পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি কর্মে ব্যস্ততা। ব্যবসা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা। ... বিশদ
প্রথম সমীকরণ, ভোট প্রাপ্তির হার
গত দু’বছর ধরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলে এসেছেন, সব বিরোধী যদি হাতে হাত মিলিয়ে লড়ে, তার প্রভাব ফলে পড়বেই। কোনওমতেই বিজেপি তথা এনডিএর প্রাপ্ত মোট ভোট বিরোধী জোটের থেকে বেশি হবে না। লোকসভার ফলে দেখা গিয়েছে, মহাজোট ‘ইন্ডিয়া’ সর্বত্র ঐক্যবদ্ধভাবে না লড়েও ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছে। আর এনডিএ ৪২ শতাংশের সামান্য বেশি। তখন অবশ্য বিরোধীদের হাত কামড়ানো ছাড়া কিছু করার ছিল না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফর্মুলা অন্ধের মতো মানলে এই অঙ্কটাই হয়তো উল্টো হয়ে যেত। উপ নির্বাচনের ফলই তার প্রমাণ। কারণ, ১৩ আসনে এনডিএ পেয়েছে ৪৬ শতাংশ ভোট, আর ইন্ডিয়া ৫১ শতাংশ। গুরুত্বপূর্ণ হল, দখলে থাকা বেশ কয়েকটি কেন্দ্রই এই দফায় হারিয়েছে বিজেপি। সাতটি রাজ্যের মধ্যে শুধু মধ্যপ্রদেশ এবারও মান বাঁচিয়েছে। আর সেইসঙ্গে পরিষ্কার করেছে একটি অঙ্ক—মধ্যপ্রদেশ বিজেপির জন্য আরও একটি গুজরাত হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ, সেফ স্টেট। সেফ সিট। কিন্তু দু’টি রাজ্যের ভরসায় গোটা দেশের উপর কি কর্তৃত্ব ফলানো যায়?
দ্বিতীয় সমীকরণ, বাংলা সত্যিই দূরঅস্ত
ইস্যু না থাক, প্রচার কম ছিল না। সন্দেশখালি, নিয়োগ দুর্নীতি, সিএএ—ঢাক পিটেছে প্রচুর। কিন্তু ভোটের কাজে আসেনি। তার প্রমাণ, উপ নির্বাচনে বিজেপির তিনটি আসন ছিনিয়ে নিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। তার মধ্যে রয়েছে রায়গঞ্জও। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর এই প্রথম দিনাজপুরের কেন্দ্রটি দখলে এসেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কারণ তিনি বাংলার মানুষকে বোঝাতে পেরেছেন, পরিষেবার কোনও বিকল্প হয় না। রাজনীতি যতদিন থাকবে, ততদিন কাদা ছোড়াছুড়িও থাকবে। কিন্তু ভোটারকে বিচার করতে হবে, কোন পার্টি বা কোন সরকার তাদের দৈনন্দিন পরিষেবা নিশ্চিত করছে। ভোট হবে তারই উপর। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা বলে কি তাহলে কিছুই নেই? সেটাও আছে। তবে বাংলায় তা এখনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তা ছাপিয়ে যেতে পারেনি। এই রাজ্যে একমাত্র সামাজিক প্রকল্পের সৌজন্যে মানুষের হাতে টাকার জোগানের অভাব নেই। প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ না খেতে পেয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয় না। এই বাংলাতেই মুখ্যমন্ত্রী জনসমক্ষে তাঁর দলের নেতা-মন্ত্রীদের ধমক দিতে পারেন। বলতে পারেন, মানুষকে পরিষেবা দিতে টালবাহানা করলে বা টাকা খেলে ছুড়ে ফেলে দেব। উপ নির্বাচনেও ৪-০ ফল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেখাতে পেরেছেন কারণ মানুষ বুঝেছে, ধর্মের নামে রাজনীতি ও বিভাজনে পেট চলবে না। তাতে সমাজের গায়ে কয়েকটা কালো দাগই পড়বে। আর এমন দাগ দামি ডিটারজেন্ট দিয়ে ঘষেও ওঠানো সম্ভব নয়। তাই ২০১৮ সালের পর প্রত্যেক ভোটে গেরুয়া ব্রিগেডের প্রাপ্ত ভোটের হার কমছে। তৃণমূলের ভোট কিন্তু কমেনি! বরং বেড়েছে। তাহলে কাদের ভোটব্যাঙ্কে বিজেপির রমরমা? এবারের উপ নির্বাচন আরও একবার সমীকরণটা স্পষ্ট করে দিল। বামের ভোট রামের সমীকরণ।
তৃতীয় সমীকরণ, ধর্মের নামে আর ভোট নয়
অযোধ্যা হারিয়েছিল। বারাণসী স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর জয়ের ব্যবধান দেড় লক্ষে নামিয়ে এনেছে। আর উপ নির্বাচনে বদ্রীনাথও দেখিয়ে দিল, হিন্দুত্বে বিজেপির কপিরাইট নেই। সবটা ধাপ্পা। অথচ লোকসভা নির্বাচনের তৃতীয় দফার পর থেকেই হিন্দুত্ব রাজনীতিতে পুরোপুরি ঢুকে পড়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে আপনাদের মঙ্গলসূত্র কেড়ে নেবে, আপনাদের জমি কেড়ে মুসলিমদের দিয়ে দেবে... এই ধরনের মন্তব্য আকছার শোনা গিয়েছে তাঁর গলায়। তারপরও অবশ্য নির্বাচন কমিশন নরেন্দ্র মোদির প্রচার ব্যান করেনি। তিনি বহাল তবিয়তে বিভাজনের সাঁকো নেড়ে গিয়েছেন। বিরোধীরা এখন কটাক্ষ করছে, তারই ফল মিলছে। মানুষ বুঝে গিয়েছে, ধর্ম ধরে ঝুলে থাকলে মোদিজির ভোট বাড়তে পারে। কিন্তু চাকরি মিলবে না। মূল্যবৃদ্ধিও নিয়ন্ত্রণে আসবে না। তাহলে উপায় কী? সংস্কার এবং ২৫ বার্ষিকী পরিকল্পনার বাণীবর্ষণ ভুলে জনসেবায় নামতে হবে। অর্থাৎ, জনমুখী প্রকল্প। জনমুখী বাজেট। ১৪০ কোটি জনসংখ্যাকে সংস্কার বোঝানো, কিংবা সচেতন করা সম্ভব নয়। আপনি আজ না খেয়ে থাকুন, ২৫ বছর পর আপনার সন্তান অনেক খেতে পারবে—এই যুক্তি দারিদ্র্যসীমার নীচে থাকা মানুষ মানবে কেন? আর এই আদর্শবাদী প্রতিশ্রুতিতে তো এখন আর উচ্চ মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত শ্রেণিই বিশ্বাসী নয়। সৌজন্যে কোভিড ও লকডাউন। ওই দুটো বছর আমাদের শিখিয়েছে, বাঁচতে হবে এখনই। কাল মহামারীতে সব উজাড় হয়ে যেতে পারে। তাই সমাজের মাঝের আর শেষের চাকার হাতে টাকার জোগান যত কমেছে, তারা ততই অসহিষ্ণু হয়েছে। বাড়ির অশান্তি, মূল্যবৃদ্ধি, চাকরি হারানোর জ্বালা তারা মাইক নিয়ে প্রচার করতে পারে না। কিন্তু সেই আগুন উগরে দেওয়ার জন্য একটা মাধ্যম তো চাই! সেটাই হল ইভিএম।
চতুর্থ সমীকরণ, কংগ্রেসের পুনরুত্থান
নরেন্দ্র মোদি প্রায় খরচের খাতায় ফেলে দিয়েছিলেন কংগ্রেসকে। গত ১০ বছরে রাহুল গান্ধী ছিলেন তাঁর কাছে নিত্য খোরাক। সংসদের অন্দরে হোক বা বাইরে, রাহুলকে নিয়ে কথা বলতে গেলে বিশেষ আমোদ হতো মোদিজির। এবারও ভোটের আগে বলেছিলেন, চব্বিশের ভোটের পর কংগ্রেসকে গ্যালারিতে বসতে হবে। জনমত অন্য কথা বলল। কংগ্রেস কিন্তু রীতিমতো বেগ দিয়েছে গেরুয়া শিবিরকে। এবং এখনও দিচ্ছে। চলতি উপ নির্বাচনের ফলেও চারটি আসন জিতেছে তারা। উত্তরাখণ্ড ও হিমাচল—প্রত্যেক রাজ্যে দু’টি করে। অর্থাৎ হিসেবটা পরিষ্কার, হিন্দি বলয়ে বিজেপির আধিপত্যে সরাসরি ভাগ বসিয়ে দিয়েছে কংগ্রেস। এর কৃতিত্ব কি রাহুল গান্ধীর? তা কিন্তু পুরোটা নয়। এর বেশিটাই বিরোধী জোটের। এক ছাতার তলাই দাঁড়িয়ে লড়াইয়ের। আর কিছুটা প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর। মানুষ এই একজনকে এবার বিশ্বাস করেছে। মনে করেছে,
এঁকে ভরসা করা যায়। তাই রাহুল গান্ধী তথা কংগ্রেস যত বেশি এই শর্ত দুটো মনে রাখেন, ততই মঙ্গল। এনডিএ সরকার কতদিন টিকবে? আস্থাভোট হবে কি না, এসব প্রশ্ন এখন অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু একটা বিষয় নিশ্চিত—ভারতের জাতীয় রাজনীতির পুরো সমীকরণটাই এখন দাঁড়িয়ে আছে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র কুশীলবদের উপর। রাহুল গান্ধীর উপর। বিশ্বকাপ জয়ের পর দেশে ফিরে বিরাট কোহলি কিন্তু নরেন্দ্র মোদির সামনেই বলেছিলেন, ‘অহঙ্কার প্রত্যেককে সাফল্য থেকে দূরে ঠেলে দেয়।’ তাঁর এই মন্তব্যটা শুধু ক্রিকেট নয়, রাজনীতি থেকে অর্থনীতি—সর্বত্র প্রযোজ্য। ২৪০ আসনে থমকে যাওয়ার পর আশা করা যায় নরেন্দ্র মোদি এই সারসত্যটা বুঝে গিয়েছেন। আর না বুঝলে? মনে করিয়ে দেওয়ার লোক কাছেপিঠেই অপেক্ষা করছে। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডাকে পাশে দাঁড় করিয়ে যোগী আদিত্যনাথও কিন্তু বলেছেন, ‘অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস আর অহঙ্কারই আমাদের ডুবিয়েছে।’ তাই মোদিজি, মুষল হইতে সাবধান।