পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি কর্মে ব্যস্ততা। ব্যবসা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা। ... বিশদ
ভ্রমণ, আতিথেয়তা, বিনোদন এবং অন্যান্য সুবিধা খাতে রাজ্যপাল বোস বছরে ভাতা পেয়ে থাকেন ১ কোটি ৮১ লক্ষ টাকা। দেশের মধ্যে সর্বাধিক। তাও তিনি বিলে সই করেন না। বিধায়ক বা মন্ত্রীদের শপথে সিলমোহর না দিয়ে দিল্লি চলে যান। জনপ্রতিনিধি এবং পরিষেবার অপেক্ষায় বসে থাকতে হয় রাজ্যের মানুষকে।
রাজ্যপাল বোস ঘর সাজানোর সরঞ্জামের জন্য পেয়ে থাকেন ৮০ লক্ষ টাকা। আর দার্জিলিংয়ের রাজভবনের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৭২ লক্ষ টাকা। তারপরও বোসবাবুর বিরুদ্ধে তাঁরই রাজভবনের অস্থায়ী কর্মীকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ ওঠে। এবং সেই ইস্যুতে কোনও প্রশ্ন তোলা যায় না। কারণ, তিনি রাজ্যপাল। সাংবিধানিক পদ। তদন্তের ঊর্ধ্বে। আর তাই তাঁর জন্য বরাদ্দ থাকে ‘রক্ষাকবচ’।
উপরে যে কয়েকটি প্রাপ্তিযোগের কথা বলা হয়েছে, তার সবই কিন্তু জুগিয়ে থাকে রাজ্য সরকার। অর্থাৎ, রাজ্যবাসীর করের টাকায় রাজ্যপালের সংসার চলে বললেও খুব ভুল বলা হবে না। তাই রাজ্যবাসী যদি তাঁর কাছে শুধু তাঁর কর্তব্যটুকু দাবি করে? যদি বলে, আপনি মশাই নিরপেক্ষ থাকুন! তাহলেও কি অন্যায় হবে? কিন্তু না, সংবিধান নাকি রাজ্যপালের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার ব্যাপারে প্রত্যেক নাগরিকের হাত-পা বেঁধে রেখেছে। উনি সবার ঊর্ধ্বে। তাই কোনও প্রশ্ন নয়, নো কোয়েশ্চেন! তিনি রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান। রাষ্ট্রপতি স্বয়ং তাঁর নিয়োগে সই করে থাকেন। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে রাজ্য সরকারের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে থাকেন। এই সবই টেকনিকাল কথাবার্তা। বাস্তবটা হল, রাজ্যপাল এদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কেন্দ্রের প্রতিনিধি এবং কখনও বশংবদ। যদি ডাবল ইঞ্জিন হয়, নো প্রবলেম। সমন্বয়ের আলোর ছটায় তখন দিল্লি থেকে রাজ্য—সর্বত্র আলোকিত হয়ে থাকে। কিন্তু কেন্দ্রের শাসকের বিরোধী কোনও দল যদি রাজ্যের ক্ষমতায় থাকে, তখনই রাজ্যপালের পক্ষপাতের চরিত্র জ্বলজ্বল করে ওঠে। এটাই দস্তুর। আর এই চিরন্তন সত্য কমবেশি প্রত্যেকেই জেনে গিয়েছে এবং মেনেও নিয়েছে। আমাদের বোসবাবুর ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেস তো বটেই, এতদিন দেখেশুনে রাজ্যবাসীও তাঁর রূপগুণের সঙ্গে আত্মস্থ। তাহলে এখন হঠাৎ এত নড়াচড়া কীসের? কারণ বোসবাবুর বিরুদ্ধে ভয়াবহ একটি অভিযোগ উঠেছে—শ্লীলতাহানির। আর অভিযোগকারিণী তাঁরই রাজভবনের এক অস্থায়ী কর্মী। অভিযোগ কি দায়ের হয়েছে? না হয়নি। কারণ, রাজ্যপালের বিরুদ্ধে ওটা করা যায় না। তদন্ত হয়েছে? সেখানেও বাধা রাজ্যপাল। বলা যায়, রাজ্যের তরফে শুধু রুটিন কয়েকটা কুটো নাড়া হয়েছিল। তাতেই দিল্লিকে বলেকয়ে স্বয়ং পুলিস কমিশনারের সাঁকো নাড়তে শুরু করে দিয়েছেন তিনি। তাহলে উপায় কী? সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের কী মনে হতে পারে? সেই মেয়েটি কি বিচার পাবে না?
এই প্রশ্নটাই এখন লাখ টাকার। রাজ্যবাসীর কাছে আশার আলো হল, সুপ্রিম কোর্ট মামলাটা গ্রহণ করেছে। স্পষ্ট কথা, অভিযোগ এবং সাধারণ মানুষের দাবির সারবত্তা পেয়েছে বলেই এমন পদক্ষেপ। এখানেই শেষ নয়, এই মামলায় কেন্দ্রীয় সরকারকে যুক্ত হওয়ার নির্দেশও দিয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে প্রথম শুনানি। তার আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে এই ইস্যুতে তাদের বক্তব্য জানাতে হবে। খুব স্বাভাবিকভাবেই কোমর বাঁধছে রাজ্য। সংবিধানের ৩৬১ নম্বর ধারা অনুযায়ী, ফৌজদারি মামলায় পূর্ণ ‘ইমিউনিটি’ পেয়ে থাকেন রাজ্যপাল। এই ধারার জোরেই তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর করা যায় না। যতক্ষণ তিনি সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত, রাজ্যপালের বিরুদ্ধে কোনও ফৌজদারি পদক্ষেপ নেওয়া যায় না। তদন্তও নয়। এই ধারার অধীনে রক্ষাকবচ পেয়ে থাকেন রাষ্ট্রপতিও। কী বলা হয়েছে ৩৬১ নম্বর ধারায়? ক্ষমতার ব্যবহার এবং কর্তব্য পালনে রাষ্ট্রপতি বা রাজ্যপালের নেওয়া পদক্ষেপের জন্য কোনও আদালতই তাঁদের জবাবদিহি করতে বলবে না। সেই অধিকার আদালতের নেই। তবে দেখতে হবে, সাংবিধানিক প্রধানের সিদ্ধান্তে যেন কোনও নাগরিকের অধিকার ক্ষুণ্ণ না হয়। তাহলে কি রাজ্যপালের কাজকর্মের কোনওরকম কাটাছেঁড়াই করা যাবে না। সেটাও হয়। ৬১ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, লোকসভা বা রাজ্যসভার ঠিক করে দেওয়া ব্যক্তি, আদালত বা সংস্থা রাজ্যপালের নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘রিভিউ’ করতে পারবে। মুশকিল হল, গোটা ব্যাপারটাই পর্যালোচনা স্তরে থেমে যাবে। যতদিন তিনি কুর্সিতে থাকবেন, তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি তো দূরঅস্ত, তদন্ত পর্যন্ত করা যাবে না। এখানে এটা মোক্ষম প্রশ্ন হল, যদি রাজ্যপালের ওই ‘কর্মকাণ্ড’ তাঁর দায়িত্ব পালন বা কর্তব্যের সঙ্গে জড়িত না হয়? রাজ্যপাল পদে বসলেই তো আর কেউ ভগবান হয়ে যান না! তাঁরও ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়া থাকে। আর সেই ‘ইনস্টিংক্ট’ যদি দেশের কোনও নাগরিকের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে? তাহলেও কি তিনি রক্ষাকবচ পাবেন? ওই চেয়ারে বসে কেউ চুরি-ডাকাতি করবেন না, তা নিশ্চিত। অত টাকা পাওয়ার পর সেটার আর প্রয়োজন হবে না। কিন্তু শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ, খুনের মতো অপরাধ ঘটলেও কি সংবিধান সামনে রেখে আদালত চুপ থাকবে?
সুপ্রিম কোর্ট মামলাটা গ্রহণ করেছে মানে, এই প্রশ্নগুলো বিচারপতিদের মনেও এসেছে। তাই তাঁরা মামলা এবং সংবিধানকে পাশাপাশি রেখেই উপায় খুঁজতে নেমেছেন। সুপ্রিম কোর্টে এই নির্দেশের মধ্যেই অবশ্য বোসবাবু নিজে একটি তদন্ত রিপোর্ট খাড়া করে ফেলেছেন। কে করেছেন সেই তদন্ত? পুদুচেরির অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ ডি রামাবাথিরন। একেবারে ‘ইন-হাউজ’ তদন্ত। রাজভবন সূত্র বলছে, ওই এক সদস্যের তদন্ত কমিটির কাছে ৬৯টি ‘নিউজ ক্লিপিংস’ তুলে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনও সিসিটিভি ফুটেজের উল্লেখ রিপোর্টে নেই। অর্থাৎ, রাজভবন চত্বর বা বোসবাবুর ঘর পর্যন্ত করিডরের সিসি ক্যামেরার ছবিও তদন্ত কমিটিকে দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ নেই রিপোর্টের শুরুতে। এ গেল মুদ্রার এক পিঠ। এবার দেখা যাক, তদন্তের সময় কার কার বয়ান নেওয়া হয়েছে—দু’জন টেলিফোন অপারেটর, দু’জন এডিসি, একজন অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি, একজন চাপরাশি এবং দু’জন পরিচারিকা। রাজভবনের তথ্য থেকেই স্পষ্ট, অভিযোগকারিণীর বয়ানই নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি কমিটি। তাহলে কি এই তদন্ত রিপোর্টকে সম্পূর্ণ বলে ধরা যায়? অথচ বোসবাবু গোটা অভিযোগ পর্বকেই ‘বানানো’ বলে দেগে দিয়েছেন। একজন যুবতী তাঁর সম্মান বিসর্জন দিয়ে দুনিয়ার সামনে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করবেন, বোসবাবু সেটা মিথ্যা বলবেন। ক্যামেরায় দেখা যাবে, তিনি কাঁদতে কাঁদতে ছুটছেন পুলিসের কাছে, সেটা হয়ে যাবে ‘রংচড়ানো’। আর তাঁর খাড়া করা রিপোর্ট গীতার মতো পবিত্র? তারপরও আমরা আবিষ্কার করব যে, সংবিধান তাঁকে রক্ষাকবচ দিয়েছে? তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত হবে না। ফৌজদারি কোনও পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না! তাহলে আইন সবার জন্য সমান হল কীভাবে?