোথাও নেই। সেই কয়লা মাটির উপর উঠলে শুধু তাঁদের নয়, বদলে যাবে রাজ্যের চেহারা। উপকার হবে দেশের। তাই তাঁদের চাকরি, জমির ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে রাজ্য সরকার। অফিসারদের কথায় আশ্বস্ত হয়েছেন যতন মুদি, পাঁচু মুদি, লুলু টুডুর মতো বহু আদিবাসী।
পাঁচুবাবু জমির টাকা পেয়েছেন। চাকরির জন্য মেডিক্যালও হয়ে গিয়েছে। বাবার সম্পত্তিতে মেয়ের অধিকার। সেই সুবাদে পাঁচুবাবুর বোনও পেয়েছেন টাকা। তাঁর পরিবারের একজন চাকরি পাওয়ার যোগ্য। সেই আবেদন জানিয়েছেন তাঁর বোন। মিলেছে আশ্বাস। পাঁচুবাবু বলেন, ‘আমাদের ভুল বোঝানো হয়েছিল। প্রকল্প হোক চাই আমরাও।’ প্রশাসনের নিরন্তর চেষ্টায় ‘বিদ্রোহী’ পাঁচুবাবুও চাইছেন, পাঁচামির কয়লা প্রকল্প হোক দ্রুত। শালবনী থেকে ফেরার পথে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কনভয়ে ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণের জের আছড়ে পড়েছিল লালগড়ে। পুলিসের মারে চিরকালের জন্য নষ্ট হয়ে গিয়েছে ছিতামণি মুর্মুর চোখ। তারপরই পুলিস লালগড় ঢোকা বন্ধ করে দিয়েছিল ভয়ে। ফলে লালগড় হয়েছিল আন্দোলনকারীদের মুক্তাঞ্চল। 
কিন্তু দেউচায়? একেবারে উল্টো পথে হেঁটেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসন। যোগাযোগ বাড়িয়েছে আরও। প্রতিবাদী জমির মালিকদের পাশে টেনেছে। তাতেই বিচ্ছিন্ন হচ্ছে গণ্ডগোল পাকানোর মাতব্বররা।
কয়লা প্রকল্প বিরোধী আন্দোলন ক্রমশই দুর্বল হচ্ছে। ফলে দিশেহারা মাতব্বরের দল আঁটছে নিত্যনতুন ফন্দি। দেউচা-পাঁচামির পাথর খাদানের বেশিরভাগই বেআইনি। তাই তার ‘ভাগ’ দিতে হয় স্থানীয়দের। রাস্তার ধারে ছোট ছোট লাঠি হাতে বসে থাকেন বাড়ির মহিলারা। পাথরের গাড়ি এলেই বাড়িয়ে দেন হাত। একেবারে ট্রাফিক পুলিসের সিস্টেম। টাকা দিতে কেউ আপত্তি করে না। তবুও দূরে গাছতলায় হাঁড়িয়ার ঠেক থেকে নজরদারি চালায় বাড়ির পুরুষমানুষ। এমন ‘টোলট্যাক্স’ আদায়ের ঠেকের সংখ্যাটা না না করে ৪০। দিনের শেষে সেই টাকা ভাগ হয়। এটা বহুদিনের প্রথা।
যারা প্রকল্প বানচাল করতে চাইছে তারা এই বিষয়টাকে দারুণভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। বলছে, ‘এখন পরিবারের সবাই খাদানের পাথর তুলিস, টাকা আদায় করিস। কিন্তু কয়লাখনি হলে সরকারের চাকরি পাবি একজন। বাকি তিনজন কী খাবি?’ এই কথায় ঘাড় নাড়ছেন গ্রামের অনেকেই। তবে ‘বেসুরো’ হলেই জুটছে ধমকি, ‘টাকার ভাগ পাবি না।’ কিছু কিছু ক্ষেত্রে কাজও হচ্ছে। প্রকল্পের এখনও যেটুকু বিরোধিতা, তা ওই ‘বখরা’ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়েই। টাকা বন্ধের হুমকিটা আদিবাসীদের শিখিয়েছে ‘শহুরে বাবুরা’ই। 
এই ‘শহুরে বাবু’দের অবস্থা ‘টিপিক্যাল প্রতিবেশী’র মতো। পাশের বাড়ির উন্নতিতে এদের গা চিড়বিড় করে। কারণে অকারণে প্রশাসনে, আদালতে নালিশ ঠোকে। আর সরকার নতুন কিছু করতে গেলেই ‘শহুরে বাবু’রা অবতীর্ণ হয় ‘সমাজ সংস্কারকে’র ভূমিকায়। খবরদারি করার জন্য স্থানীয় দু’চারজনকে খুঁজে বের করে। তারপর চলে মগজ ধোলাই। তাঁরাই হন ‘আন্দোলনের মুখ’। তাঁদের সামনে রেখে নিজেরা কলকাঠি নাড়ে পিছন থেকে। 
প্রথম প্রথম দেওয়ানগঞ্জ, হরিণসিংহা, তালবাঁধ, কেন্দ্রপাহাড়ি, নিশ্চিন্তপুর, আলিনগর প্রভৃতি এলাকার মানুষ ‘শহুরে বাবু’দের কথায় মেতেছিলেন। তাঁদের জমির নীচেই আছে কয়লা। আইন মোতাবেক সেই সম্পত্তির ষোলোআনা হকদার রাষ্ট্র। কিন্তু জমির মালিক হিসেবে তাঁদের কথার মূল্যও কম নয়। তারউপর বেশিরভাগই আদিবাসী। তাই প্রশাসন জমি স্বেচ্ছায় দেওয়ার ব্যাপারে রাজি করানোর জন্য তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় বসছে বারবার। বদলেছে সরকারি প্যাকেজও। প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে জমির মালিকরা কথা বলে বুঝেছেন, লাভবান হবেন তাঁরাও। তাই একদিন যাঁরা ছিলেন ‘প্রতিবাদী’ এখন তাঁরাই কয়লা প্রকল্পের ‘সহায়ক শক্তি’।
রঞ্জিত সর্দারের বাড়ি ধোলটিকুরিতে। প্রকল্প এলাকায় এসেছিলেন পূর্বপুরুষের কোনও জমি সেখানে আছে কি না, তার সুলুকসন্ধান করতে। রঞ্জিতবাবু বলেন, ‘বাবার কাছে শুনেছিলাম, দাদু এখানে থাকত। তাই খোঁজ নিতে এসেছি। জমি থাকলে একটা চাকরি তো হবে।’ শুধু রঞ্জিতবাবুই নন, চাকরির জন্য জমি দিতে এখন অনেকেই মরিয়া। 
কয়লার সন্ধানে চারিদিকে বোরিং চলছে। ফলে আদিবাসীদের তাড়ায় প্রশাসনের পিছু হটা দেখে যারা একদিন উল্লসিত হয়ে উদ্বাহু নেত্য করেছিল, এখন তারাও বুঝতে পারছে, আন্দোলন শেষের পথে। তবুও  চলছে শেষ চেষ্টা। হাবড়া পাহাড়ি, জেটকেপাড়া, পাথরপাড়া, পলাশবনী সহ যেসব এলাকায় প্রকল্প হবে না, সেখানকার লোকজনকে তাতানোর কাজ চলছে। তাঁদের জমি নেই। তাই নেই বাধা দেওয়ার ‘নৈতিক অধিকার’ও। কিন্তু তাঁরা আদিবাসী জনজাতির মানুষ। তারই সুযোগ নিচ্ছে ‘শহুরে বাবু’র দল। এখানে বোঝানোর কৌশল অবশ্য ভিন্ন। বলছে, ‘যাদের জমি আছে, তারা না হয় চাকরি পাবে। কিন্তু তোরা কী করবি?’ প্রকল্প এলাকার বাইরের মানুষগুলিই এখন ‘শহুরে বাবু’দের বল-ভরসা।
সিঙ্গুরে গাড়ি কারখানার কাজ ৮০ শতাংশ হওয়ার পরেও টাটাদের চলে যেতে হয়েছে। নন্দীগ্রামে সালিমদের জন্য জমি অধিগ্রহণের নোটিস জারির পর এক কদমও এগতে পারেনি। দু’টি প্রকল্পেই স্থানীয় মানুষের সমর্থনের বদলে ছিল সরকারের আস্ফালন। তাই প্রতিবাদ হয়েছিল পদে পদে। আর তাতে রক্ত ঝরেছে প্রচুর, কিন্তু প্রকল্প হয়েছে ব্যর্থ। সেই জ্বালা এখনও বাম নেতৃত্ব ভুলতে পারেনি। রাবণের চিতার মতো জ্বলছে প্রতিহিংসার আগুন। তাই মমতার প্রকল্প বানচালের চেষ্টা চলে পদে পদে। 
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। সেই জন্য পুলিস দিয়ে প্রতিবাদীদের দমনের চেষ্টা করেননি। তাঁরই নির্দেশে লাঠি, বন্দুক ছেড়ে অফিসাররা জমির মালিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন বারবার। আন্দোলনকারীদের মুখ্যমন্ত্রী বার্তা দিয়েছেন, উন্নতি হবে তাঁদের সঙ্গে নিয়েই। আর তাতেই গলেছে বরফ। তার জন্য অবশ্য তাঁকে দিতে হয়নি ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’এর স্লোগান।
20Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা