পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি কর্মে ব্যস্ততা। ব্যবসা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা। ... বিশদ
২০ বছরের টমাস ম্যাথিউ ক্রক নামক শান্ত, অঙ্কে ভালো, চশমা পরা নিরীহদর্শন তরুণ আসলে ঠিক কেন ডোনাল্ড ট্রাম্প নামক এক মহাশক্তিমানকে হত্যা করার প্ল্যান করল, তার সামান্যতম আঁচ প্রাথমিক তদন্তে এখনও এফবিআই পায়নি। রহস্যের কারণ একঝাঁক হিসেব না মেলা।
ভোটার রেজিস্ট্রেশন কার্ড অনুযায়ী ক্রুকের নাম রিপাবলিকান হিসেবে রেজিস্টার্ড। তাহলে তো সে রিপাবলিকান ভোটার? অথচ সেই ক্রুকই ২০২১ সালে জানুয়ারি মাসে ১৫ ডলারের একটা চাঁদা দিয়েছিল প্রোগ্রেসিভ টার্নআউট প্রজেক্টে। যেটা লিবারাল ভোটার টার্নআউট গ্রুপের প্ল্যাটফর্ম। যার নাম অ্যাক্ট ব্লু। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক ও নন রেসিস্ট।
আবার সেই ক্রুকই ট্রাম্পের দলের সমর্থক ছিল? তাহলে হঠাৎ ঠিক কী কারণে সে ট্রাম্প বিরোধী হয়ে উঠল? কোন ক্রুকটা আসল?
২০২২ সালে পেনসিলভেনিয়ার বেথেল পার্ক হাইস্কুল থেকে ক্রুক গ্রাজুয়েট হয়। কেমন ছাত্র? ন্যাশনাল ম্যাথ এবং সায়েন্স ইনিশিয়েটিভ তাকে
৫০০ ডলার পুরস্কারের স্টার অ্যাওয়ার্ড দিয়েছিল।
মাত্র পাঁচ মাস আগে তার বাবা কিনেছিল এআর ফিফটিন সেমিঅটোমেটিক রাইফেল। কেন? কারণ তিনি এবং ক্রুক দুজনেই স্থানীয় একটি শ্যুটিং প্র্যাকটিস ক্লাবের সদস্য।
ডোনাল্ড ট্রাম্প যেখানে ভাষণ দিচ্ছেন তার চারপাশে সিক্রেট সার্ভিসের স্নাইপার ছিল বিভিন্ন বিল্ডিং-এর রুফটপে। ক্রুক সেটা জানবে না এটা হতে পারে না। তাহলে সে এই ঝুঁকি নিল কেন? সে ঠিক কী প্রমাণ করতে চাইছিল? এটাই কি যে, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সিকিউরিটি এজেন্সি সিক্রেট সার্ভিসের থেকেও সে বেশি বুদ্ধিমান এবং অনেক বেশি শার্প? সেটা সে সত্যিই প্রমাণ করেছে। সিক্রেট সার্ভিস ঠেকাতে পারেনি ট্রাম্পের আঘাত পাওয়া। এই ক্রুককেই স্কুলের শ্যুটিং ক্লাস থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। কারণ তার নাকি নিশানা অত্যন্ত খারাপ! আর আজ সেই ক্রুক দেড়শো মিটার দূরের এক রুফটপ থেকে ট্রাম্পের ডান কানের নীচে লক্ষ্যভেদ করল। ট্রাম্প নিজেই বলেছেন, আমি যদি সেই মুহূর্তে একটা ইমিগ্রেশন নিয়ে একটা চার্ট দেখার জন্য মাথা না ঘোরাতাম, বুলেট লাগত সোজা মস্তিষ্কে। অর্থাৎ ক্রুকের নিশানা সঠিক ছিল।
ট্রাম্পকে সে রক্তাক্ত করতে পারল! পাল্টা অবশ্যই সিক্রেট সার্ভিসের গুলি হেডশট হয়েছে। ক্রুক তৎক্ষণাৎ প্রাণ হারিয়েছে মাথায় গুলি খেয়ে। কিন্তু সে একঝাঁক প্রশ্ন আর শঙ্কা রেখে গেল মার্কিন গোয়েন্দা, গুপ্তচর আর সিক্রেট সার্ভিসের কাছে। এবং বিশ্বজোড়া মা বাবাদের কাছেও।
২০ বছরের একটা ছেলে আমেরিকার সিক্রেট সার্ভিস এজেন্সিকে এভাবে ধোঁকা দিতে সক্ষম হল? সে লোন উলফ হয়ে উঠতে চাইল কেন? ক্রুকের মোটিভ তাই এখনও রহস্যে ঢাকা। টানটান এক তদন্তের অপেক্ষায় গোটা বিশ্বের সিকিউরিটি এজেন্সিগুলি।
আমাদের কাছে কেন এই ঘটনা বিপজ্জনক? কারণ আমাদের আশপাশের শান্ত, নিরীহদর্শন কিশোর আর তরুণ মনগুলি সকলের আড়ালে ঠিক কী কী ভাবছে? আমরা তাদের বুঝতে পারছি তো?
এই প্রশ্ন উঠছে কেন? কারণ আমরা জানতে পারছি পেনসিলভেনিয়ার আপাত নিস্তরঙ্গ এক জনপদে বেথেল পার্ক হাইস্কুলে ক্রুক যখন পড়ত কিছু বছর আগে, তখন সে ছিল প্রায় নিঃসঙ্গ। সম্প্রতি মিডিয়া তার সহপাঠীদের ইন্টারভিউ করেছে। তারা একটি মারাত্মক উদ্বেগের কথা বলেছে। সেটি হল, এই ছেলেটিকে স্কুলে সারাক্ষণ ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করা হতো। তাকে নিয়ে হাসাহাসি করত সহপাঠীদের একাংশ। সে যথেষ্ট হ্যান্ডসাম নয়। স্মার্ট নয়। এসব বলা হয়েছিল। আর তাই স্কুলের লাঞ্চ আওয়ারে সে একা বসে থাকত। কেউ তার বন্ধু ছিল না। তার সহপাঠীরা মিডিয়াকে বলেছে, হি ওয়াজ বিং বুলিড অন এভরি ডে, এভরি অকেশন! অর্থাৎ প্রতিদিনই তাকে হেনস্তা করা কিংবা তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করা বাকিদের একটা বিনোদনই ছিল।
আজকাল আমাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে প্রধান উদ্বেগ এবং অভিযোগ হল, তারা সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে বসে থাকে। গোটা দিন কেটে যায় স্ক্রিন টাইমে। অথচ কী আশ্চর্য! ক্রুকের কোনও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি আগ্রহ ছিল না। এমনকী তার ফেসবুক ইনস্টাগ্রাম কোথাও অ্যাকাউন্ট নেই। ইউটিউব ছাড়া।
এই যে স্কুলে ক্রমেই বন্ধুহীন হয়ে যাওয়া। এই যে সারাক্ষণ সহপাঠীদের কাছে ব্যঙ্গের শিকার হওয়া, এভাবেই কি ক্রুকের মধ্যে ধীরে ধীরে কোনও অপরাধ মনস্তত্ত্ব তৈরি হয়ে গেল? এই যে স্কুলে তাকে বলা হয়েছিল, সে বন্দুকের নিশানায় ব্যর্থ, তখনই কি সে স্থির করল জীবনে একটা কিছু করে দেখাতে হবে? আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট এবং আসন্ন নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থীকে হত্যা করার পরিকল্পনা নিতে তো বিশ্বের যে কোনও কুখ্যাত অপরাধী অথবা সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীরও বুক কেঁপে যাবে। সেখানে মাত্র ২০ বছরের তরুণ এরকম আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে গেল কেন?
বালক কিশোর, তরুণ মনগুলোকে আমরা খুব বেশি বুঝতে পারছি না। ক্রমেই টেকনোলজি এবং ইলেকট্রনিক্স গ্যাজেটস এসে তাদের আরও দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে। মাত্র কয়েক দশক আগে পর্যন্ত জেনারেশন গ্যাপ এত প্রকট ছিল না। দেখা যেত আমাদের অভিভাবকদের যে গান, যে সিনেমা ভালো লাগে, আমাদেরও সেই একই গান সিনেমা ভালো লাগছে। অর্থাৎ কালচারাল মাইন্ডসেট খুব ভিন্ন নয়। হুবহু এক না হলেও, নিকটবর্তী ছিল। সামাজিক অবস্থান, শিক্ষার প্রণালী, চাকরি-বাকরির প্রক্রিয়া, সবই পিতামাতারা জানতেন সন্তানদের মতোই।
কিন্তু এখন সফটঅয়্যার, এআই অথবা প্রসেসিং কিংবা নানাবিধ কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে আমাদের সন্তানেরা আদতে ঠিক কী কাজ করে অফিসে গিয়ে, সর্বদা আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। তারা মোবাইলে কী দেখে আনন্দ পায়? আমরা সর্বদা জানি না। তারা কোন কোন অ্যাপ ব্যবহার করে? আমরা জানি না। ফেসবুক, ইনস্টা জানি, তার বাইরেও অনেক সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম আছে, যা আজকের মিলেনিয়ালস ব্যবহার করে। আমরা বুঝি না হয়তো।
ঠিক এমতাবস্থায় আমাদের কর্তব্য নিজেদের সন্তানদের সঙ্গে বসে তাদের ক্লাসের সহপাঠীদের সঙ্গে আচরণ সম্পর্কে কথা বলা। তাদের বলা যে, দল বেঁধে বিশেষ কাউকে যেন টার্গেট করে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ তথা বুলি করা না হয়। আবার একইসঙ্গে নিজেদের সন্তান কিংবা পরিজনদের কিশোর কিশোরী তরুণদের দিকেও নজর দেওয়া দরকার। কারা খুব একাকী জীবন যাপন করছে? কেন সে একাকী? স্কুলে যেতে চাইছে না কেন? অথবা হঠাৎ কেমন একটা আগ্রাসী, উদ্ধত মনোভাব কেন? বাইরে সে কোণঠাসা হচ্ছে, সেই কারণেই কি ঘরে আরও বেশি ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে? কাকে বলে ডিপ্রেশন? তাদের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যোগসূত্র বাড়ানো দরকার। এবং সবথেকে বড় ভূমিকা শিক্ষক শিক্ষিকার। তাদের লক্ষ্য রাখতে হবে ক্লাসের ভালো রেজাল্ট করা, খারাপ রেজাল্ট করা, সুন্দর দেখতে, খারাপ দেখতে, বড়লোক, অতটা বড়লোক নয় ইত্যাদি তাবৎ ছাত্রছাত্রীকে সমান চোখে! কারা বদলে যাচ্ছে! কারা একাকী হয়ে যাচ্ছে?
এই যে কথাগুলো বলা হচ্ছে, এসবই মনোবিদরা বলে থাকেন। আমরা সাধারণ মানুষ। কাউন্সেলিং জানি না। কিন্তু নিজেদের সন্তানদের মন বোঝার চেষ্টা করতেই হবে। সকলে যে টমাস ম্যাথিউ ক্রুকের মতো ভাববে তা অবশ্যই নয়। কিন্তু সেই তরুণ ক্রমেই সকলের অলক্ষ্যে, একাকী জীবন কাটাতে কাটাতে ভয়ঙ্কর অপরাধী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল।
অ্যাডোলোসেন্টদের বুদ্ধি নেই বলে কথায় কথায় তাচ্ছিল্য করার প্রবণতা আছে আমাদের মধ্যে অনেকের। যা একটা সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। কতটা জনপ্রিয় এই ব্যাধি? সবথেকে বড় প্রমাণ হল, একজন প্রধানমন্ত্রী পদে থাকা মহাশক্তিশালী নেতা সম্প্রতি লোকসভার মধ্যে তাঁর বক্তৃতায় বিরোধী দলনেতাকে ব্যঙ্গ করার জন্য, বিদ্রুপ করার জন্য এবং হাস্যাস্পদ করে তোলার জন্য বারংবার একটি শব্দ ব্যবহার করেছেন। ‘বালক-বুদ্ধি’। প্রধানমন্ত্রী নিজেও মনে করেছেন যে, ‘বালক-বুদ্ধি’ শব্দের অর্থ হল, বুদ্ধিহীন নির্বোধ। অনায়াসে কাউকে অপদার্থ হিসেবে আক্রমণ করতে হলে ‘বালক-বুদ্ধি’ বললেই তাহলে উদ্দেশ্য সাধিত হয়? অর্থাৎ বালকেরা বুদ্ধিহীন?
আমরা সদ্য জানতে পারলাম একটি উদ্বেগজনক সংবাদ। আমাদের রাজ্যের পাঁশকুড়া থানার মাইসোরা পঞ্চায়েতের একটি স্কুলের প্রজেক্ট দেওয়া হয়েছিল ছাত্রদের। দ্বাদশ শ্রেণির এক ছাত্র পুরনো লোহালক্কড় এবং যন্ত্রাংশ দিয়ে একটি বন্দুকের মতো ডিভাইস তৈরি করে স্কুলে নিয়ে এসেছিল। ভৌত বিজ্ঞান শিক্ষক দেখে চমকে যান। পুলিসকে সেই ছাত্র জানিয়েছে, ইউটিউব দেখে সে এটা শিখেছে। দেশের আর্মির হাতে নিজের তৈরি বন্দুক তুলে দিতে চায় সে। খুব ভালো ভাবনা। কিন্তু এভাবে বন্দুক তৈরির চেষ্টা যে অপরাধের তালিকায় পড়ে সেটা হয়তো সে জানেই না।
বিস্ময়কর এই তথ্য। কেন? কারণ ট্রাম্পকে গুলি করার সময়, টমাস ক্রুকের পরনে যে টি শার্ট ছিল, সেটা একটি ইউটিউব চ্যানেলের ব্র্যান্ডনেমের টি শার্ট। ডেমলিশন র্যাঞ্চ। সেই চ্যানেলে দেখা যায়, টার্গেটকে কীভাবে গুলি করতে হয়। ম্যানিকুইন অথবা পরিত্যক্ত গাড়িতে হ্যান্ডগান কিংবা রাইফেল দিয়ে গুলি করার প্র্যাকটিস দৃশ্য থাকে ওই চ্যানেলে। পেনসিলভেনিয়ার ক্রুক ওই ইউটিউবের দর্শক। আবার বাংলার এক গ্রামীণ এলাকার ছাত্রও অন্য এক ইউটিউব দেখে শিখেছে কীভাবে বন্দুকের মতো ডিভাইস তৈরি করতে হয়।
অ্যাডোলোসেন্ট মন কখন, কীভাবে এবং কোথায় প্রভাবিত হবে, সেটা প্রবল রহস্যময়। তারা বুদ্ধিমান। কিন্তু বড়দের দায়িত্ব সেই বুদ্ধিকে সঠিক পথে চালিত করতে সাহায্য করা! সেজন্য দরকার তাদের লক্ষ্য করা। উদাসীন না থাকা! আমাদের রাজ্যে ভয়ঙ্কর সব কিশোর অপরাধ কিন্তু বহুবার ঘটেছে!