বিশেষ নিবন্ধ

শরিকি মেহফিলে এবার মুজরো কার?
হিমাংশু সিংহ

নরেন্দ্র মোদি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেয়েছেন, এটা এখন সারা বিশ্বের জানা। চোখ ধাঁধানো মন্দির গড়েও উত্তরপ্রদেশে বিপর্যস্ত হয়েছেন, তাও অজানা নয়। কিন্তু যেটা আজানা, তা হচ্ছে জোট সরকারে দ্রুত রং বদলে ফেলা শরিকদের মেহফিলে ‘বিশ্বগুরু’র ‘মুজরো’টা শুরু হতে কতটা সময় লাগবে? মঞ্চ প্রস্তুত। আজ সন্ধ্যার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের গাম্ভীর্য, তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গৌরবকে দুয়ো দিয়েই শুরু হয়ে যাবে দরকষাকষির নির্মম পুতুলনাচ! তাঁর ভাষায় ‘মুজরো’। একমাস, দু’মাস, ... ১৩ মাস। ভোটপ্রচারে ইন্ডিয়া জোটকে ওই শ্লেষ মেশানো ইতর শব্দবন্ধেই কটাক্ষ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। যতই প্রচার এগিয়েছে তিনি টের পাচ্ছিলেন গনগনে আঁচেও ভাত সেদ্ধ হচ্ছে না কিছুতেই। ৪০০ আসন, গগনভেদী উন্নয়নের ডঙ্কা থামিয়ে ততই বেপরোয়া ঘৃণা আর বিদ্বেষের একতরফা মার্কেটিং চালিয়ে গিয়েছেন প্রাণপণে। ধর্ম, জিরাফ ও জাতপাত নিয়ে সর্বনাশা গেরুয়া খেলা খেলেও শেষরক্ষা হয়নি। ২১ এপ্রিল রাজস্থানে তাঁর ‘কংগ্রেস এলে মঙ্গলসূত্রটাও বাঁচবে না’, শুনে চমকে উঠেছিলেন ভক্তরাও। ফল বেরতে দেখা গেল, মঙ্গলসূত্র সুরক্ষিতই আছে, শুধু একক গরিষ্ঠতার রক্ষাকবচটা হারিয়ে তিনিই বিপন্ন! মোদিজির মতো অতল বিদ্বেষ বুকে নিয়ে সংখ্যার জোরে তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হলেও কি আদর্শ রাষ্ট্রনেতা হওয়া যায় ভারতের মতো বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের দেশে? মেরুকরণের দমবন্ধ পরিবেশে ঈশ্বর, আল্লা, মানুষ কেউ নিশ্বাস নিতে পারে? ভাগ্যের এমনই পরিহাস, ৫০০ বছর পর তাঁর কৃপায় ঘর পাওয়া ভগবান রামলালা সেই গিরগিটি শরিকদের মধ্যিখানেই কঠিন ভারসাম্যের খেলায় নামালেন তাঁকে। যেন অস্ফুটে মুচকি হাসলেন নবতিপর অশক্ত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। স্বস্তি পেল বাজপেয়ি-আদবানির আমল থেকে সবাইকে নিয়ে চলার ব্রতে অনড় পুরনো বিজেপির গুমরে মরা অন্তরাত্মাও।
গত রবিবার লিখেছিলাম ৪ জুন সব উত্তর মিলিয়ে নেওয়ার পালা—৪০০ পার, না ২০০ পেরিয়েই ফুলস্টপ? শেষ পর্যন্ত গরিষ্ঠতার থেকে ৩২ আসন দূরে থেমে গেল গেরুয়া দৌড়। এক্সিট পোল নয়, কোনও ড্রইংরুমের বানানো ন্যারেটিভ নয়, নয় টিভি চ্যানেলের সান্ধ্য মজলিশের হেলে থাকা একপেশে নির্যাস। নিখাদ জনতার স্পষ্ট  জবাব। স্যাম্পেল সাইজ পুচকে দশ-বিশ লাখ নয়, শামিল এবারের ৬৪ কোটি ভোট দেবতার সবাই (তালিকাভুক্ত ৩২ কোটি মানুষ নির্বাচনে অংশ নেননি)। ফল ঘোষণা করেছে অ্যাক্সিস কিংবা সি-ভোটার নয়, নয় কোনও ভাঁওতাবাজ পোলস্টার, স্বয়ং দেশের নির্বাচন কমিশন। সেই ঐতিহাসিক জবাব একদিকে যেমন বাংলায় মমতার নিরঙ্কুশ আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠা করেছে, যার ধাক্কায় খড়কুটোর মতোই উড়ে গিয়েছে বাংলার বিরোধীরা। একদম একুশের বিধানসভার রিপ্লে। তেমনই জাতীয় স্তরে একদলীয় শাসনকে ছেঁটে দিয়ে ফের জোট সরকারের পক্ষেই রায় দিয়েছে জনতা জনার্দন। ভারত মাতার বিপন্ন আত্মার অসহায়তা, সংবিধানের কাঠামোগত বদলের ষড়যন্ত্র কিংবা ভোট রাজনীতিকে চিরতরে বিদায় দিয়ে ব্যক্তিশাসন প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে সেই জরুরি অবস্থার সময় থেকেই মানুষ সোচ্চার। সেই অভিঘাতেই এক দশকের মোদি সরকার মেদ ঝরিয়ে বদলে যাচ্ছে একদা আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলা এনডিএতে। গত দশ বছর, যাঁর দাপটে জোটের নিয়মিত বৈঠক দূর, খোদ বিজেপির শীর্ষস্থানীয় দু’-চারজন বাদ দিলে কারও কথারই কোনও গুরুত্ব ছিল না, তাঁকেই এবার হিসেব ফিরিয়ে দেওয়ার পালা। গাদকারি, রাজনাথ, বসুন্ধরারা এতদিন ছিলেন দর্শকমাত্র! নোট বাতিলের কথা ক’জন জানতেন? বহু গুরুত্বপূর্ণ বিল এসেছে, যার কথা সংসদে ঢুকেই জানতে পেরেছেন দলেরই সাংসদরা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তা পাশও হয়ে গিয়েছে। একনায়কতন্ত্র যখন আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে বসে তখন সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার রেওয়াজ রাতারাতি উবে যায়, বরং সিদ্ধান্তে পৌঁছে তা এলেবেলে পাঁচজনকে জানিয়ে দেওয়াটাই হয়ে ওঠে অঘোষিত আইন। মোদির ঔদ্ধত্য ও দম্ভ বিজেপিকে কার্যত ওয়ান ম্যান পার্টিতে পরিণত করেছিল। সেই অন্ধকার কাটিয়ে ভোটের এই সাহসী পরিণাম দলেও একটা ভারসাম্য ফেরাতে সাহায্য করবে বলেই বুক বাঁধছেন বিক্ষুব্ধরা।  
নিজের নামে দেশ চালাতে চেয়েছিলেন মোদিজি। বিদেশের মাটিতে গুঞ্জরিত হবে একটাই ধ্রুবপদ, ‘ইটস মোদিজ কান্ট্রি’। দল, সরকার সব মিলেমিশে একাকার হয়ে দেশের দশের বিশ্বগুরু হয়েই থেকে যাবেন স্বাধীনতার শতবর্ষ ২০৪৭ সাল পর্যন্ত। এই ছিল তাঁর স্বপ্ন। বাকি সব অতীত, ইতিহাস মিছে, ঘোর লাগা কানাগলির মতো। তাই গত আড়াই মাসে 
বেকার যুবক-যুবতীদের রুটিরুজির দিশা না দিয়ে তিনি শুধু নিজের গুণকীর্তন করে গিয়েছেন দেশঘুরে ২০৬টি জনসভায়। গালভরা ‘গ্যারান্টি’ বিলিয়েছেন অকাতরে। সবার মুখ বন্ধ করতে দরকার ছিল ৪০০ আসন। এই সর্বনাশা খেলায় নেহরু থেকে গান্ধী, কাউকেই রেয়াত করেননি তিনি। নেহরুকে মোছার সব আয়োজন ছিল সারা। আর তিনি নিজমুখে বলেছেন, গান্ধীজিকে তো বিশ্ব চিনেছে সিনেমাটা বেরনোর পর! ভারতের মহান গণতন্ত্র বার বার প্রমাণ করেছে, ব্যক্তির চেয়ে দেশ বড়। একনায়কের চেয়ে গুরুত্ব 
বেশি সমষ্টির। তাই নেহরু যা পারেননি, ইন্দিরা যা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন, সেই একই পরিণাম দেশ ফিরিয়ে দিল নরেন্দ্র মোদিকে। গত দশ বছরের একদলীয় সরকার পর্যবসিত হল বারো উঠানের এনডিএ জমানায়। 
দুই ‘পাল্টুরাম’ নীতীশ কুমার এবং চন্দ্রবাবু নাইডুর কাঁধে ভর দিয়ে সংখ্যালঘু বিজেপির পক্ষে এই সরকার চালানো মোটেই সহজ হবে না। কারণ সকাল-সন্ধ্যা উঠতে-বসতে নীতীশ ও চন্দ্রবাবুর দাবি সনদ এবং লুকনো এজেন্ডা মাথা খারাপ করে দেবে বিজেপির। তাঁরা হুমকি দিয়ে যাবেন—শাঁসালো মন্ত্রক এবং বিহার ও অন্ধ্রপ্রদেশের জন্য বিশেষ প্যাকেজ, বড় কেন্দ্রীয় প্রকল্প না দিতে পারলেই সমর্থন প্রত্যাহার। শপথ নেওয়ার আগেই দাবি উঠেছে—অগ্নিবীর প্রকল্প তুলে দিতে হবে এবং চালু করতে হবে জাতিগত সমীক্ষা। রাজনৈতিক মহলের সংগত আশঙ্কা, দাবি না মানলেই অনর্থ নিশ্চিত। অনাস্থা প্রস্তাব এবং শেষে আস্থাভোট। অর্থাৎ সরকারের প্রথম কাজ হবে নতুন বন্ধু খোঁজা। বলা বাহুল্য, অনেকদিন পর সেই পুরনো শব্দবন্ধগুলি ফিরছে সংসদীয় ব্যবস্থায়। ভুললে চলবে না, নীতীশ গত দশ বছরে কতবার শিবির বদল করেছেন, তা তাঁর নিজেরই সম্ভবত মনে নেই। যে ইন্ডিয়া জোট আজ বিরোধী আসনে তাঁরও অন্যতম স্থপতি তিনিই। বেশিদিনের পুরনো নয়, মাত্র এক বছর আগের কথা—একদম শুরুর আহ্বায়ক ছিলেন নীতীশ। আর চন্দ্রবাবু নাইডু তো আরও ভয়ঙ্কর—যে শ্বশুর এন টি রাম রাওয়ের হাত ধরে তাঁর উত্থান, পিছন থেকে তাঁকেও ছুরি মারতে হাত কাঁপেনি তাঁর! জেল থেকে ফিরেছেন কিছুদিন আগে, এখন গুলি-খাওয়া বাঘ। মাত্র চারটি আসন জেতা চিরাগ পাসোয়ানও গুরুত্বপূর্ণ ক্যাবিনেট পদমর্যাদাসহ একাধিক মন্ত্রক দাবি করেছেন। স্বভাবতই এই সরকারকে পাঁচ বছর টিকিয়ে রাখাই এখন মোদি-শাহের প্রথম চ্যালেঞ্জ। তারপর অন্য এজেন্ডা।  সেইসব বাধা কাটিয়ে এক দেশ এক নির্বাচন, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি এবং হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার বাসনা সম্ভবত এযাত্রায় অধরাই থেকে যাবে। সেই ‘আমি আমি’ করা গুজরাতি সন্তানকে সরকার বাঁচাতে এবং দলের স্বার্থে এবার কট্টর হিন্দুত্ব ও সঙ্ঘের পথ ছেড়ে জোটধর্ম শিখতে হবে। পদে পদে সমঝোতা করেই এগতে হবে তাঁকে। এখন নীতীশ, চন্দ্রবাবুর বিরুদ্ধে ইডি লাগান দেখি! দিল্লিতে অমিত শাহ ও অনুগত গুজরাতি আমলাদের একতরফা মস্তানির দিন শেষ।
ভারত কোনওদিনই এত ঘৃণা চায় না। তারা শান্তি ও সহাবস্থান চায়। এটাই তাদের ডিএনএ। মন্দিরে তারা ভগবানের নাম করতে যায়, দমন-পীড়নের জন্য নয়। ‘জয় শ্রীরাম’ হুঙ্কার দিয়ে কাউকে ভয় দেখানো কিংবা নিজের ক্ষমতা জাহির ধর্মীয় অস্ত্র হতে পারে না। প্রমাণ হয়ে গেল, মন্দির দিয়ে ভোট জেতা যায় না। না-হলে ২২ জানুয়ারির রামমন্দিরের উদ্বোধনের ভক্তিস্রোত তো ভাসিয়ে নিয়ে যেত উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন। কিন্তু মানুষ জবাবে বলল, এটা রামকে শ্রদ্ধা জানানোর পথ নয়। ৫০০ বছর পর ভগবান ঘর পেলেন ঠিকই কিন্তু গোটা প্রক্রিয়ায় কোথাও ভয়ঙ্কর ভুল ছিল। মন্দিরকে ছাপিয়ে আড়াল থেকে যদি কোনও ব্যক্তি মাথা তুলতে চান তাহলে অলক্ষ্যে সর্বশক্তিমান হাসেন। তাই ফৈজাবাদে উচিত শিক্ষাই পেয়েছে বিজেপি। খোদ রামমন্দিরের লোকসভা কেন্দ্রেই গেরুয়া শক্তির পরাজয় সেই ঔদ্ধত্যেরই জবাব বইকি। মোদিজিও সম্ভবত ভাবছেন—কুড়িবার তামিলনাড়ু আর কেরলে না গিয়ে সেই এনার্জিটা যদি উত্তরপ্রদেশে ব্যয় করতেন, যদি অমিত শাহরে বাড়বাড়ন্তে যোগীজি হতোদ্যম হয়ে পিছন থেকে সুতোটা না টানতেন! ক্ষমতার দম্ভে পাগল হয়ে মহারাষ্ট্র রাজনীতিকে এতটা ঘেঁটে ফেলার খুব প্রয়োজন ছিল কি? আসলে ক্ষমতা এমনই এক বিষম বস্তু যে সহজেই মাথায় চড়ে বসে। তখন আর ভারসাম্য কাজ করে না। ৪০০ পারের স্বপ্ন অথচ উপেক্ষিত থেকে গিয়েছে যোগীরাজ্যই। সেই ছিদ্র দিয়ে ঢুকেই সাপ কেটেছে লখিন্দরকে! এখন ধাক্কা খাওয়ার পর দু’শো যদি আর কিন্তুর ভিড়ে যেন আসল কারণটা হারিয়ে না যায়। তাহলে আরও বিপদ অপেক্ষা করছে।
ভারতের ইতিহাসে বারে বারে শক হূন দল পাঠান মোগল আক্রমণ শানিয়েছে। কিন্তু ভারতাত্মা সব প্রতিকূলতাকে সহ্য করে জয়ী হয়েছে। এবারও দেশের এই ক্রান্তিকালে তার কোনও ইতরবিশেষ হল না। মোদিজি ভারতের সনাতন ভ্রাতৃত্ব, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সবাইকে আপন করে নিয়ে চলার পথ থেকে বাঁক নেওয়ার যে দুঃস্বপ্ন মনে ধরেছিলেন তা ধুলোয় গড়াগড়ি খেল। জয় হল ভারতীয়ত্বের, জয় হল মহান সংবিধান ও গণতন্ত্রের। ব্যক্তি এখানে তুচ্ছ। এটাই চব্বিশের নির্বাচনের শিক্ষা।
3Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

আর্থিক উন্নতি ও গৃহসুখ বৃদ্ধি। বস্ত্রাদি ও বিবিধ অলঙ্কারাদি ব্যবসার গতি বৃদ্ধি ও মানসিক তৃপ্তি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮২.৮৩ টাকা৮৪.৫৭ টাকা
পাউন্ড১১০.২৬ টাকা১১৩.৮৫ টাকা
ইউরো৯১.৭১ টাকা৯৪.৯১ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা