পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি কর্মে ব্যস্ততা। ব্যবসা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা। ... বিশদ
নতুন আইনগুলি নিয়ে নানা মহলের তীব্র বিরোধিতা রয়েছে। ‘অপ্রাসঙ্গিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ আখ্যাসহ আপত্তি ও বিরোধিতাকে উড়িয়েই দিয়েছে সরকার। সরকারের গাজোয়ারি কারবারেও এই আইনগুলির বিরোধিতা থামেনি। এর জবাবে দুটি রাজ্য সরকার বরং ঘোষণা করে দিয়েছে যে, তাদের বিধানসভাগুলিতে এই আইনের উপর তারা কিছু সংশোধনী আনবে। এই পরিবর্তনের পক্ষে পরামর্শ গ্রহণের জন্য তামিলনাড়ু রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই এক সদস্যের একটি কমিটি নিয়োগ করেছে। ওই কমিটি একমাসের মধ্যে রাজ্যকে তাদের পরামর্শ দেবে। কর্ণাটক এবং অন্যান্য রাজ্য সরকারও এই পথে হাঁটতে পারে। তাই ইস্যুগুলি কী এবং কেন, সেই সংক্রান্ত তথ্যাদি জনগণের সামনে তুলে ধরা দরকার। এরপর নাগরিকদেরই বলতে হবে তাঁরাই যেন নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছন।
‘ফৌজদারি আইন’ সংবিধানের যৌথ তালিকার একটি বিষয়। সংসদ এবং রাজ্য বিধানসভা উভয়ই এই বিষয়ে আইন প্রণয়নের অধিকারী। সংসদে প্রণীত আইন এবং বিধানসভায় তৈরি আইনের মধ্যে সংঘাত উপস্থিত হলে তা সংবিধানের ২৫৪ অনুচ্ছেদের বিচার্য বিষয় হয়ে উঠবে। যাইহোক, বিধানসভা এই বিষয়ে আইন তৈরির পর এমন একটি সমস্যা তৈরি হবে যেটি অত্যন্ত অস্বস্তিকর। অতীতে এমন ক্ষেত্রে রাজ্য বিধানসভায় তৈরি আইন কার্যকরে রাষ্ট্রপতি তাঁর সম্মতি দেননি।
এই অবসরে নতুন আইনের বিরুদ্ধে ওঠা প্রশ্নগুলি অবশ্যই শুনতে হবে এবং তার উত্তরও দিতে হবে সরকার পক্ষকে। দুর্ভাগ্য এই যে, কেন্দ্রীয় সরকার সংসদে, এমনকী তার বাইরেও এসবের জবাব দিতে অস্বীকার করেছে। এখানেই প্রশ্ন:
১. তিনটি নতুন আইনের বেশিরভাগ অংশই প্রতিস্থাপিত আইনগুলি থেকে ‘কপি এবং পেস্ট’ করা হয়েছে—এই অভিযোগ কি ঠিক? এটা কি ঠিক যে ভারতীয় দণ্ডবিধি (আইপিসি) ও ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) ৯০-৯৫ শতাংশ এবং সাক্ষ্য আইনের ৯৫-৯৯ শতাংশ নতুন আইনে বহাল রাখা হয়েছে? আরও শোনা যাচ্ছে যে, প্রতিটি পুরনো ধারাকে নতুন আইনে শুধু কিছু নতুন নম্বর দিয়ে চেনানো হয়েছে! চালু আইনে যদি কিছু যোগ-বিয়োগ ও পরিবর্তনই জরুরি ছিল, কেবলমাত্র সংশোধনের মাধ্যমেই কি সেই একই ফলাফল পাওয়া যেত না? সরকার ‘ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার’ ছুড়ে ফেলে দিয়েছে বলে যে দাবি করছে, এরপর সেটা নিছকই ফাঁপা আওয়াজ হয়ে যাচ্ছে না কি?
২. ফৌজদারি আইনের পুঙ্খানুপুঙ্খ সংশোধন এবং পুনর্বিবেচনাই যদি উদ্দেশ্য ছিল, তবে বহু বছরের রীতি মেনে কেন আইন কমিশনের কাছে বিষয়টি নিয়ে লিখিতভাবে জানাবার পদ্ধতি অনুসরণ করা হল না? সরকার ও সংসদের বিবেচনার জন্য—সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের (স্টেকহোল্ডারদের) সঙ্গে পরামর্শ করার এবং খসড়া বিল তৈরি থেকে সুপারিশ পেশ, সব ব্যাপারেই আইন কমিশন কি সবচেয়ে উপযুক্ত সংস্থা ছিল না? তবে কেন আইন কমিশনকে এড়িয়ে একটি কমিটিকে এমন গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল? মাত্র একজনকে বাদ দিয়ে ওই কমিটির বাকি সদস্যরা তো পার্ট টাইম হিসেবে নিযুক্ত, কেননা তাঁরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণসময়ের অধ্যাপক?
৩. নতুন আইনগুলি কি ফৌজদারি আইনশাস্ত্রের আধুনিক নীতিগুলির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? গত ১০ বছরে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া অনেকগুলি যুগান্তকারী রায়ে প্রগতিশীলতার কিছু নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মান্যতা প্রদানসহ সেগুলিকে কি নতুন তিনটি আইনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে? নতুন আইনের বেশ কয়েকটি বিধান কি সুপ্রিম কোর্টের ব্যাখ্যা অনুসারে ভারতের সংবিধানের পরিপন্থী?
৪. অনেক গণতান্ত্রিক দেশ যে ‘মৃত্যুদণ্ড’কে বাতিল করেছে, নতুন আইনে তা বহাল রাখা হল কোন যুক্তিতে? ‘নির্জন কারাবাস’-এর নিষ্ঠুর ও অমানবিক শাস্তিও কেন চালু রয়েছে এখনও? ‘ব্যভিচার’ নামক অপরাধকে কেন ফৌজদারি আইনে ফেরানো হল? ‘মানহানি’কে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বহাল রাখা কি জরুরি ছিল? ‘মানহানির’ ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করার ক্ষেত্রে সময়সীমা বেঁধে দেওয়ারও দরকার ছিল না কি? কেন অন্য ব্যক্তির সম্মতি ছাড়া সমকামী সম্পর্ক আর অপরাধ নয়? কমিউনিটি সার্ভিসের শাস্তির ব্যাখ্যা দেওয়া, বা অন্তত, তার উদাহরণ দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না কি?
৫. কেন ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ অপরাধকে বড় করে রাখা হয়েছে? বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইন বা ইউএপিএ নামক একটি বিশেষ আইন থাকা সত্ত্বেও কেন ‘সন্ত্রাসবাদ’-এর মতো অপরাধকেও সাধারণ ফৌজদারি আইনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে? জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, ১৯৫০ এবং জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, ১৯৫১ নামে বিশেষ আইন থাকা সত্ত্বেও নতুন আইনে ‘নির্বাচনী অপরাধ’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে কেন?
৬. কোনও ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার এবং তাকে পুলিসি হেফাজতে চাওয়ার ব্যাপারে নতুন আইনগুলি কি পুলিসকে আরও বেশি সুযোগ করে দিয়েছে? গ্রেপ্তারের ক্ষমতা মানেই গ্রেপ্তারের প্রয়োজনীয়তা নয়—সুপ্রিম কোর্টের এই ঘোষণা কি নতুন আইনগুলিতে উপেক্ষিত হয়েছে? ‘জামিনই নিয়ম, জেলই ব্যতিক্রম’ এই আইনে সুস্পষ্টভাবে এটার উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল না কি? গ্রেপ্তারের ‘বৈধতা’ এবং গ্রেপ্তারের ‘প্রয়োজনীয়তা’ যাচাই করা একজন ম্যাজিস্ট্রেটের জন্য বাধ্যতামূলক করা দরকার ছিল না কি? জামিন মঞ্জুর ব্যবস্থায় গ্রেপ্তার-পরবর্তী ৪০/৬০ দিনের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটকে কি জামিন নাকচ করতেই হবে?
৭. অপরাধ সংঘটনের স্থান নির্বিশেষে দেশের যেকোনও থানায় এফআইআর করতে পারার ব্যবস্থাটি কি সংবিধানসম্মত? ‘পুলিস’ রাজ্য তালিকার একটি বিষয়। তাই এমন ক্ষেত্রে অভিযুক্তকে অন্য রাজ্যে গ্রেপ্তার এবং তার নামে অভিযোগের তদন্ত সেখানেই করার যে ক্ষমতা ওই পুলিসকে দেওয়া হয়েছে সেটি কি অসাংবিধানিক? উল্লিখিত বিধান বা ব্যবস্থাগুলি সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য যে ‘ফেডারেলিজম’, তার নীতির পরিপন্থী কি?
এরকম আরও অনেক প্রশ্ন আছে। সেসব প্রশ্ন করার এবং উত্তর পাওয়ার প্ল্যাটফর্ম তবে কোনটি? এখনও পর্যন্ত সরকারের কেউই এসব প্রশ্নের উত্তর দেননি। কিন্তু তাতে সেগুলি বন্ধ হবে না। তবুও দেশে ফৌজদারি বিচার প্রশাসনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইনগুলি ‘কার্যকর হয়ে গিয়েছে’—অল্পকিছু লোকের দ্বারা এবং অল্পকিছু লোকের জন্য পরিচালিত সরকারের একটি উদাহরণ এটি।