পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি কর্মে ব্যস্ততা। ব্যবসা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা। ... বিশদ
রথ বললেই মনে যে ছবি ভেসে ওঠে, তা একটা ছাদ-খোলা ঘোড়ার গাড়ির মতো। তার উপরে বিমর্ষ মুখে বসে আছেন মধ্যম পাণ্ডব অর্জুন। কাঁধ থেকে খসে পড়েছে গাণ্ডীব। তাঁর সামনে সারথি রূপে শ্রীকৃষ্ণ। পার্থকে কৃষ্ণ শোনাচ্ছেন ‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত’ বাণী। বহু পরিবারে এই ছবিটি বাঁধিয়ে রাখা থাকে। সংসারসমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়া মানুষ যেন কুরুক্ষেত্র সমরাঙ্গনের অর্জুন। সারথিরূপী শ্রীকৃষ্ণের গীতার বাণী আমাদের তাই বড় প্রয়োজন।
কৃষ্ণার্জুনের রথ হল যুদ্ধরথ। বিজয়োৎসবেও রথযাত্রা হতো। রথযাত্রার উৎস নিয়ে আছে নানা পৌরাণিক কাহিনি। প্রতিটিই সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের সামাজিক অবস্থা ও ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি। যেমন—ভাগবত পুরাণের বিখ্যাত কাহিনিটি, যেখানে কৃষ্ণকে হত্যা করার দুরভিসন্ধি নিয়ে তাঁর মামা, মথুরার অত্যাচারী রাজা কংস রথ পাঠিয়েছেন গোকুলে। কৃষ্ণ-বলরাম দুই ভাইকে নিয়ে যেতে কংসের দূত হয়ে এসেছেন অক্রূর। কাতর ব্রজরমণীরা রথের চাকা চেপে ধরলেন, কৃষ্ণকে কিছুতেই যেতে দেবেন না। বৈষ্ণবদের মধ্যে ওই দিনটি রথযাত্রা হিসেবে পালনের রীতি আছে।
আবার অত্যাচারী কংসের নিধনের পর কৃষ্ণ ও বলরাম যখন বিজয় রথে বের হয়ে মথুরাবাসীকে দর্শন দেন, কিছু ভক্তের কাছে সেই দিনটি রথযাত্রা।
দ্বারকায় নতুন রাজধানী স্থাপনের পর সুভদ্রা একদিন নগর ভ্রমণের আবদার করেন। বোনকে নিয়ে রথে চেপে ভ্রমণে বের হন কৃষ্ণ ও বলরাম। দ্বারকার অধিবাসীদের মধ্যে এই দিনটি রথযাত্রার দিন হিসেবে পালনীয়।
একবার কৃষ্ণের রানিরা ধরে বসলেন বলরাম ও সুভদ্রার মা রোহিণীকে— বৃন্দাবনে গোপিনীদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলার কাহিনি শোনাতে হবে। রোহিণী ভাবলেন, সুভদ্রার এই সব কথা শোনা উচিত হবে না। তাঁকে অন্য ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে বর্ণনা শুরু করলেন রাসলীলা। এমনই মধুর সেই লীলা, আড়াল থেকে শুনে সুভদ্রা আর থাকতে পারলেন না। ধীরে ধীরে দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়ালেন। কৃষ্ণ ও বলরামও তাঁদের নামের উল্লেখ শুনতে পেয়ে হাজির হলেন। স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগলেন। এই সময় সহসা দেবর্ষি নারদের আগমন। তিনি দেখলেন, কৃষ্ণ-বলরাম-সুভদ্রা একসঙ্গে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে কথা শুনছেন। এই রূপ তাঁর বড় ভাল লাগল। তিনি অনুরোধ করলেন, এই রূপে ভক্তদের চিরকাল দর্শন দিতে হবে। নারদের প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন কৃষ্ণ। সেই মূর্তিই পুরীধামে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা রূপে পূজিত হয়ে চলেছে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, জরা নামক ব্যাধের তিরে কৃষ্ণের স্থূল দেহের মৃত্যুর পর তাঁর অস্থি ও নাভি ভাসিয়ে দেওয়া হয় সাগরে। তা নাকি ভাসতে ভাসতে পুরীর সমুদ্রসৈকতে পৌঁছয়। ইতিমধ্যে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন, কৃষ্ণের অস্থি ভেসে আসবে এবং তা স্থাপন করতে হবে দারু মূর্তির গর্ভে। তৈরি করতে হবে কৃষ্ণ, বলরাম ও সুভদ্রার দারু মূর্তি। সুভদ্রাকে দাদাদের নগর-ভ্রমণ করানোর সেই পুরনো রীতি মেনেই বছরে একবার তিন ভাইবোন মিলে রথে চড়ে শ্রীমন্দির থেকে গুণ্ডিচা পর্যন্ত যাত্রা করেন। তাঁদের নগর দর্শনও হয়, আর ভক্তরাও ভগবানের দর্শন পান।
রথযাত্রার উৎস: ঐতিহাসিক
পুরীতে জগন্নাথদেবের ১২টি প্রধান ‘যাত্রা’ উৎসবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি— জ্যৈষ্ঠ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে ‘স্নানযাত্রা’ এবং আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে ‘রথযাত্রা।’ চতুর্দশ শতাব্দীর স্কন্দপুরাণের পুরুষোত্তম খণ্ডে এই দু’টি উৎসবের উল্লেখ রয়েছে। পরবর্তী সময়ে দু’টি সংস্কৃত পুঁথি—নীলাদ্রি মহোদয় ও বামদেব সংহিতায় এবং জগন্নাথদেব সংক্রান্ত অনুষ্ঠানের পুঁথি, সুক্ত সংহিতায় এই দু’টি যাত্রার উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু এই যাত্রার সূচনা কবে থেকে? ঐতিহাসিকদের মতে, পুরীতে ১২৩০ খ্রিস্টাব্দের আশেপাশে কোনও এক সময় জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা এই ত্রিমূর্তির আবির্ভাব। সুতরাং স্নানযাত্রা ও রথযাত্রা এর পরবর্তী কোনও সময়েই আরম্ভ হওয়া সম্ভব। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, ওই সময়ের আগে পুরীতে পুরুষোত্তম ও লক্ষ্মীর পুজো হতো।
একাদশ শতকে রাজা ভোজের ‘রাজ মার্তণ্ড’, দ্বাদশ শতকের কবি হর্ষদেবের ‘নৈষধচরিত’ ও জীমূতবাহনের ‘কালবিবেক’ গ্রন্থে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের মহাজ্যেষ্ঠী উৎসবের উল্লেখ আছে। কিন্তু রথযাত্রার কথা লেখা নেই।
অনেক জায়গাতেই এখন মহাসমারোহে রথযাত্রা পালিত হয়। তবুও পুণ্যভূমি পুরীর মাহাত্ম্য স্বতন্ত্র। নির্দিষ্ট দিনের মাসখানেক আগে থেকে উৎসবের প্রস্তুতির সূচনা। রথ হল ঈশ্বরের দিব্য আবির্ভাব। রথ নির্মাণ ও রথযাত্রা হল ভক্ত-ভগবানের মিলন। তাই রথযাত্রা শুধু একটি উৎসব নয়, এর একটি গভীর আধ্যাত্মিক তাৎপর্যও রয়েছে। শ্রীমন্দির থেকে পথে বেরিয়ে গুণ্ডিচা বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা হল সংসার-বিরক্ত মোক্ষকামী জীবের নিবৃত্তির পথে যাত্রা। রথের দড়িতে টান দিলে রথ চলে। ওই টান হল পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার মিলনের আকুলতা। গুণ্ডিচা বাড়ি হল ভক্ত-ভগবানের মিলন। এরপর উজানে চলা। ফিরতি পথ হল স্বধামে গমন, জীবের স্ব-স্ব রূপে প্রত্যাবর্তন। এই হল রথযাত্রার আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনা।
প্রচলিত কাহিনি
রথযাত্রা কবে শুরু হয়েছে বা কে প্রথম শুরু করেছেন, সে বিষয়ে সঠিক কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু এ নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে একাধিক কাহিনি। বলা হয়, এই ত্রিমূর্তি নির্মাণ করেছেন স্বয়ং দেব-কারিগর বিশ্বকর্মা। তিনি গুণ্ডিচা মন্দিরে বসে কাজ করছিলেন এবং অসময়ে মন্দিরের দরজা খুলে ফেলা হলে মূর্তি নির্মাণ অসম্পূর্ণ রেখেই বিশ্বকর্মা অন্তর্ধান করেন। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন নির্মীয়মাণ মূর্তিগুলি এনে বিধিমতো শ্রীমন্দিরে স্থাপন করেন। এই সময় রানি গুণ্ডিচার প্রার্থনা শুনে জগন্নাথদেব জানান, বছরান্তে একবার কিছু সময়ের জন্য তিনি শ্রীমন্দির থেকে এই মন্দিরে এসে অবস্থান করবেন। সেই মতো আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়ায় বলদেব ও সুভদ্রা সহ গুণ্ডিচা মন্দিরে আসার জন্য রথে চড়েন জগন্নাথদেব। এটিই তাঁর দ্বাদশ যাত্রার সর্বোত্তম ও জনপ্রিয়তম রথযাত্রা। পথমধ্যে শ্রীমন্দির ছেড়ে আসা জগন্নাথদেবের দর্শন পান আপামর জনসাধারণ।
রথ নির্মাণ
রথ তৈরিরও নানা নিয়ম রয়েছে। সেই সমস্ত নিয়ম পুঙ্খানুপুঙ্খ লিখিত রয়েছে মাদলাপঞ্জীতে। প্রাচীনকাল থেকে কঠোর ভাবে পালিত হয়ে আসছে সেই সমস্ত নিয়ম। নির্মাণকাজ শুরু হয় অক্ষয় তৃতীয়ায়। প্রতি বছরই নতুন করে গড়ে তোলা হয় তিনটি রথ। জগন্নাথের রথ আকারে সবচেয়ে বড়। নাম নন্দীঘোষ (গরুড়ধ্বজ বা কপিধ্বজ)। বলরামের রথ বল ও শক্তির প্রতীক, নাম তালধ্বজ। সুভদ্রার রথ ঔদার্য ও করুণার প্রতীক, নাম দর্পদলন।
ছেরা পহরা
রথের দিন সকালে পুরীর রাজা, গজপতি মহারাজা ও তাঁর বংশধররা রাজপোশাক পরিধান করে মন্দিরে আসেন। রাজা গর্ভমন্দিরে প্রবেশ করে শ্রীবিগ্রহ রথে তুলে দেওয়ার জন্য সিংহাসনের পিছনে গিয়ে ভক্তি সহকারে বিগ্রহ সামান্য ঠেলে দিয়ে প্রতীকী অর্থে রথযাত্রার শুভ সূচনা করেন। বিগ্রহকে রথে বসানো হলে সুখে উপবেশনের জন্য রাজা নিজে ভগবানের পিঠে তাকিয়া দেন। রথযাত্রার শুরু হওয়ার আগে সোনার ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করা হয়। ঝাড়ুর প্রতিটি সঞ্চালন যেন নীরব বার্তা দেয়—‘ঈশ্বরের কাছে সকলের সমান অধিকার! রাজাধিরাজ জগন্নাথের কাছে ধনী-নির্ধন, পণ্ডিত-মূর্খ, ব্রাহ্মণ-ম্লেচ্ছ কোনও ভেদ নেই।’ এরপর রথ টানা আরম্ভ হয়। এই অনুষ্ঠানটির নাম ছেরা পহরা।
রথ টানা
প্রথমে বলদেবের নীলবর্ণের রথ এগিয়ে চলে, মাঝে থাকে কৃষ্ণ বর্ণের দেবী সুভদ্রার রথ। পরিশেষে চলতে থাকে রথযাত্রার মূল আকর্ষণ শ্রীজগন্নাথের পীতবর্ণের সুসজ্জিত রথ। হাজার হাজার মানুষের মাঝে রাজকীয় চালে চলতে থাকে সেই রথ। বিপুল সংখ্যায় ভক্তরা জড়ো হন রথের দড়ি ধরে টানবেন বলে। রথ অগ্রসর করতে দড়ি ধরে রথ টানা এক মহা পুণ্যের কাজ বলে মনে করেন ভক্তরা। মাঝে মাঝে রথ থেকে লাল পতাকা দেখালেই টানা থেমে যায়। সবুজ পতাকায় আবার চলতে থাকে। অপরিসীম ভক্তি, বিশ্বাস, দেশ-দেশান্তর থেকে নানা বর্ণ, ভাষা, ধর্মের মানুষকে রথের সামনে টেনে আনে।
গুণ্ডিচা বাড়িতে রথ অবস্থান
গুণ্ডিচা বাড়িতে রথ পৌঁছলে জগন্নাথদেব, বলরাম ও সুভদ্রা সহ আটদিন এখানে থেকে ভক্তদের দর্শন দেন। শ্রীমন্দিরের মতোই এখানেও আটদিন ধরে জগন্নাথদেবের সেবাপুজো ভোগরাগ ও আরতি যথানিয়মে চলে।
বহুড়া যাত্রা (উল্টোরথ)
অষ্টম দিনে দেবত্রয়ী পুনরায় নিজ নিজ রথে চড়ে ফিরে চলেন শ্রীমন্দিরে। এটিই পুনর্যাত্রা বা স্থানীয়ভাবে বহুড়া যাত্রা নামে পরিচিত। ভক্তরা ফের রথ টেনে নিয়ে আসেন। ফিরতি পথে, বড় দণ্ড-এর (গ্র্যান্ড অ্যাভিনিউ) উপর ভক্ত সালাবেগের সমাধির সামনে রথ থামে। ১৬ শতকের মরমীয়া সাধক সালাবেগ জাতিতে ছিলেন মুসলিম। কিন্তু কবির আন্তরিক ভক্তিতে বাঁধা পড়েন জগন্নাথদেব। বৃন্দাবন থেকে আসা সালাবেগকে দর্শন দেবেন প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁর অপেক্ষায় যাত্রা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন জগতের নাথ। সেই থেকে ওই একই স্থানে রথ দাঁড় করানো হয়, যাতে সালাবেগ প্রভুর দর্শন পান। এরপর রথ আবার সচল হয়। শ্রীমন্দির দ্বারে উপস্থিত হয় রথ। একাদশীতে হয় সোনাবেশ। তার পরের দিনের অনুষ্ঠানের নাম অধরপনা। একদিন পরে লক্ষ্মীদেবীর মানভঞ্জন করতে রসগোল্লার ভেট দিয়েই শ্রীমন্দিরে ফিরে যেতে পারেন জগন্নাথদেব। পুনরায় অবস্থান করেন রত্নবেদিতে।
কঠোপনিষদে রথে জগন্নাথ দর্শন করাকে বলা হয়েছে, ‘রথে তু বামনং দৃষ্ট্বা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে...।’ অর্থাত্ রথে অবস্থিত বামন রূপে জগন্নাথকে দর্শন করলে মানবের পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হয় না। জনশ্রুতি হলেও একথা বিশ্বাস করেন ভক্তরা। তাই প্রভুর রথ দেখলেই সকলে সমস্বরে বলে ওঠেন—‘জয় জগন্নাথ! জয় জগন্নাথ!’