হেঁসেলকে হাতিয়ার করে হনলুলু থেকে হংকং, হায়দরাবাদ থেকে হাতিবাগান, সাততারা হোটেল বা সাবেক পলেস্তরা খসা রেস্তোরাঁ, প্রায় সব জায়গাতেই এখন মহিলারাও পুরুষ শেফদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রসনা-বিপ্লব ঘটাচ্ছেন। এই বদলে যাওয়া ছবিটাক বেশ তারিয়ে তারিয়ে ঝাল আচার খাওয়ার মতো উপভোগ করছেন অপরাজিতা আঢ্য। জি বাংলার ‘রান্নাঘর’-এর গিন্নি ওরফে সঞ্চালক। তেরো পার করে চোদ্দয় পড়ল ‘রান্নাঘর’। সময়ের নিরিখে ঐতিহাসিক এই কুকারি শো’য়ে তৈরি হয়েছে প্রায় ছ’হাজার রকমের পদ। দেশি-বিদেশি, আটপৌরে-সাবেক, স্পাইসি-সাদামাটা হরেকরকম পদের মনমাতানো স্বাদ দিয়ে বাঙালির হেঁসেলকে বৈচিত্রময় করে তুলেছেন যাঁরা, তাঁদের বেশিরভাগই মহিলা রন্ধনশিল্পী। তাই পক্ষকাল ধরে চলা রান্নাঘরের ‘জন্মদিন জমজমাট’ পর্বে অপরাজিতার হেঁসেলে হাজির হয়েছিলেন শহরের নামিদামী রেস্তরাঁর পুরুষ শেফদের পাশাপাশি মহিলা শেফ তথা রন্ধন বিশেজ্ঞরাও। তালিকাটা নেহাত মন্দ নয়। ডোমা ওয়াঙ্গ, মনজিলাৎ ফতিমা, বিপাশা মুখোপাধ্যায়, শর্মিষ্ঠা দে, শুক্লা মুখোপাধ্যায়, দীপান্বিতা ভাটিয়া, মধুমিতা মোহান্ত প্রমুখ। সুতরাং, পোশাদারি হেঁসেলে পুরুষ শেফদেরই রাজত্ব, এই তত্ত্বটা ক্রমশ ক্লিশে হতে শুরু করেছে বলে মনে করেন অপরাজিতা। তিনি গত একবছর ধরে এই কুকারি শো’ র হোস্ট। বলেন, ‘এতদিন জানতাম বাড়ির হেঁসেল মানে ঠাকুমা, মা, কাকিমাদের সাম্রাজ্য। আর বড় বড় হোটেল রেস্তরাঁর রাঁধুনে মানে মাথায় লম্বা টুপিওলা পুরুষ। এই কথাটা এখন আর খাটছে না। শরীরে রীতিমতো অ্যাপ্রন জড়িয়ে রকমারি পদ আর মনমাতানো স্বাদে রসনায় ঝড় তোলা নানা খাবার তৈরি করে দেশে বিদেশে ভোজন রসিকদের মাত করছেন মেয়েরাও। মহিলারা এখন সাততারা হোটেলের শেফ।’
অপরাজিতার ‘রান্নাঘর’-এ পা দিতেই নাকে ভেসে এলো জিভে জল আনা রান্নার সুগন্ধ। ক্যামেরার সামনে অপরাজিতাকে পাশে নিয়ে তখন সাবেক নেপালি রান্না রেঁধে দেখাচ্ছিলেন ডোমা ওয়াঙ্গ। কালিম্পঙের মেয়ে ডোমা বিবাহ সুত্রে চৌত্রিশ বছর কলকাতায় কাটিয়ে এখন পুরোদস্তুর বাঙালি। বাংলাটাও ঝরঝরে। পাঁচফোড়ন আর সরষের তেলে মজেছেন বাঙালিদের দেখেই। রান্নায় নুন ছড়িয়ে দেন আঙুলে করে। কিন্তু ভুলতে পারেননি পাহাড়ি প্রদেশের কান লাল করা ঝালের ব্যবহার। পাহাড়িদের অতিরিক্ত ঝাল খাওয়ার কারণ হিসেবে এক চমকপ্রদ গুপ্ত কথা শোনালেন ডোমা। চড়াই-উৎরাইয়ে ভরা ভূমিতে কাজ করতে গিয়ে যাতে শরীরে না ক্লান্তি গ্রাস করে, তাই পাহাড়ি মানুষগুলি ঝাল রান্না খেয়ে স্নায়ুগুলোকে উত্তেজিত করে রাখেন। ডোমা রাঁধলেন নেপালি ঝাল আলুর দম, আলুর থুপ্পা প্রভৃতি।
‘মনে অহংকার ছিল, আমি খুব ভালো রাঁধুনি। কিন্তু এখানে এসে বুঝলাম আমি অনেককিছুই জানি না। কত রান্না যে শিখলাম।’ স্বীকারোক্তি অপরাজিতার। যোগ করেন, ‘অনেক পুরাতনী বা সনাতনী রান্না, যা আজ বাঙালির হেঁসেল থেকে উধাও হয়ে গেছে, সেই রান্নাগুলোকেও পুঁথি ঘেঁটে উদ্ধার করা হয় এখানে। আসলে রান্নাটা একটা শিল্প। জোগাড় থেকে শুরু করে পরিবেশন পর্যন্ত সবেতেই একটা আর্ট আছে।’ ‘গাইতে গাইতে গায়েন হয়েছি, রাঁধতে রাঁধতে রাঁধুনি। কিন্তু বিশ্বের যে প্রান্তেই যাই না কেন, ডাল-ভাত আমার চাই-ই চাই।’ বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার মতো ঠোঁটে হাসি ছড়িয়ে পড়ে অপরাজিতার। কর্মব্যস্ত জীবনের ‘স্ট্রিটফুড’ প্রিয় মানুষদের প্রতি অপরাজিতার পরামর্শ, ‘যত ব্যস্ততাই থাক, বাড়িতে একটু ডাল-ভাত ফুটিয়ে নিন। শরীরটাই তো আসল। ওটা ঠিক না থাকলে সবই যে অর্থহীন হয়ে যাবে।’
প্রিয়ব্রত দত্ত ছবি: ভাস্কর মুখোপাধ্যায়