সঠিক বন্ধু নির্বাচন আবশ্যক। কর্মরতদের ক্ষেত্রে শুভ। বদলির কোনও সম্ভাবনা এই মুহূর্তে নেই। শেয়ার বা ... বিশদ
শেষ আদমসুমারি অনুসারে বর্তমানে ভারতে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা প্রায় ১১ কোটি, যা সমগ্র জনসংখ্যার ৮.৫৮ শতাংশ। ভারতবর্ষের প্রবীণ জনসংখ্যাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়।
১. নবীন-প্রবীণ (৬০ বছর থেকে ৬৯ বছর)—যাঁরা তুলনামূলকভাবে সুস্থ, কর্মক্ষম, এখনও পরিশ্রম করতে সক্ষম এবং মানসিকভাবেও বেশ প্রখর।
২. মধ্য-প্রবীণ (৭০ বছর থেকে ৭৯ বছর)—তুলনামূলকভাবে নবীণ প্রবীণদের তুলনায় কর্মক্ষমতায় কিছুটা কম হলেও, এঁরাও মোটামুটি নিজেদের কাজ নিজেরাই করতে সক্ষম। কিছু ব্যতিক্রম আছে অবশ্যই, যেখানে কিছু কিছু মধ্য প্রবীন শারীরিক সমস্যার কারণে অন্যের উপর নির্ভরশীল। যদিও বর্তমানে প্রচুর এই বয়সি প্রবীণ সম্পূর্ণ সুস্থ এবং কর্মক্ষম জীবনযাপন করেন, যা কয়েক দশক আগেও দেখা যেত না।
৩. প্রবীণ-প্রবীণ (৮০ বছর ও তার উর্দ্ধ)—এই বয়সে মানুষ মূলত বেশ কিছু বার্ধক্যজনিত বা অন্যান্য কারণবশত নানা শারীরিক সমস্যায় ভোগেন। কর্মক্ষমতাও হ্রাস পায়। মানসিক ক্ষমতাও হ্রাস পেতে থাকে এবং অনেকেই অন্যের উপর বা ‘কেয়ার গিভার’ নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।
পরিসংখ্যান বলছে প্রবীণদের মধ্যে দেড় কোটি মানুষ সম্পূর্ণ একা। শুনতে অবাক লাগলেও ভারতে বর্তমানে শতায়ু প্রবীণ মানুষের সংখ্যা ছয় লক্ষাধিক। একইভাবে ৯৫ থেকে ৯৯ এর মধ্যে রয়েছেন আরও ছয় লক্ষ। ৮০ বছর ও তদুর্ধ প্রবীণ মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ১৩ লক্ষের বেশি (০.৯৩ শতাংশ), ৬০ থেকে ৬৯ বছর বয়সি রয়েছেন ৬ কোটি ৪০ লক্ষের বেশি (৫.২৯ শতাংশ) আর ২ কোটি ৮৪ লক্ষের (২.৩৫ শতাংশ) বেশি প্রবীণ মানুষের বয়স ৭০ থেকে ৭৯ বছরের মধ্যে।
ইউ এন পি এফ-এর ২০১২ সালে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৮০ বছর ও তদুর্ধ প্রবীণ মানুষ সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে অন্যের উপর নির্ভরশীল স্নানের জন্য ২২.১ শতাংশ, পরিধানের (ড্রেসিং) জন্য ১৩ শতাংশ, শৌচকার্যের জন্য ১৫.৬ শতাংশ, গতিশীলতা বা মোবিলিটির জন্য ১১.৪ শতাংশ, ইনকন্টিনেন্স-এর জন্য ১০.১ শতাংশ, খাদ্যগ্রহণের জন্য ৬.৮ শতাংশ। অথচ সে তুলনায় দেখভালের জন্য ‘কেয়ার গিভার’-এর সংখ্যা একেবারেই অপরিমিত। আর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত-এর সংখ্যা তো প্রায় নেই বললেই চলে।
প্রবীণদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ এর অভিজ্ঞতার নিরিখে এই বিষয়টি আরও উপলব্ধি করেছি। দেখেছি প্রচুর বয়স্ক মানুষ একা থাকেন, অথবা দেখার কেউ নেই। দু’দণ্ড কথা বলবার লোক নেই। তাই শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও তারা বিধ্বস্ত। তাহলে এর প্রতিকারের উপায় কী? মনে রাখবেন এটা শুধু মাত্র বয়স্ক মানুষদের সমস্যা ভাবলে ভুল হবে। এটা কিন্তু সামাজিক সমস্যা। ভাবতে হবে সবাইকে এবং আগে থেকেই।
কী এই টাইম ব্যাঙ্ক?
এটি আসলে এমন এক ব্যাঙ্ক যেখানে টাকা নয়, জমা হয় সময়/টাইম। প্রবীণদের, বিশেষত ‘প্রবীণ - প্রবীণ’দের জন্য, যাঁরা অন্যের উপর নির্ভরশীল, তাঁদের জন্য যে কোন ব্যক্তি, যাঁরা স্বেচ্ছাশ্রম দিতে চান, এমনকী কমবয়সি প্রবীণ যাঁরা শারীরিক ভাবে কর্মক্ষম, তাঁরা দৈনিক/সাপ্তাহিক একটি নির্দিষ্ট সময় ব্যয় করতে পারেন। সেই সময়টি তাঁর ‘টাইম ব্যাঙ্ক’-এ জমা হবে। বছরের শেষে মোট জমা হওয়া সময়ের ভিত্তিতে তাঁকে দেওয়া হবে ‘টাইম ব্যাঙ্ক কার্ড’। এই কার্ড তিনি ব্যবহার করতে পারবেন ভবিষ্যতে যখন বয়সকালে তাঁর নিজের জন্য অন্যকে কাজে লাগবে। ব্যাঙ্ক তাঁর সেই জমানো সময়ের ভিত্তিতে তাঁর সহযোগিতার জন্য একজন স্বেচ্ছাসেবক পাঠাবেন। যিনি তাঁকে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কাজে সহায়তা করবেন। এভাবেই চলতে থাকবে এই ব্যাঙ্ক। কোন ধরনের টাকার আদান-প্রদান ছাড়াই এই ব্যাঙ্ক প্রচুর প্রবীণ মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা দিতে সমর্থ হবে।
কী ধরনের কাজ বা সহযোগিতা করতে পারেন?
প্রবীণ মানুষটির বাড়ি গিয়ে সময় কাটানো, গল্প করা বা গল্পের বই পড়ে শোনানো, ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস, ডাক্তার বা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, বাজার করা, ঘর গুছিয়ে দেওয়া, বাগান করা ইত্যাদি যেগুলোকে সাধারণত বলা হয় ‘অড জব’, তাছাড়া স্নান করানো, খাবার খাওয়ানো, শয্যাশায়ী রোগীদের পরিচর্যা ইত্যাদি বিষয়ে সহযোগিতা ও করতে পারেন।
এই ধরনের ‘টাইম ব্যাঙ্ক’ প্রথার প্রথম প্রচলন হয় সুইজারল্যান্ডে। পরবর্তীতে ইংল্যণ্ড ও জাপানে এই ব্যাঙ্ক-এর মাধ্যমে প্রবীণদের সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা সফলভাবে সংগঠিত হচ্ছে। সিঙ্গাপুরেও সদ্য এই প্রথা চালু হতে চলেছে।
যেভাবে সারা বিশ্বে ক্রমেই বাড়ছে প্রবীণদের সংখ্যা, তাতে করে এরকম বিকল্প সুরক্ষার ব্যবস্থা ভীষণই এক ফলপ্রসূ প্রক্রিয়া। কিন্তু এই ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নিষ্ঠাবান, সৎ, দরদী, দক্ষ, সহমর্মী মনোভাব সম্পন্ন স্বেচ্ছাসেবী। তাই সমাজ যদি সচেতন না হয় তাহলে কিন্তু এই প্রথা ফলপ্রসূ হবে না। চালু করাও যাবে না। আমাদের মতন দেশে যেখানে প্রবীণদের মধ্যে মহিলাদের ৫৮.৭ শতাংশ ও পুরুষদের ২৬ শতাংশ কোনও প্রকারের আয় নেই, সেখানে প্রবীণদের জন্য ‘টাইম ব্যাঙ্ক’ পদ্ধতি যদি চালু করা যায়, তবে সেটা হবে অত্যন্ত ফলপ্রসূ ও দীর্ঘস্থায়ী একটি সুরক্ষা উদ্যোগ। প্রবীণদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন এনজিও বা সংগঠনকে সাথে নিয়ে সরকারকেই কিন্তু এবিষয়ে কার্যকরী ও অগ্রণী পদক্ষেপ নিতে হবে।