পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি কর্মে ব্যস্ততা। ব্যবসা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা। ... বিশদ
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নতুন দল তৈরির ১৩ বছর পর রাজ্যের ক্ষমতায় এসেছিল তৃণমূল। তৃণমূল সরকারের বয়সও ১৩ বছর হয়ে গেল। টানা ক্ষমতায় থাকলে সরকার ও শাসক দলের বিরুদ্ধে অ্যান্টিইনকামবেন্সি ফ্যাক্টর কাজ করে। এটাই গণতন্ত্রের নিয়ম। লাগাতার লড়াই, আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে ক্ষমতায় বসা তৃণমূলও তার বাইরে নয়। নজিরবিহীন পরিষেবা ও ছন্নছাড়া বিরোধীদের দৌলতে তৃণমূল একের পর এক নির্বাচনে জিতলেও অন্দরে বাসা বেঁধেছে ঘুণপোকা। সে কারণেই তৃণমূলের ঘাড়ে চাপছে ‘নেগেটিভ’ ভোটের বোঝা। তাই কোনও কাজ না করে, এমনকী সংগঠন না থাকা সত্ত্বেও বিজেপি রাজ্যের অধিকাংশ শহরে তৃণমূলকে পিছনে ফেলে দিয়েছে।
লোকসভা ভোটে শহরে খারাপ ফলের কারণ বিশ্লেষণ করেছে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। তাতে দেখা গিয়েছে, কিছু পুরসভার চেয়ারম্যান ও কাউন্সিলারদের জন্যই এই ফল। তাঁদের স্বজনপোষণ মাত্রা ছাড়িয়েছে। আগে প্রোমোটার ও জমির দালালদের কাছ থেকে পাওয়া কমিশনেই ভরত পেট। কিন্তু লোভ আগুনের মতোই সর্বগ্রাসী। বিবেক, মনুষ্যত্ব, বিবেচনাবোধ, সব পুড়িয়ে খাক করে দেয়। তাই এখন বহু কাউন্সিলার, এমনকী বিধায়কও আটকে আছেন ‘সিন্ডিকেট মধু’তে। তাঁদের কাছ থেকেই কিনতে হবে ইট, বালি, পাথর, সিমেন্ট। তা না হলে ভিত পুজোর ইট ছাড়া আর কোনও ইটই গাঁথা হবে না।
আগে বহুতল নির্মাণের অনুমতি দিত পুরসভা। তারজন্য ‘প্রণামী’ দিতে হতো পুরসভার কর্তাদের। তার জোরে দু’কাঠা জমিতেও উঠে যেত পাঁচতলা বিল্ডিং। ছাড়ছোড়ের বালাই নেই। এখন বহুতল নির্মাণের অনুমতি নিতে হয় অনলাইনে। সবটাই রাজ্যের হাতে। তা বলে ‘প্রণামী’ তো বন্ধ হতে পারে না! এখন নেতাদের ‘প্রণামী’ মেলে নির্মাণে বাধা না দেওয়ার জন্য। তবে প্রণামীরও রেটকার্ড আছে। জমির দাম এবং লোকেশন অনুসারে সেটা ঠিক হয়, ১৫ থেকে ২৫ লক্ষ।
সিপিএম আমলে একটা সিস্টেম ছিল। টাকা একজন নিয়ে গেলে দলের দ্বিতীয় কেউ টাকা নিতে যেত না। কিন্তু এখন ‘ঈশ্বর’ এক এবং অদ্বিতীয় নয়। ফলে তুষ্ট করতে হয় জনে জনে। সব মাতব্বরকে খুশি করতে পারলেই মাথা তুলে দাঁড়ায় বহুতল। ‘প্রণামী’র জন্য প্রতিটি শহরে ফ্ল্যাটের দাম হু-হু করে বাড়ছে। তবে, নারদা কাণ্ড থেকে শিক্ষা নিয়েছেন নেতারা। গোপন ক্যামেরার ভয়ে নেতারা এখন আর সরাসরি নিজে টাকা নেন না। তাঁরা ‘সেফ’ খেলেন। রেখেছেন ‘পিএ’। সেটিংটা সেই পিএ করেন। তবে, সেটিং না হলে কাজ বন্ধ করার জন্য আছে স্পেশাল টিম।
এছাড়া সরকারি জায়গায় গুমটি বসানো ও দোকান করার জন্য টাকা আদায় তো আছেই। শুধু নতুন বাড়ি বা বহুতল নির্মাণেই নয়, জমির প্লটিং, এমনকী মেরামতির কাজেও দিতে হয় টাকা। না দিলেই কাজ বন্ধ। বাদ যাচ্ছেন না টোটো চালকরাও। একবার পুরসভার পারমিশন নেওয়ার জন্য টাকা দিতে হয়। পরের বার বলা হয়, অনুমতি নিতে হবে পরিবহণ দপ্তর থেকে। তারজন্য আবার টাকা। তাতেও রেহাই নেই। টোটোয় রড লাগাতে হবে চালকের ডানদিকে। সেই রড নিজে লাগালে হবে না। নেতার ‘নোমিনেটেড’ লোকই তা লাগাবে। তারজন্যও দিতে হবে মোটা টাকা। তারপর আবার সব টোটোকে করতে হবে একই রঙের। সেই রং-ও করবে নেতার ঠিক করা ঠিকাদার। তারজন্য আবার টাকা।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গরিব মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার জন্য একের পর এক জনমুখী প্রকল্প ঘোষণা করছেন। অথচ তাঁর দলেরই কিছু নেতা বের করছে টাকা আদায়ের নিত্যনতুন ফিকির। তবে, বিষয়গুলি তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের নজরে এসেছে। ব্যবস্থা না নিলে এগুলিই যে বিষবৃক্ষ হবে, সেটা তৃণমূল সুপ্রিমো বুঝেছেন।
উনিশের নির্বাচনে তৃণমূল আরও বড় ধাক্কা খেয়েছিল। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা না করে ত্রুটিগুলি সামনে এনে সংশোধনের রাস্তায় হেঁটেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারজন্যই একুশের নির্বাচনে এসেছিল বিপুল সাফল্য। চব্বিশের ভোটে শহরে ধাক্কা খেয়েছে তৃণমূল। তাই তিনি দলের মাতব্বর নেতাদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নিতে চাইছেন।
বেআইনি কামাইয়ের রাস্তা সঙ্কুচিত হলে সেই ‘পেশা’র প্রতি আকষর্ণ কমে। এরাজ্যের রেশন ব্যবস্থা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বাম আমলে, এমনকী রাজ্যে ক্ষমতা পরিবর্তনের পরেও ডিলারশিপ পাওয়ার জন্য লোকজন হামলে পড়ত। তখন রেশনশপ চালানোর অনেক ঝক্কি ছিল। রেশনের চাল নিয়ে প্রায়ই ক্ষোভ, বিক্ষোভের ঘটনা ঘটত। বাম আমলে বিক্ষোভের জেরে ডিলারের বাড়িতে আগুন, ভাঙচুর, গণপ্রহার কিছুই বাদ যায়নি। তা সত্ত্বেও ডিলারশিপ পাওয়ার জন্য ঘুষ দিতেও অনেকে কার্পণ্য করত না। আর এখন? রেশনের সামগ্রী নিয়ে কোনও অভিযোগ নেই। ঝকঝকে চাল। তাও ডিলারশিপ নিতে চাইছে না। কিন্তু কেন?
বাম আমলে ছিল লক্ষ লক্ষ ভুয়ো রেশন কার্ড। সেই কার্ডে রেশন সামগ্রী বরাদ্দ হতো। সেই চাল, গম, চিনি বেশি দামে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিত। তাতে মোটা টাকা আসত। উপরতলায় তার ভাগ দিয়েও থাকত অনেকটাই। কিন্তু এখন ভুয়ো রেশন কার্ড নেই বললেই চলে। গ্রাহকের আঙুলের ছাপ ছাড়া তোলা যায় না রেশন সামগ্রী। ফলে বন্ধ ‘বেআইনি’ কামাই। এখন রেশনে সবটাই খাটুনির পয়সা। তাই ডিলারশিপ নেওয়ার আগ্রহ কমেছে। খাদ্যদপ্তর একের পর এক বিজ্ঞাপন দিয়েও ডিলার পাচ্ছে না। ডিলারশিপের পদ যতগুলি খালি ততগুলি আবেদনপত্রও জমা পড়ছে না।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চেয়ারম্যান, কাউন্সিলারদের সেই বেআইনি কামাইয়ের রাস্তাটা বন্ধ করতে চাইছেন। তিনি বলেছেন, ‘যাঁরা জনসেবা করতে চান, মানুষের জন্য কাজ করতে চান, তাঁরাই কেবল থাকুন।’ মুখ্যমন্ত্রী চাইলেই তা করতে পারবেন, এমনটা নয়। আবার পারলেও সেটা চিরস্থায়ী হবে না। কারণ ক্ষমতা হল দুর্নীতির আঁতুড়ঘর। তাই শুদ্ধিকরণও একটা নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। মমতা সেটাই চাইছেন। এখনও মানুষ তাঁর কথা বিশ্বাস করে। বিশ্বাস আছে বলেই তাঁর কাছে অভিযোগ জানানোর জন্য পড়ছে লম্বা লাইন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই উদ্যোগ কতটা সফল হবে বা আদৌ হবে কি না, সেটা বলবে সময়। তবে, তিনি যেভাবে দলের নেতাদের দুর্নীতি এবং স্বজনপোষণ নিয়ে মুখ খুলেছেন, তা নজিরবিহীন। তিনি আন্তরিকভাবে শুদ্ধিকরণ চান বলেই সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দলের নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র নেওয়ার সাহস দেখিয়েছেন। তার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়াও শুরু করেছেন। এভাবে আম জনতার কাছ থেকে অভিযোগ নেওয়ার বুকের পাটা দেশের আর কোনও নেতা-নেত্রী দেখাতে পারেননি।
তৃণমূল সূত্রের খবর, জমা পড়া সমস্ত অভিযোগ খতিয়ে দেখে একে একে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রোগ নিরাময়যোগ্য হলে দেওয়া হবে ‘ওষুধ’। না হলে তোলা হবে ওটি টেবিলে। এবার একুশে জুলাই সেই বার্তাই দেওয়া হবে। ফলে এবার অনেক নেতা ধর্মতলায় যাবেন হাসিমুখে, কিন্তু ফিরবেন মুখ চুন করে। তাই অনেকেই বলছেন, এবারের একুশে জুলাইটা অনেক নেতার জন্য আক্ষরিক অর্থেই ‘শহিদ দিবস’ হতে চলেছে।