পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি কর্মে ব্যস্ততা। ব্যবসা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা। ... বিশদ
সেই বোমার আগুনের আঁচ পৌঁছে দিয়েছেন ঢাকার ইসলামপুরের আসফ জমাদার লেনের এক তরুণের প্রাণে। কলকাতার বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিটের আরেকটি প্রাণও জ্বলছে সেই আগুনের তাপে।
পরদিন একটি ইংরেজি সংবাদপত্রে ফলাও করে প্রকাশিত হল—‘বেলুড় মঠের মাংসভোজী সন্ন্যাসীর মৃত্যু হয়েছে।’ এমন অপমান এদেশের মানুষের থেকে কম পাননি স্বামীজি। তবুও বিশ্বাস করেছেন, মানুষ জাগবেই। সখারাম গণেশ দেউস্করের সঙ্গে আলোচনার মধ্যে বলেছিলেন, ‘আমি মরবার আগে দেখে যেতে চাই ভারত একটা বারুদের স্তূপ হয়ে আছে।’
৫ জুলাই, ১৯০২। স্বামীজির মৃত্যুর পরদিন, ৯১ বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়ি থেকে সতীশচন্দ্র ছুটতে ছুটতে গেলেন স্বামী সারদানন্দের কাছে। মৃত্যুর আগে কী নির্দেশ দিয়েছেন স্বামীজি? ব্যাকুল সতীশচন্দ্রের মনের চঞ্চলতা উপলব্ধি করেন সারদানন্দ। বললেন, ‘স্বামীজি যে কাজ তোমাদের করতে বলেছিলেন, সেই কর্মযজ্ঞ অব্যাহত রাখবে। একটা কাক দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকলে যেমন মুক্তির জন্য ঝটপট করে, তেমনি তোমরাও মুক্তির জন্য জীবন দেবে! সিস্টার তোমাদের পথ দেখাবেন।’
নিবেদিতা! নামটা শুনেই মনটা তৃপ্ত হয়ে যায় সতীশচন্দ্রের। কলকাতাকে দেওয়া স্বামীজির শ্রেষ্ঠ উপহার। আইরিশ বিদ্রোহের জ্বলন্ত অগ্নি। ১৬ নম্বর বোসপাড়া লেন। কলকাতার বিদ্রোহী যুবকদের চেনা ঠিকানা। ছুটে আসেন সতীশচন্দ্র। মনে বহু প্রশ্ন আর অনিশ্চয়তা। মাতৃস্নেহে সতীশচন্দ্রকে সান্ত্বনা দিলেন নিবেদিতা। স্বামীজির মৃত্যু সংবাদ পেয়ে বেলুড় মঠে গিয়ে কী দেখেছিলেন, জানালেন। ঘরের মেঝের উপর হরিদ্রাবর্ণের ফুলের চাদর আবৃত হয়ে শায়িত স্বামীজির দেহ। ক্লান্ত শিশু যেন মায়ের কোলে ঘুমিয়ে থাকে। তেমনই মহাযোগী মগ্ন মহাযোগে। পদ্মচক্ষুদু’টি ঊর্ধ্বগামী, মুখে প্রশান্তি। বলতে বলতে তন্ময় সিস্টার। সম্বিত ফেরে সতীশচন্দ্রের করুণ মুখে মৃদু আর্তনাদ শুনে। আদেশের সুরে বলেন, ‘স্বামীজি নেই, আমি তো আছি। তোমরা স্বামীজির উপদেশ জান। বস্তিতে বস্তিতে কাজ করতে হবে। লাঠি, মুগুর খেলবে, শরীরচর্চা করবে!’
সতীশচন্দ্র স্বামীজির নির্দেশেই গড়ে তুলেছিলেন ‘হিস্টরিক্যাল ক্লাব।’ তাঁর কলেজ জেনারেল অ্যাসেম্বলি ইনস্টিটিউশনের (বর্তমান স্কটিশচার্চ কলেজ) ছাত্রদের নিয়ে। স্বামীজিও এই কলেজের অ্যালমনি।
স্বামীজি বেঁচে থাকতেই মহাযজ্ঞের আবহ সঙ্গীত বেজে উঠেছিল। ১৯০২ সালের ১০ মার্চ। দোল পূর্ণিমার দিন সতীশচন্দ্র ৪৯ নম্বর কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে বন্ধুদের নিয়ে তৈরি করা ক্লাবের নাম দিয়েছিলেন ‘অনুশীলন সমিতি।’ সভাপতি হলেন ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্র। নিউ ইন্ডিয়ান স্কুলের প্রধান শিক্ষক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য থেকে অনুশীলন সমিতি নাম দিয়েছিলেন। স্বামীজির মহাপ্রয়াণ নাড়া দিয়ে গেল সতীশচন্দ্র সহ সমিতির সদস্যদের। মনে মনে সংকল্প করেন তাঁরা, স্বামীজির ইচ্ছা বাস্তবায়িত হবেই।
এরই মধ্যে কলকাতায় টানা সাতদিন বৃষ্টির পর দেখা দিল প্লেগ। সারদানন্দ ও নিবেদিতার সেবা কার্যের প্রধান সেনাপতি সতীশচন্দ্র। সেবা কার্যের জন্য প্রতিষ্ঠা হয় ‘বিবেকানন্দ সোসাইটি’। তাদের অক্লান্ত সেবায় কলকাতার অনেকে রক্ষা পেলেন মহামারি থেকে। কলকাতার বৃন্ধাবন বোস লেনে গড়ে ওঠে বিবেকানন্দ সোসাইটির কার্যালয়। অনুশীলন সমিতির তরুণ কর্মীদের আস্তানা।
এতেই খুশি নন সতীশচন্দ্র। বিবেকানন্দের ইচ্ছার পূর্ণতা দিতে হলে চাই আরও বড় কর্মপ্রচেষ্টা। প্রেসিডেন্ট প্রমথনাথ মিত্র কর্মপ্রচেষ্টার উদ্বোধনের জন্য বাংলার বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ শুরু করলেন। ঢাকায় অনুশীলন সমিতির প্রতিষ্ঠাতা পুলিনবিহারী দাস। প্রমথনাথক নিয়ে এলেন ঢাকায়। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর ঢাকায় তরুণদের একটি সভা। প্রধান বক্তা প্রমথনাথ। আলোচনায় গভীরে প্রবেশ করেছে সকলে। হঠাৎ একটি ছেলে বলে ওঠে ‘শুধু কথা নয় কাজ চাই, স্বামীজির এই নির্দেশ ছিল।’ তরুণ ছেলেটির নাম হেমচন্দ্র ঘোষ। ঢাকায় স্বামীজির নিজ হস্তে প্রজ্জ্বলিত শিখা। উৎসাহিত প্রমথনাথ তাঁর সঙ্গে কথা বলেন।
ঢাকার ইসলামপুরের আসফ জমাদার লেনে থাকেন হেমচন্দ্র। মহাপ্রয়াণের এক বছর আগে বিবেকানন্দ ঢাকা ভ্রমণে যান। ১৯০১ সালের ১৯ মার্চ রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে মুখরিত জনতার সখ্যে প্রথম স্বামীজিকে দেখেছিলেন হেমচন্দ্র ঢাকায় স্বামীজি ছিলেন ফরাসগঞ্জে জমিদার মোহিনীমোহন দাসের বাড়িতে। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বহুমানুষ ভীড় করেছিলেন। হেমচন্দ্রও দর্শনপ্রার্থী। প্রথম দর্শনে আর তেজোদীপ্ত ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হলেন তিনি।
সতেরো দিনের ঢাকা ভ্রমণে হেমচন্দ্র সঙ্গী হলেন বিবেকানন্দের। হেমচন্দ্রের জীবনের গতিপথ স্বামীজির স্পর্শে পাল্টে গেল। জীবনে এক নতুন অশোকের সন্ধান পেলেন। হেমচন্দ্রের তরুণ মনের অনেক প্রশ্ন, দ্বিধা-দ্বন্দ্বকে কাটিয়ে স্বামীজি বললেন, ‘আগে চরিত্রবান হও। দেশের সেবা যদি করতে চাও তাহলে বিপ্লবী হও। দেশ মাতৃকার দুর্গতি দূর করিবার জন্য প্রচণ্ড শক্তি ও সাহস সঞ্চয় করে অগ্রসর হও।’
হেমচন্দ্র প্রথম শুনলেন একটি শব্দ ‘বিপ্লবী’। তাঁর পরবর্তী জীবনের রূপরেখা নিজের হাতেই এঁকে দিলেন বিবেকানন্দ। হেমচন্দ্রের বন্ধু শ্রীশচন্দ্র পাল, আলিমুদ্দিন আহমেদও এই দুর্লভ দর্শন এবং আশীর্বাদ লাভের সাক্ষী। তার আগে পর্যন্ত তাঁদের মধ্যে ছিল শুধুই বন্ধুত্ব। স্বামীজির স্পর্শে সেই সম্পর্ক হয়ে উঠল একই আদর্শে উৎসর্গিত মরমি সুহৃদ— কমরেড ইন ফেইথ।
স্বামীজির মৃত্যু সংবাদ আকুল করে তুলেছিল হেমচন্দ্রকে। তাঁর শেষ ইচ্ছার সফল রূপান্তর ঘটাতে তৈরি করেন একটি গোপন সংগঠন।
ঢাকা থেকে ফেরবার সময় হেমচন্দ্রকে কলকাতায় আসতে বলেন প্রমথনাথ। ১৯০৫ সালেই গুপ্ত দল প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। নাম দিলেন ‘মুক্তি সংঘ’। স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে দলের কার্যক্রমে অসহায়, দুর্গত মানুষের মধ্যে সেবার কাজও অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯০৫ সালের মাঝামাঝি হেমচন্দ্র এলেন কলকাতায়। দেখা করলেন নিবেদিতা ও ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের সঙ্গে। অনুশীলন সমিতি, আত্মোন্নতি সমিতির সঙ্গেও যোগাযোগ হয়। হেমচন্দ্র দেখলেন কলকাতাতেও স্বামীজির আদর্শে বিশ্বাসী তরুণদল তৈরি হচ্ছে।
স্বামীজির মৃত্যু যেন বজ্রের মতো নেমে এসেছে বাংলায়। চন্দননগরের তরুণ কর্মী মতিলাল রায় তখন সহকর্মী সাগরকালী ঘোষ, ননীলাল দে, সত্যচরণ কর্মকার প্রমুখদের নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দের ‘বীরবাণী’ ভিত্তিক এক সেবাদল ‘সৎপথাবলম্বী সম্প্রদায়’ গড়ে তোলেন। চন্দননগরেও এসেছিলেন বিবেকানন্দ। চেয়েছিলেন বাংলায় অস্ত্র সরবরাহের কেন্দ্র হোক চন্দননগর। স্বামীজির মৃত্যু বাংলার সকল বিপ্লবী মানসিকতাকে ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করেছিল।
স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ অনুযায়ী সমিতি মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিল। মুষ্টিভিক্ষার সাহায্যে চাল এবং দ্রব্য সংগ্রহ করে দরিদ্র পরিবারদের সাহায্য করা হতো। বন্যা বা দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে সাহায্য ও চিকিৎসার কাজের জন্য পাঠানো হতো সমিতির সদস্যদের। বাংলায় সমিতির প্রথম যুগ এল। বিপ্লবী কাজের আগে চাই খাঁটি মানুষ। স্বামীজির এই শিক্ষাই মুক্তি পাগল তরুণ হৃদয়ের মর্মবাণী। বিবেকানন্দ মৃতপ্রায় জাতির বুকে প্রাণ সঞ্চার করার জন্য বলেছিলেন, ‘Arise Awake and Stop Not Till the goal is Reached’. বিপ্লবীরা তা চ্যালেঞ্জ হিসাবে গ্রহণ করলেন। দেখতে দেখতে অনুশীলন সমিতির কার্যালয় বারুদের স্তুপে পরিণত হল।
স্বামীজির আহ্বান মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে নিবেদিতা কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দিতেন। কলকাতার টাউন হলে নিবেদিতার Dynamic Religion বক্তৃতা শুনে বিপিনচন্দ্র পাল বলেছিলেন, ‘এতো পুরো Dynamite।’ অনুশীলনের কর্মীরা তৈরি হয় ডিনামাইটের মতো ফেটে পড়বার জন্য। ম্যাৎসিনির আত্মজীবনী, ক্রোপটকিনের মেমরিজ অফ এ রেভোলিউফানিস্ট, বিবেকানন্দের ‘বর্তমান ভারত’ বিপ্লবীদের অবশ্য পাঠ্য। ম্যাৎসিনির বইয়ের শেষ অংশে ‘গেরিলাযুদ্ধ’ অধ্যায়টা নিবেদিতার খুব প্রিয়। তিনি স্বপ্ন দেখেন, এই শহরের বুক থেকে ছড়িয়ে পড়বে যুদ্ধের বার্তা। এই অংশটা নিজে টাইপ করে সমিতির তরুণ সদস্যদের পড়তে দিতেন। দেখতে দেখতে সারা বাংলায় প্রচারিত হল ‘গেরিলা যুদ্ধ’।
বাঙালি বিপ্লবীদের উপরে বিবেকানন্দের মৃত্যু যে গভীর প্রভাব ফেলেছিল লক্ষ্য করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ডাঃ সরসীলাল সরকারের পত্রের উত্তরে ১৯২৮ সালের ৯ এপ্রিল রবীন্দ্রনাথ সেই সময়ের সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেন—
‘আধুনিককালের ভারতবর্ষে বিবেকানন্দই একটি মহৎ বাণী প্রচার করেছিলেন, সেটি কোনও আচারগত নয়। তিনি দেশের সকলকে ডেকে বলেছিলেন, তোমাদের সকলের মধ্যে ব্রহ্মের শক্তি— দরিদ্রদের মধ্যে দেবতা তোমাদের সেবা চান। এই কথাটা যুবকদের চিত্তকে সমগ্রভাবে জাগিয়েছে। তাই এই বাণীর ফল দেশের সেবায় আজ বিচিত্রভাবে বিচিত্র ত্যাগে ফলছে। তাঁর বাণী মানুষকে যখনই সম্মান দিয়েছে তখনই শক্তি দিয়েছে। সেই শক্তির পথ কেবল একঝোঁকা নয়, তা কোনও দৈহিক প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তির মধ্যে পর্যবসিত নয়, তা মানুষের প্রাণ-মনকে বিচিত্রভাবে প্রাণবান করেছে। বাংলাদেশের যুবকদের মধ্যে যেসব দুঃসাহসিক অধ্যাবসায়ের পরিচয় পাই তার মূলে আছে বিবেকানন্দের সেই বাণী যা মানুষের আত্মাকে ডেকেছে, আঙুলকে নয়।’
বিবেকানন্দের আহ্বান যুবকদের উদ্বেল করেছিল। অস্থিরতার তারনায় বাংলায় এসেছিল বিপ্লবের যুগ। মৃত্যুর আগে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে ‘বোমা’ অস্ত্র চেয়েছিলেন বিবেকানন্দ। ১৯০৫ সালে অরবিন্দ ঘোষের নতুন কর্মপন্থা বিবেকান্দ কাঙ্ক্ষিত সশস্ত্র প্রতিরোধের স্বপ্নকে বাস্তব করেছিল। ১৯০৭ সালে ভারতের ক্রিমিন ইন্টালিজেন্স প্রধান জেমস ক্যাম্বেলকার মৃত্যুর পরের বিবেকানন্দ বিপ্লবীদের হৃদয়ে কতটা সক্রিয় তার উল্লেখ করেছেন পলিটিক্যাল ট্রাবল ইন ইন্ডিয়া (১৯০৭-১৭) গ্রন্থে। দৈহিক মৃত্যু ঘটলেও বিবেকানন্দের প্রেরণা জাজ্জ্বল্যমান বহ্নিশিখার মতো লেলিহান হয়ে জ্বলতে লাগল অগ্নিযুগের কাণ্ডারিদের মননজগতে।
সহযোগিতায় : বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী