শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহ বৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে ... বিশদ
কাজল কালো মেঘ আর ঝোড়ো হাওয়ার বিকেল
গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহের দিনে সবে অনলাইন ক্লাস শেষ করে উঠেছি। গরমকালের বিকেল, ঘড়িতে তখন চারটে- সাড়ে চারটে হবে। মন ভালো নেই। ঘরে বন্দি হয়ে দিন যায়। পড়ার বই খাতা গুছিয়ে রেখে রোজকার মতো একটা গল্পের বই টেনে নিয়ে জানলার পাশে বসে সেটাতেই মন দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। দু-পাতা পড়ার পর হঠাৎই কোথা থেকে একটা শুকনো পাতা হাওয়ায় ডানা মেলে আমার বইয়ের মাঝে এসে যেন মুখ লুকোলো। জানালা দিয়ে ওপরে তাকাতেই দেখি আকাশে এক অপরূপ দৃশ্য। কাজল কালো মেঘের দল খোলা আকাশ-মাঠ দখল করে নিয়েছে। বই রেখে ছুটলাম ছাদে। চারদিকে তখনও গুমোট একটা ভাব। চারপাশের গাছপালাগুলো নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে কীসের জন্য যেন প্রতীক্ষারত। খাঁচায় বন্দি মন আমার আজ ইচ্ছেডানা পাখি। সেই মন বলে উঠল—‘ধুলায় ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল, তপঃক্লিষ্ট তপ্ত তনু, মুখে তুলি বিষাণ ভয়াল কারে দাও ডাক, হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ।’ অবশেষে সেই রুদ্র বৈশাখের ছায়ামূর্তি অনুচরেরা প্রবল বেগে ধেয়ে এল। উদ্দাম হাওয়ার দাপটে গাছগুলো দুলতে থাকল— শুরু হল কালবৈশাখীর তাণ্ডব। ভয় ও রোমাঞ্চ একসঙ্গে আমার মধ্যে কাজ করতে শুরু করল। দূরে, বহুদূরে আমাকে ছেড়ে আমার মন যেন ছুটে যেতে থাকল আশ্চর্য মুক্তির আনন্দে। সে অনুভূতি কথায় প্রকাশ করা যায় না। এই হারিয়ে যাওয়ার আনন্দে গত দেড় বছরের বিমর্ষতা যেন অনেকটাই ফিকে হয়ে যায়। মলিনতা যেন ধুয়ে যায়। মেঘের ডাক আর ঝড়ের এই উদ্দামতা যেন মানবজীবনের সমস্ত স্থবিরতাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। এক-দু ফোঁটা করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। মস্তিষ্কের কাছ থেকে পেলাম সাবধান বাণী- করোনার সময় বৃষ্টিতে না ভেজাই ভালো। ভালো লাগার অব্যক্ত অনুভূতি নিয়ে আর প্রাণভরা তাজা বাতাসে ভরপুর হয়ে ফিরে এলাম ঘরে–মনের ঘরে জমা হল বেশ কিছুদিনের ভালো থাকার রসদ।
আকাশে ধূসর রঙের মেঘ
সেদিন ছিল শনিবার। দুপুরের পর থেকেই চারদিকে আবহাওয়া গুমোট হয়ে উঠল। যত বিকেল হতে থাকল চারদিকে ঘোলাটে ভাব আরও বেড়ে উঠল। চারদিক যেন থমথম করছে। মনে হচ্ছিল গাছপালাগুলো যেন সব নিঃশ্বাস বন্ধ করে স্থির নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছিল ওরা যেন ভয় পেয়েছে। আকাশে ধূসর রঙের মেঘ। কেবল পশ্চিম- উত্তর আকাশে একখণ্ড মেঘ সূর্যকে আড়াল করে দিচ্ছে। আমার মনে হল সূর্যও যেন ভয় পেয়ে আড়ালে লুকোচ্ছে। খানিক পর থেকে শুরু হল গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ আর তার সঙ্গে জোরে হাওয়া। আমাদের বাড়ির সামনের ছাতিম গাছটা খুব জোরে জোরে দুলতে লাগল। তারপরই শুরু হল বৃষ্টি। তখন আমার খুব মজা লাগছিল। আমি আর আমার বোন দুজনে মিলে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলাম। তারপর যেই আরও জোরে বৃষ্টি শুরু হল দুজনেই দৌড়ে ঘরে চলে এলাম। তারপর যখন স্নান সেরে এলাম, দেখি রাস্তায় জল জমে গেছে। আমি আর বোন দুজনে মিলে নৌকা বানিয়ে জলে ভাসিয়ে দিলাম। আমার কালবৈশাখীর এই মজাটাই ভালো লাগে।
ভয়ের অনুভূতি হয়
কালবৈশাখী, এই শব্দ উচ্চারণে ভয়ের অনুভূতি হয়। কাল মানে মহাকাল, কালো। ধ্বংসের ইঙ্গিত বহন করে। ৪০-৬০ কিমি বেগে আসা এই ভয়ঙ্কর ঝড় অনেক কিছু ধ্বংস বা শেষ করে দিয়ে যায়। আবার এই ধ্বংসলীলার পর যা অবশিষ্ট থাকে তা সৃষ্টির বীজ বহন করে। ঝড় থেমে যাওয়ার পর ধরিত্রী আবার শান্ত স্নিগ্ধ হয়। ঠিক এখন আমরা যে পরিস্থিতি পরিবেশে আছি তাতে যেন কালবৈশাখী ঝড়ই বয়ে যাচ্ছে আমাদের সকলের জীবনে। চারদিকে ঘন কালো অন্ধকার! ভয়ঙ্কর করোনা নামক ভাইরাস আমাদের জীবনে কালবৈশাখী ঝড় তুলেছে। কালবৈশাখী ঝড়ের পর ধরিত্রী যেমন শান্ত হয় ঠিক তেমনই এই ঝড়ও একদিন শান্ত হবে তবে কয়েক মিনিটের এই ঝড় অনেক আশা আকাঙ্ক্ষা, প্রাণ ধ্বংস করে চলে যাবে, তাই কালবৈশাখী মহাকালের ধ্বংসলীলার সমতুল্য।।
দি স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুল
ধ্বংস করে আবার দাবদাহে শান্তি বারি বর্ষণ করে
‘কাল’ মানে ধ্বংস। বৈশাখ মাসে এই ধ্বংসের উৎপত্তি, তাই ‘কালবৈশাখী’ হল বৈশাখের ধ্বংসলীলা। প্রকৃতই বাংলার চৈত্র মাসের শেষ থেকে বৈশাখ মাস জুড়ে চলে কালবৈশাখী। বিকেলের দিকে প্রবল ঝড়, বিদ্যুতের ঝলক, আর বৃষ্টি। আবহবিদরা বলেন, এই ঝড়ের স্থায়িত্ব কম সময়ের, তবে কখনও ঘণ্টাখানেক হতে পারে। সাধারণত বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, অসম, বিহার, ছত্তিশগড় ও ঝাড়খণ্ডে এর দাপট দেখা যায়। শিলাবৃষ্টি কালবৈশাখীর দোসর। কখনও কখনও এর গতিবেগ ঘণ্টায় ৮০-১০০ কিমি।
প্রতিবছর আমি কালবৈশাখী দেখি। উপভোগ করি। একবার, মনে আছে, বিকেলে মায়ের সঙ্গে পড়তে গিয়ে মাঝপথে ঝড়ের কবলে পড়েছিলাম। সে খুব ভয়ঙ্কর রূপ। ঝড়ের দাপটে এলোমেলো হাওয়া দিচ্ছিল আর ধুলো উড়ছিল। কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। চোখ খুললেই ধুলো এসে পড়ছিল। কোনওরকমে মা আমাকে টেনে একটা ছাউনি দোকানের ভেতরে নিয়ে গিয়েছিলেন। সামনেই ভেঙে পড়তে দেখলাম একটা বড় গাছকে। আর সেটা পড়ল একটা গাড়ির ওপর। এভাবে কেটে গেল অনেকটা সময়। বৃষ্টি থামল তারপর। বাইরে বেরিয়ে দেখি চারদিকে জল জমেছে। সবকিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছে।
গরমে আমরা হাঁসফাঁস করি। চাই বিকেলের দিকে ঝড় হোক, বৃষ্টি হোক। প্রকৃতি ঠান্ডা হোক। কালবৈশাখী সেই স্বস্তি এনে দেয়। আমাদের তৃষ্ণা মিটে যায়। তবে শুধু ভালোলাগাটাই শেষ কথা নয়। বাংলাদেশ, অসম ও আমাদের রাজ্যে এই বৃষ্টির জল ধান, পাট ও চা চাষের কাজে লাগে। আবার কালবৈশাখীর দাপটে অনেকের ঘরবাড়ি ভেঙে যায়, শস্যের ক্ষতি হয়, সম্পত্তি নষ্ট হয়। সেটাও খুব ভালো কথা নয়। আমাদের আনন্দের অনুভূতির মাঝে কতজন সব কিছু হারাচ্ছেন, সেটাও ভাবি।
বালিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়
অন্ধকার বিকেল, হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড়
কালবৈশাখী নামটা শুনলেই আমার মনে আসে অন্ধকার বিকেল, হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড়, ঝোড়ো হাওয়ায় জানলা দরজার ঝটপটানি, বিদ্যুতের চমক আর শিলাবৃষ্টি তারপর মাথা বাঁচিয়ে শিল কুড়ানো। ছোট ছোট শিলা টিনের চালে পড়লে যে ঘুঙুরের শব্দ শোনা যায় তখন আমার মনে হয় যেন আমি ময়ূরের মতো নেচে উঠি। শিল কুড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আমার আম কুড়াতেও খুব ভালো লাগে। কালবৈশাখীর অভিজ্ঞতা আমার কাছে আনন্দের হলেও কখনও কখনও কষ্টের কারণও হয়ে দাঁড়ায়, যখন দেখি ঝড়ের দাপটে গাছপালা ভেঙে পড়ে আছে বা কোথাও হাওয়ার দাপটে চাল উড়ে গেছে বা গাছ পড়ে বাড়ি ভেঙে গেছে। এসব দেখে তখন মনে বড়ো কষ্ট হয়। তখন মনে হয় এমন ঝড় না হলেই ভালো হয়। আর ঝড়ের পরে রাস্তায় জল জমা আর চারদিকে কাদা কাদা হয়ে যাওয়াও আমার ভালো লাগে না। যাই হোক কালবৈশাখী সবকিছু মিলিয়ে আমার কাছে ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে আনন্দেরও বটে।
টেকনো ইন্ডিয়া গ্রুপ পাবলিক স্কুল
মুহূর্তে আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা
আমার জীবনে কালবৈশাখীর স্মৃতিগুলো যখন মনে পড়ে তখন বেশ ভালোই লাগে। আমাদের গ্রামটির নাম ধপধপি।
হঠাৎ হঠাৎ বৈশাখ মাসের বিকেলবেলায় আকাশ কালো হয়ে যায়। চারদিকে থমথমে পবিবেশের সৃষ্টি হয়। ঠিক তার কিছুক্ষণ পর ঝড় তাণ্ডব শুরু হয়। ক্রমেই থমথমে শান্ত পরিবেশ অশান্ত হয়ে ওঠে। ওই ঝড়ে অনেকের অনেক রকম ক্ষয়ক্ষতি হয়। অনেক গাছপালা নষ্ট হয়ে যায়। বাড়িঘরেরও খুব ক্ষতি হয়। তবুও সব ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে দিয়েও ওই বিরক্তিকর গরম থেকে রেহাই পাওয়া যায়। আবার এই ঝড়ের তাণ্ডব থেমে যাওয়ার পর আমাদের মতো ছোটরা অনেকে আম জাম লিচু কুড়োতে দৌড়োই। এই বিষয়টা আমার খুব মজা লাগে। আমাদের গ্রামে আবার ঝড়ের তাণ্ডব চলাকালীন লোডশেডিং হয়ে যায়। তখন ছোট থেকে বড় সবাই বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসে। আর কিছুক্ষণ আগের অশান্ত পরিবেশটা আবার আগের মতো হয়ে যায়। আমার অবশ্য ঝড়ের আগের নিস্তব্ধতা আর ঝড়ের তাণ্ডবের পরের যে পরিবেশ সেটা খুব ভালো লাগে।
ধপধপি হাই স্কুল (উচ্চ মাধ্যমিক)
ঝড় থামলে আম কুড়োতে যাই
বছরের প্রথম মাস হল বৈশাখ মাস। এই সময় হঠাৎ করে বাতাস বইতে শুরু করে আর তার সঙ্গে বজ্র বিদ্যুৎ সহ প্রচুর বৃষ্টিও হয়। একেই আমরা কালবৈশাখী বলে জানি। এই ঝড়ে আমাদের জীবনে প্রচুর ক্ষয়-ক্ষতি হয়। অনেক সময় রাস্তার ধারের গাছ উপড়ে গিয়ে যান চলাচলের অসুবিধাও হয়। আবার ইলেকট্রিক লাইনে গাছের ডাল পড়ে ইলেকট্রিক লাইনও কেটে যায়। আমাদের বাড়ির সামনে একটা খেলার মাঠ আছে, তাতে বৃষ্টির জল জমলে খেলতে খুব অসুবিধা হয়। তখন আমাদের খুব মন খারাপ হয়ে যায়। তবে আমার কাছে কালবৈশাখীর একটা মজার দিকও আছে। আমার বাড়ির পাশে একটা আমগাছ আছে। ঝড় উঠলেই গাছ থেকে টুপটাপ করে আম পড়ে।
তখন আমাদের আশপাশের অনেকেই এসে গাছতলায় জড়ো হয়। সকলে মিলে কাড়াকাড়ি করে আম কুড়াতে থাকি। মাঝে মাঝে আমার রাগও হয় যে কেন ওরা আমাদের আম নেবে? তবে মা বোঝালে মনে হয়, সত্যিই তো আমাদের তো গ্রামের মতো অনেক গাছ নেই! তাই এ মজাটা সবার মধ্যে ভাগ করে নেওয়াই ভালো।
মিত্র ইনস্টিটিউশন, ভবানীপুর
সেদিন খুব ভয় পেয়েছিলাম
কিছুদিন আগে এক বিকেলবেলায় ছাদে গিয়ে দেখলাম ঈশান কোণে একরাশ কালো মেঘ জমেছে। সেই মেঘ ক্রমে মাথার ওপরের আকাশটাকে ঢেকে ফেলেছে। অল্প সময়ের মধ্যে হাওয়ার বেগ বাড়তে বাড়তে শুরু হল প্রবল ধূলিঝড়। বিকেলেই নেমে এল অকাল সন্ধ্যা। আরম্ভ হল বজ্রবিদ্যুৎ সহ ঝড় বৃষ্টি। তার মধ্যেই হঠাৎ করে লোডশেডিং হয়ে গেল। ঘরে ঢুকে দেখলাম জানালার কপাটগুলো হাওয়ায় দুলছে। হঠাৎ এক ঝোড়ো হাওয়া হাতের মোমবাতিটিকেও নিভিয়ে দিল। এদিক ওদিক ধাক্কা খেতে খেতে জানালা বন্ধ করার জন্য হাত বাড়াতেই তীব্র বিদ্যুতের ঝলকানি আর ভয়ঙ্কর মেঘের গর্জন কানে এল। আলোর সেই ঝলকানিতে দেখতে পেলাম দামাল ঝড় বৃষ্টিতে মেতে ওঠা প্রকৃতি, আর আমার ঘরের ভেতরটা। অদ্ভুত আলো-আঁধারিতে আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল ঠাম্মার কাছে শোনা এক ভূতুড়ে গল্পের কথা। মুহূর্তে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শিহরন বয়ে গেল। কোনওরকমে জানালাটা বন্ধ করেই যেখানে সবাই আছেন সেখানে চলে গেলাম। অন্য সব কালবৈশাখীর মতো কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড় বৃষ্টি থেমে গেল, আলোও চলে এল। বাইরে তাকাতেই দেখতে পেলাম সদ্য স্নান করে ওঠা গাছপালা আর শান্ত পথঘাট। সেদিনের সেই কালবৈশাখী আমার মনে জায়গা করে নিল ক্ষণিকের সেই অদ্ভুত অনুভূতির জন্য, যা আজও মাঝে মাঝে মনে পড়ে।
কাশীপুর ডব্লু ডব্লু এ ইংলিশ স্কুল