শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহ বৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে ... বিশদ
আজ তোমাদের শোনাব এমন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর জীবনের কথা, ব্রিটিশ সরকার যাঁকে কোনও দিনও ধরতে পারেনি, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সশস্ত্র সংগ্রামের ইতিহাসে যাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে, যাঁকে বলা হতো ‘বিপ্লবীর বিপ্লবী’, যাঁর জীবনকে অবলম্বন করে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচনা করেছিলেন তাঁর ‘পথের দাবী’ উপন্যাসের নায়ক ‘সব্যাসাচী’ চরিত্রটি— তিনি হলেন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু, বর্ধমানের সুবলদহে ১৮৮৫ সালের ২৫ মে বাবা বিনোদবিহারী ও মা ভুবনেশ্বরীদেবীর ঘরে যাঁর জন্ম হয়েছিল।
সেকালের বিখ্যাত লাঠিয়াল ঠাকুর্দা কালীচরণের কাছেই লাঠিখেলা ও শরীরচর্চায় তাঁর হাতেখড়ি। ছেলেবেলায় তাঁর খেলা ছিল, ইংরেজদের মূর্তি তৈরি করে লাঠি খেলার কৌশলে মূর্তিগুলোর মাথা ভেঙে ফেলা!
গ্রামের পাঠশালায় শুরু হয়েছিল তাঁর পড়াশোনা। সহপাঠীদের সঙ্গে তিনি প্রাণ খুলে মিশতেন, ধনী-দরিদ্র-জাত-ধর্ম কোনও ভেদাভেদই করতেন না। ঠাকুর্দা ও শিক্ষকদের কাছে জাতীয়তাবাদী গল্প শুনে শুনে তাঁর মধ্যে জেগে উঠেছিল বিপ্লবী আন্দোলনের প্রেরণা!
বিনোদবিহারী চন্দননগরের ফটকগোড়াতে এলেন বসবাস করতে। রাসবিহারী ভর্তি হলেন ডুপ্লে কলেজে। তখন তাঁর ধ্যান জ্ঞান শুধু ভারতের স্বাধীনতা! চন্দননগরে তখন ফরাসি শাসন তাই ব্রিটিশদের কোনও আইন এখানে খাটত না। সেইজন্যই বহু বিপ্লবী এখানে লুকিয়ে থাকতেন। তেমনই একজন বিপ্লবী চারু রায়ের সংস্পর্শে এলেন রাসবিহারী। মাত্র ষোলো বছর বয়সেই তাঁর কাছে পেলেন রাজনৈতিক দীক্ষা!
ছেলের মনোভাব টের পেয়ে বাবা তাঁকে সরিয়ে নিয়ে এলেন কলকাতায়। রাসবিহারী ভর্তি হলেন মর্টন কলেজে। কিন্তু রাসবিহারীর চোখে যে সেনাবাহিনী গঠন করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করার স্বপ্ন! তাই প্রথাগত পড়াশোনায় ইতি দিয়ে, নিলেন প্রেসের চাকরি। ছাপতে আসা গোপন সরকারি নথি তাঁর সাহায্যে এক ইংরেজি পত্রিকায় প্রকাশিত হতেই হইহই পড়ে গেল! জড়িয়ে গেল তাঁর নাম আলিপুর বোমা মামলাতেও! পুলিসি নজর এড়াতে রাসবিহারী দেরাদুনে ফরেস্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের হেড ক্লার্কের চাকরি নিয়ে চলে গেলেন। যোগাযোগ হল মহাবিপ্লবী বাঘা যতীনের সঙ্গে। তাঁর পরামর্শে রাসবিহারী ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে ঘুরে তরুণদের সংগঠিত করে দিতেন তাঁদের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা! লাহোর, অমৃতসর, মিরাট, দিল্লি, বোম্বাই, মাদ্রাজের বিপ্লবী কেন্দ্রে সবাই তাঁকে নেতা হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন।
রাসবিহারী বসুর নেতৃত্ব দেওয়া বহু দুঃসাহসিক অভিযানের অন্যতম হল, ১৯১২ সালের ২৩ ডিসেম্বর যখন কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরিত হল, ঠিক সেই সময়, তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জকে স্বাগত জানানোর জন্য তাঁরই নির্দেশে চাঁদনি চকের এক বাড়িতে মহিলার ছদ্মবেশে দাঁড়িয়ে থাকা বসন্ত বিশ্বাস নামক একটি ষোলো বছরের কিশোরের হার্ডিঞ্জকে লক্ষ্য করে বোমা ছোড়ার অভিযান! হার্ডিঞ্জ প্রাণে বেঁচে গেলেও মারাত্মক জখম হলেন! জনতার হট্টগোলের মধ্যে দিয়ে রাসবিহারী ও বসন্ত বিশ্বাস সাবলীল ভাবে সে স্থান পরিত্যা গ করলেনই শুধু নয়, দেরাদুনে ফিরে রাসবিহারী কিছু দিন পর হার্ডিঞ্জকে স্বাগত জানানোর জন্য একটি সভারও আয়োজন করলেন! এই অসম্ভব সম্ভব হওয়ার পেছনে কারণ ছিল তাঁর ছদ্মবেশ ধারণের অসামান্য দক্ষতা! কখনও তিনি শিখ, আবার কখনও আফগান, ইংরেজ বা মারাঠি! জানতেন নানান ভাষাও। তাই কারও কাছে তিনি ছিলেন দরবার সিং, আবার কারও কাছে সতীশচন্দ্র! তাঁর আসল নামের হদিশ কেউই জানত না!
শুরু হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। বিপ্লবী নেতা পিংলে, হরদয়াল, মানবেন্দ্র রায় প্রমুখদের নিয়ে এবার রাসবিহারী এক বৃহত্তর পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। কিন্তু, কয়েকজন দেশদ্রোহীর বিশ্বাসঘাতকতায় সে পরিকল্পনা সফল হল না! ফাঁসি হল বিষ্ণুগণেশ পিংলে, কার্তার সিং প্রমুখ বিপ্লবীদের! লাহোরের গাদার ষড়যন্ত্র মামলা, বেনারস ষড়যন্ত্র, দিল্লি ষড়যন্ত্র ইত্যাদিতে রাসবিহারীর নাম প্রকাশ্যে আসাতে অত্যাচারী পুলিস কমিশনার চার্লস টেগার্টের সন্দেহভাজন হয়ে পড়লেন তিনি! ব্রিটিশ সরকার তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য মোটা টাকা পুরস্কার ঘোষণা করল। কিন্তু, ১৯১৫ সালের ১২ মে কলকাতার খিদিরপুর বন্দর থেকে জাপানি জাহাজ ‘সানুকি- মারু’তে চড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিকট আত্মীয় ‘প্রিয়নাথ ঠাকুর’ ছদ্মনামের পাশপোর্ট সহযোগে, টেগার্টের সামনে দিয়ে বই পড়তে পড়তে জাপান চলে গেলেন রাসবিহারী বসু! আশ্রয় নিলেন একটি জাপানি পরিবারে। ১৯১৮ সালের ৯ জুলাই সেই পরিবারেরই কন্যা তোশিকা সোমাকে বিয়ে করলেন। তাঁদের দুই সন্তানের নাম তেৎসুকো হিগুচি বসু ও মাশাহিদে ভারতচন্দ্র বসু। ভারতচন্দ্র বসু পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিলেন।
জাপানে গিয়ে সেখানে ‘টোকিও ইন্ডিয়ান লিগ’ গঠন করলেন এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিপ্লবীদের নিয়মিত অস্ত্র পাঠাতে লাগলেন।
দামামা বেজে উঠল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। ১৯৪২ সালের ১৫ জুন জাপানেই তিনি স্থাপন করলেন ‘ইন্ডিয়ান ন্যা্শনাল আর্মি’ বা ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’।
১৯৪৩ সালে সুভাষচন্দ্র বসু সিঙ্গাপুরে পৌঁছনোর পর, ৪ জুলাই তাঁর হাতেই এই ফৌজের সমস্ত ভার তুলে দিলেন রাসবিহারী বসু।
ভারতবর্ষ সম্পর্কে তিনি পাঁচখানা বই লিখেছিলেন।
তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে, জাপ সরকার সে দেশের শ্রেষ্ঠ জাতীয় পুরস্কার ‘The Second Order Of The Merit Of The Rising Sun’ পদক দিয়ে এই বিদেশি বিপ্লবীকে সম্মানিত করেছিলেন!
১৯৪৫ সালের ২১ জানুয়ারি টোকিওতেই রাসবিহারী বসুর জীবনাবসান হয়।
তথ্য ও ছবি : সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে