ইতিহাসের সাক্ষী থাকার মধ্যরাতে (১৪ আগস্ট পেরনো) বর্বরোচিত হামলা চলল আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সরকারি হাসপাতালের মধ্যে একজন ডাক্তার-পড়ুয়া তরুণীকে ধর্ষণ করে নৃশংসভাবে খুন করার ঘটনায় যখন লজ্জা-ঘৃণা-ক্ষোভ উগরে দিতে পথে নামে টালা থেকে টাইম স্কোয়ার, তখন এই নির্বিচার তাণ্ডব যেন মহিলাদের নিরাপত্তার প্রশ্নটিকে আরও বেআব্রু করে দিল। তাহলে কি সত্যিই রাস্তাঘাট-কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের নিরাপদে থাকাটা নিশ্চিত করতে পারবে না সমাজ-প্রশাসন? সপ্তাহখানেক আগে এক ঘুমিয়ে থাকা শহরে এই সরকারি হাসপাতাল চত্বরেই ওই চিকিৎসক তরুণীকে পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। এরই প্রতিবাদে দেশ স্বাধীন হওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণের সেই রাতে পথের দখল নিয়েছিল মানুষ, গর্জে উঠেছিল নারীরা। শুধু কলকাতা বা রাজ্য নয়, ‘জাস্টিস ফর লেডি ডক্টর’, ‘জাস্টিস ফর আর জি কর’-এর দাবি তুলে দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, পুণের মতো দেশের প্রায় সব বড় শহর মাঝরাতে রাস্তায় নেমেছিল। আন্দোলনে পা মিলিয়েছেন আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডার ভারতীয়রাও। সুবিচার চেয়ে লক্ষ-কোটি মানুষের এমন স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের আস্ফালন এই মহানগর তো বটেই, গোটা দেশও আগে কখনও দেখেছে কি না তা নিয়ে অতীত হাতড়ানো শুরু হয়েছে। কিন্তু এমন এক ইতিহাস তৈরির রাতে সেই সরকারি হাসপাতালেই বেপরোয়া তাণ্ডবের ঘটনা এই তিলোত্তমাকে যেন আরও কলঙ্কিত করে তুলল। আরও জোরালো কণ্ঠে প্রশ্ন উঠল, নিরাপত্তা কি তাহলে সোনার পাথরবাটি?
মাত্র ছ’ দিনের ব্যবধানে দুটি পৃথক ঘটনা। কিন্তু প্রশ্ন একটাই, কে বা কারা এই ঘটনা ঘটাল? কী তাদের উদ্দেশ্য ছিল? তরুণীকে ধর্ষণ করে খুন বা হাসপাতালে ভাঙচুর— দুটি ঘটনাই যে পূর্ব পরিকল্পিত, তা পরপর দৃশ্যগুলো সাজালেই বোঝা যায়। দুর্ভাগ্যের হলেও সত্যি, দুটি ক্ষেত্রেই পুলিসের ভূমিকা নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন উঠেছে। চিকিৎসক পড়ুয়ার খুনের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত বলে পুলিস যাকে গ্রেপ্তার করে, সেই সিভিক ভলান্টিয়ার একজন বহিরাগত হওয়া সত্ত্বেও কী করে ওই রাতে হাসপাতালে একাধিকবার ঢুকল-বেরল, সেই সঙ্গত প্রশ্ন ইতিমধ্যেই উঠেছে। আর ১৪(পেরনো)-১৫ আগস্ট মধ্যরাতে হাসপাতালে ভাঙচুরের সময় পুলিসের ভূমিকা নিয়ে শুধু প্রশ্ন নয়, অন্য সন্দেহও দানা বেঁধেছে। কড়া নিরাপত্তায় মোড়া হাসপাতালে ৩৫-৪০ জন দুষ্কৃতী রীতিমতো মারমুখী মেজাজে ঢুকে পড়ল, তারপর প্রায় ৪০ মিনিট ধরে যথেচ্ছ ভাঙচুর চালাল, আর অভিযোগ, পুলিস ঘটনাস্থল থেকে বেবাক উধাও! তাদের কেউ কেউ হাসপাতালের বাথরুমে, ওয়ার্ডে গা ঢাকা দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করল, এই দৃশ্য হজম করা কঠিন। যাদের উপর নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব ছিল, সেই পুলিসের এমন ময়দান ছেড়ে পালানোর চেষ্টা দেখে বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না। যদিও দুষ্কৃতী তাণ্ডবে সবকিছু তছনছ হয়ে যাওয়ার পর পুলিসের ‘সক্রিয়তা’ লক্ষ করা যায়! মোদ্দা কথা, আর জি করকে ঘিরে কয়েক দিন যে ঘটনা ঘটে চলেছে তার দায়িত্ব কলকাতা পুলিস অস্বীকার করতে পারে কি? সংবাদ মাধ্যমকে পুলিস বা পুলিস কমিশনার শূলে চড়ালেও তা পারে না।
সন্দেহ নেই, আর জি করের ঘটনা ব্যতিক্রম। এবং সেই কারণেই এর আঁচ গোটা দেশের সরকারি হাসপাতালগুলিতে ছড়িয়ে পড়েছে। আর জি করের ঘটনা এক অর্থে নজিরবিহীন বলেই এ রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলি তাদের নিজেদের মতো করে পরিস্থিতি থেকে ফায়দা তোলারও চেষ্টা করছে। কিন্তু এই প্রতিবাদের সময়কালে চিকিৎসকদের কাছে আরও একটা ভূমিকা প্রত্যাশা করে সমাজ। যে মেয়েটি বড় ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বাঁচতে চেয়ে অকালে চলে গেল, অসুস্থকে সেবা করাই কিন্তু তার এক ও একমাত্র লক্ষ্য ছিল। মৃত্যুর আগেও সেই কাজেই ডুবে ছিল মেয়েটি। কিন্তু সেই পরিষেবাই প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বন্ধ রয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার অসুস্থ মানুষ প্রায় বিনা চিকিৎসায় ফিরে যাচ্ছেন। হয়তো কারও মৃত্যুও ঘটছে, যা কাম্য নয়। আন্দোলনকারীদের দাবিদাওয়াও অযৌক্তিক নয়। হাসপাতালের নিরাপত্তা, মহিলাদের নিরাপত্তার জন্য লড়াই জারি থাকুক। তা আরও বৃহত্তর চেহারাও নিতে পারে। পাশাপাশি দুটি পৃথক ঘটনার তদন্তেই প্রকৃত দোষীরা কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি পাক—সেই দাবিও জোরালো থাক। কিন্তু চিকিৎসকের রাজধর্ম পালন করে অসুস্থদের সেবার কাজ ফের পুরোমাত্রায় শুরু করলে বহু মানুষ উপকৃত হবেন। ডাক্তারদের পাশে দাঁড়ানো সমাজ সেটাও সমানভাবে চায়। মনে রাখা প্রয়োজন, পানীয় জলের মতো চিকিৎসা পাওয়ার অধিকারও মানুষের আছে।