কর্মপ্রার্থীদের ধৈর্য্য ধরতে হবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। নিকটস্থানীয় কারও প্রতি আকর্ষণ বাড়বে। পুরোনো কোনও বন্ধুর ... বিশদ
অনে-এ-ক দিন আগে কলকাতা শহরে এক সিংহ বাস করত!
হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ। ‘ইন্দ্রজাল’ বাড়িটা আসলে জাদুসম্রাট পি সি সরকারের। পি সি সরকার সিনিয়র অর্থাৎ প্রতুলচন্দ্র সরকারের ছেলে পি সি সরকার জুনিয়রের কাছে আমি এই সিংহটার গল্প শুনেছিলাম। আজ সেই গল্পটাই তোমাদের শোনাব।
সম্রাট নামের এই সিংহটা ছিল পি সি সরকার জুনিয়রের পোষা। সম্রাটকে তিনি পেয়েছিলেন স্পেন থেকে। কেমনভাবে পেয়েছিলেন সেটাই গল্প।
পি সি সরকার জুনিয়র তখন দলবল নিয়ে লন্ডনের ওয়েস্ট এন্ডে ম্যাজিক দেখাচ্ছেন। ওয়েস্ট এন্ডে যে সে শো করার সুযোগ পায় না। বাঙালি হিসেবে একমাত্র সিনিয়র ও জুনিয়র এই দুই পি সি সরকারই সে সুযোগ পেয়েছিলেন।
ওয়েস্ট এন্ডের যে হলে জাদু প্রদর্শনী হচ্ছিল তার একপাশে হচ্ছিল বিশ্ববিখ্যাত অপেরা নাটক ‘জেসাস ক্রাইস্ট সুপার স্টার’ ও অন্যপাশে হচ্ছিল আগাথা ক্রিস্টির ‘মাউস ট্র্যাপ’। যে নাটকটি ১৯৫২ সালে শুরু হয়ে ২০১২ সাল পর্যন্ত একনাগাড়ে চলেছিল মোট ২৫ হাজার রজনী।
তো যাই হোক, একদিন ওয়েস্ট এন্ডে জাদু দেখতে এসেছিলেন স্পেনের এক ইম্প্রেশারিও। তাঁর নাম মিঃ ক্যাস্টেলিয়া। ইম্প্রেশারিও মানে জানো তো? অর্থাৎ যাঁরা পেশাদারভাবে নানা ফাংশান করে থাকেন। এটাই তাঁদের জীবিকা।
প্রদীপবাবু অর্থাৎ পি সি সরকার জুনিয়রের ম্যাজিক দেখে ক্যাস্টেলিয়া সাহেবের এত ভালো লেগে গেল যে তিনি তাঁকে স্পেনে নিয়ে যেতে চাইলেন। প্রদীপবাবুর লন্ডনের ম্যানেজার ল্যুইয়ের সঙ্গে ক্যাস্টেলিয়া কথাবার্তা বলে সবকিছু পাকা করে ফেললেন। তারপর পি সি সরকার জুনিয়র তাঁর হাতে ধরিয়ে দিলেন একটা লম্বা লিস্টি। তাতে ছিল ম্যাজিক দেখানোর জন্য যেসব সাজ-সরঞ্জাম লাগে তার ফর্দ। তা সেই ফর্দতে ছিল একটা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারও! আসলে প্রদীপবাবু তখন একটা খেলা দেখাতেন যাতে শাড়ি পরা একটা মেয়েকে জাদুবলে তিনি বাঘে রূপান্তরিত করে দিতেন। ক্যাস্টেলিয়া সাহেব সেই ফর্দ দেখে বললেন, বেশ রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার তুমি পাবে। আমেরিকার একটা সার্কাস দল থেকে আমরা তাকে ভাড়া করে এনে দেব।
প্রথমদিকে চুক্তি হয়েছিল ৩ মাসের। কথা মতো ক্যাস্টেলিয়া সাহেব আমেরিকা থেকে বাঘ এনে দিলেন পি সি সরকারকে। একেবারে খাস রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। প্রদীপবাবু তার নাম দিলেন ‘দক্ষিণ রায়’। আসলে দক্ষিণ রায় বাঘের দেবতা। সুন্দরবন অঞ্চলে দক্ষিণ রায়ের পুজো করা হয়।
জন্তু জানোয়ার নিয়ে ম্যাজিক দেখাতে গেলে তাদের সঙ্গে একটু ভাব পাতানো দরকার। আর পি সি সরকার জুনিয়র জন্তু জানোয়ার ভালোবাসেন। তাই বাঘের খাঁচাটাকে তিনি নিজের হোটেলের রুমে নিয়ে গিয়ে রেখেছিলেন। খাঁচার পাশেই টেবিল চেয়ারে কাজ করতেন। আর কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাঘটার সঙ্গে কথা বলতেন। নিজে খেতে খেতে দু’ এক টুকরো খাবার
ছুঁড়ে দিতেন বাঘটার দিকে। বাঘটা প্রথম প্রথম সে খাবার খেত না। পরে কিন্তু খেত। পি সি সরকার জুনিয়র কিছু বললে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকত। আর হোটেলের কর্মচারী, ক্যাস্টেলিয়ার কর্মচারীরা সবাই ভাবত জাদুকর বোধহয় বাঘটার সঙ্গে সত্যি সত্যি কথা বলেন!
স্পেনে তিনমাসের চুক্তি ছিল। কিন্তু ম্যাজিক এত ভালো হল যে টানা এগারো মাস সেখানে ম্যাজিক দেখিয়ে ছিলেন প্রদীপবাবু। তারপর এল সেই দুঃখের দিন। আমেরিকা থেকে চিঠি এল, দক্ষিণ রায়কে ফেরত দিতে হবে। কারণ, একটা সিনেমার শ্যুটিংয়ে তাকে ভাড়া দেওয়া ছিল আগে থেকেই। শুনে প্রদীপবাবুর মন খুব খারাপ। এমন সময় ক্যাস্টেলিয়া এসে বললেন, চলুন একটা জায়গায় এক্ষুনি যেতে হবে। প্রদীপবাবু তো অবাক, কোথায়! বলা হল, পশু হাসপাতালে। কেন? দক্ষিণ রায়ের কি শরীর টরির খারাপ হল না কি! ক্যাস্টেলিয়া কোনও কথাই বললেন না। পি সি সরকারকে নিয়ে সোজা গিয়ে হাজির হলেন একটা পশু হাসপাতালে। সেখানে সবাইকে স্প্রে করে ডিসইনফেক্ট করে মুখে মাস্ক পরিয়ে পায়ে আলাদা জুতো পরিয়ে একটা ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। এরপর প্রদীপদার বয়ানে, ‘ঢুকে দেখি ঘর ভর্তি নানা সাইজের সব জন্তু জানোয়ারের বাচ্চা। কী নেই সেখানে? শিম্পাঞ্জি, বাঘ, বাঁদর, হাতি সওব! ক্যাস্টেলিয়া বললেন, আপনি পশুদের এত ভালোবাসেন তাই আমরা ঠিক করেছি এর মধ্যে থেকে একটা আপনাকে উপহার দেব। কোনটা নেবেন আপনি ঠিক করুন। এর মধ্যে একটা বাঘের বাচ্চা আমার প্যান্ট আঁকড়ে ধরে হাঁচড় পাঁচড় করে বেয়ে ওঠার চেষ্টা করছিল। তো আমি বললাম, এই বাঘের বাচ্চাটাই দিন। তখন ওখানকার কর্মী বললেন, এটা তো বাঘের বাচ্চা নয়, এটা সিংহের বাচ্চা। আমি বললাম, সে কী! এর তো গায়ে ডোরা কাটা রয়েছে। সে বলল, সিংহের বাচ্চাদের গায়ে ওরকম ডোরা থাকে। বয়স বাড়লে ক্রমশ মিলিয়ে যায়। এটাও ম্যাজিক!’
তো সেই সিংহশাবককে নিয়ে দেশে ফিরলেন পি সি সরকার জুনিয়র। এরই নাম হল সম্রাট। নামটা দিয়েছিলেন পি সি সরকারের মা।
বালিগঞ্জের বাড়িতে সম্রাটের সবথেকে পছন্দের জায়গাটা ছিল প্রদীপদার খাটের তলা। ওখানেই সে শুত, ঘুমোত। প্রদীপদা যা যা খেত সবকিছুই খাওয়া চাই তার। বলা যেতে পারে ভীষণ আদর-যত্নে মানুষ হচ্ছিল সম্রাট। চড়-চড় করে বাড়ছিল সে। যখন তার তিনমাস বয়স, তখনই তাকে দেখলে ভয় লাগত। একদিন হল কী, সম্রাটকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। চারতলা বাড়ির কোনও ঘরে সে নেই। প্রদীপদা রাস্তায় বেরিয়ে খোঁজাখুঁজি করতে লাগলেন। হঠাৎ দেখেন দূরে একটা বাড়ির ছাদে ভিড়। সবাই সেখান থেকে ইন্দ্রজালের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। প্রদীপদা সেদিকে গিয়ে দেখেন, সম্রাট তাঁদের বাড়ির কার্নিশে বসে রয়েছে, বেশ মেজাজে! প্রদীপদা বাবা বাছা করে তাকে তোয়াজ করতে শুরু করলেন নেমে আসার জন্য। কিন্তু কে শোনে কার কথা। অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করার পর সম্রাট রাজার চালে উঠে দাঁড়াল। তারপর খানিকক্ষণ কার্নিশে পায়চারি করে এক লাফে চলে গেল পাশের বাড়ির ছাদে। সেখান থেকে আর এক লাফে উল্টোদিকের বাড়ির জলের ট্যাঙ্কের ওপর। সেখান থেকে ইন্দ্রজালের ছাদে। তারপর সিঁড়ি দিয়ে ধীরেসুস্থে নেমে এল প্রদীপদার ঘরে। সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
সরকার পরিবারের সবাই বুঝতে পারল যে ওইভাবে প্রতিদিনই সম্রাট কার্নিশে রোদ পোয়াতে যায়। সেদিন থেকে ছাদের দরজা পাকাপাকিভাবে বন্ধ করে দেওয়া হল। কে জানে কবে কাকে কামড়ে দেবে! সেই ভয়ে।
এরপর প্রদীপচন্দ্র সরকারের বড় মেয়ে অর্থাৎ মানেকার জন্ম হল। ক’দিন বাদেই পি সি সরকার জুনিয়রের মা বললেন, ওর চোখ আমার ভালো লাগছে না। মানে উনি বুঝতে পেরেছিলেন যে ভালোবাসায় ভাগ বসানোর জন্য একজন যে এসে গিয়েছে সেটা সম্রাটের সহ্য হচ্ছে না। যে কোনওদিন একটা কাণ্ড ঘটে যেতে পারে। তড়িঘড়ি বারুইপুরে কিনে রাখা একটা জমিতে খাঁচা বানিয়ে সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হল সম্রাটকে।
সম্রাট নিয়মিত পি সি সরকারের সঙ্গে শো করত। একবার তামিলনাড়ুতে শো করতে গিয়েছেন তিনি। সেখানে কাগজে একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল তাঁর। বিজ্ঞাপনটা দিয়েছিল একটা সার্কাস সংস্থা। তাদের একটা আফ্রিকান সিংহী ছিল। সেই সিংহীটার বিয়ে দেওয়ার জন্য তারা একটা আফ্রিকান সিংহ খুঁজছে। সিংহদের বিয়েরক্ষেত্রে আবার জাতপাতের খুব বিচার হয়। বর আর কনে যদি একই এলাকার হয় তবে কোনও সমস্যা হয় না। কিন্তু আলাদা জায়গার হলে দু’জনের মধ্যে লাঠালাঠি বেঁধে যাবে। যে কোনও একজন সেই লড়াইয়ে মরেও যেতে পারে।
তা সম্রাট জন্মেছিল আফ্রিকার সেরেঙ্গেটি অরণ্যে। ফলে অনেকটা নিশ্চিন্ত। সম্রাটকে পাঠিয়ে দেওয়া হল সেই সার্কাসের তাঁবুতে। দু’জনের দুটো খাঁচা পাশাপাশি রেখে দেওয়া হল। সার্কাসের অভিজ্ঞ লোকরা দুজনের হাবভাব আচার ব্যবহার দেখে বুঝতে পারলেন যে দু’জনের দু’জনকে পছন্দ হয়েছে। যথাসময়ে বিয়ে হয়ে গেল। সিংহীর তিনটি বাচ্চা হল। দুটি পুরুষ আর একটি স্ত্রী। সার্কাসের মালিকের সঙ্গে কথা হয়েছিল যে ক’টা বাচ্চা হবে সেগুলো আধাআধি ভাগ হবে। কিন্তু তিনটি বাচ্চাকে তো আর অর্ধেক করা যায় না। তাই একটি পুরুষ ও একটি স্ত্রী বাচ্চা পি সি সরকার পেলেন আর একটি পুরুষ বাচ্চা পেল সার্কাস মালিক।
দুর্ভাগ্যের বিষয় স্ত্রী বাচ্চাটির কিছু শারীরিক সমস্যা থাকায় সেটি বেশিদিন বাঁচেনি। কিন্তু পুরুষ বাচ্চাটি বহুদিন বেঁচেছিল। সে-ও পি সি সরকারের বারুইপুরের বাড়িতে ঠাঁই পেয়েছিল। তার নাম রাখা হয়েছিল সুলতান। সুলতান বেঁচেছিল ২০ বছর। আর সম্রাট ২৩ বছর। মৃত্যুর পর বারুইপুরের বাড়িতেই কবর দেওয়া হয়েছিল দু’জনকে।
পরিশেষে একটা কথা চুপিচুপি বলে রাখি তোমাদের। এই সম্রাট একবার আমাদের এক সাংবাদিক বন্ধুকে থাবা মেরে দিয়েছিল। তারপর তাঁর কী অবস্থা হয়েছিল তা যেমন ভয়ঙ্কর, তেমনি হাস্যকর এক কাহিনী। আমাদের সেই বন্ধু যদি অনুমতি দেন তবে সে গল্পও শোনাব তোমাদের।