পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি কর্মে ব্যস্ততা। ব্যবসা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা। ... বিশদ
গোমাংস কাণ্ডে একটা বিষয়ে শান্তনু ঠাকুরকে সাবাশি দিতেই হবে। তিনি গোরুর মাংস নিয়ে যাওয়ার ছাড়পত্র দেওয়ার কথা অস্বীকার করেননি। তিনি একবারও বলেননি, ওই চিঠি তাঁর নয়, অথবা বদনাম করার জন্য কেউ তাঁর লেটারহেড ব্যবহার করেছে। তবে, যে চিঠি বিএসএফ অফিসারের কাছে থাকার কথা তা বাইরে এল কী করে, সেই প্রশ্ন তিনি তুলেছেন।
কেন্দ্রীয় জাহাজ ও বন্দর রাষ্ট্রমন্ত্রীর এই প্রশ্ন তোলার মধ্যে কোনও অন্যায় নেই। বরং সেটাই তো স্বাভাবিক। তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। গোমাংস সীমান্ত পার করার সুপারিশ করেছেন কেন্দ্রীয় এজেন্সির কর্তার কাছে, যা একেবারেই ঘরের ভিতরের ব্যাপার। কিন্তু সেই চিঠি পৌঁছে গিয়েছে ‘বর্তমান’-এর হাতে। ঘরের ‘কেচ্ছা’ বাইরে বেরলে গোঁসা তো একটু হবেই।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগটা ঠিক কী? তিনি অশোকস্তম্ভ দেওয়া মন্ত্রীর লেটারহেডে বিএসএফ কর্তাকে একটি চিঠি দিয়েছেন। তাতে লেখা হয়েছে, স্বরূপনগরের হাকিমপুরের বাসিন্দা জিয়ারুল গাজি তিন কেজি গোরুর মাংস নিয়ে যাবেন। বিএসএফ যেন গোমাংস নিয়ে যেতে তাঁকে বাধা না দেয়। একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর এই ধরনের চিঠি পাওয়ার পর তাঁকে আটকানোর সাহস বিএসএফের কোনও জওয়ানের বা অফিসারের থাকবে কি? চিঠির জোরেই ‘ইধারকা মাল উধার’ হয়ে যায়। শান্তনুবাবু নিজমুখে স্বীকার করেছেন, এই ধরনের চিঠি তিনি দিয়েই থাকেন।
তবে, যে জিয়ারুল গাজিকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এই চিঠি দিয়েছেন, তিনি কিন্তু মারাত্মক অভিযোগ তুলেছেন। তাঁর দাবি, বিএসএফের নাকাচেকিং থেকে বাঁচার জন্য তাঁরা এই ধরনের ‘পারমিট’ মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠদের কাছ থেকে নেন। আর তারজন্য দিতে হয় ‘প্রণামী’। অভিযোগ সত্যি হলে মানতেই হবে, এটা ‘পরিকল্পিত পাচারে’র অঙ্গ। বাড়ির প্রয়োজনে মালপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য নিয়মিত কেউ টাকা দিয়ে ‘পারমিট’ কিনতে যাবে না। জিয়ারুল গাজির কথায় আরও একটি প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, সীমান্তে পাচারের কৌশল কি বদলে গিয়েছে!
শান্তনুবাবুর ‘পারমিট’ চিঠি নিয়ে হইচই হতেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক নাকি নড়েচড়ে বসেছে। শুরু করেছে তদন্ত। বিএসএফের কাছ থেকে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে। এই চিঠি যে শান্তনুবাবু দিয়েছেন, সেটা তিনি নিজেই ‘অন ক্যামেরা’ স্বীকার করেছেন। ফলে তদন্ত চিঠির সত্যতা যাচাই নিয়ে নয়। সেক্ষেত্রে তদন্তে বাকি থাকে একটাই বিষয়, শান্তনু ঠাকুরের মুখে কালি লেপার সাহসটা দেখাল কে? উদ্দেশ্য, ঘরশত্রু বিভীষণকে খুঁজে বের করা।
ইধারকা মাল উধার করার ‘পারমিট’ দেওয়া, নাগরিকত্বের কথা বলে মতুয়া কার্ড দেওয়ার মতো কাজগুলি শান্তনু ঠাকুরের কাছে জলভাত। নাগরিকত্ব আইন চালু হওয়ার আগে তিনি দাবি করেছিলেন, মতুয়া কার্ড করলেই নাগরিকত্ব পাওয়া যাবে। তাঁর সেই ঘোষণায় অনেকে মতুয়া কার্ড নেওয়ার জন্য ঠাকুরবাড়িতে লাইন দিয়েছিলেন। তখন টাকার বিনিময়ে মতুয়া কার্ড বিক্রির অভিযোগও উঠেছিল। তবে কার্ড নিতে অনাগ্রহী মতুয়াদের কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রমন্ত্রী এই বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, ‘তৃণমূল কংগ্রেসের লোকজনকে নাগরিকত্ব দেব না। তারপর ওদের খ্যামটা নাচ দেখাব।’ ভাবা যায়?
শান্তনু ঠাকুরের কথাবার্তায় ও কাজে বহু বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু দল তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকী, সতর্ক করার সাহস দেখায়নি। অবশ্য এবার তাঁকে ঘিরে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তার সঙ্গে বিজেপির মতাদর্শগত সংঘাত চরম। বিজেপির তাবড় তাবড় নেতা গো-সেবাকে পুণ্য অর্জনের পথ বলেই মনে করেন। অথচ সেই দলের মন্ত্রীই দিচ্ছেন গোরুর মাংস পাচারের পারমিট!
কে গোরুর মাংস খাবেন, কে খাবেন না, সেটা একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। সে ব্যাপারে কাউকে বাধ্য করা বা তা থেকে বিরত করলে সেটা হবে তাঁর মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ। তা সত্ত্বেও এই ভারতবর্ষের বুকে কখনও ফ্রিজে গো-মাংস রাখার কারণে, কখনওবা গোরুর মাংস নিয়ে যাওয়ার ‘অপরাধে’ নৃশংসভাবে পিটিয়ে মারা হয়েছে। এই জাতীয় প্রতিটি ঘটনার পিছনে থাকে বিজেপির মদত অথবা উগ্র হিন্দুবাদীদের উস্কানি।
এহেন বিজেপি দলের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গোরুর মাংস নির্বিঘ্নে সীমান্ত পার করিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করেছেন। তা সত্ত্বেও শান্তনুবাবুর বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ করেনি বিজেপি নেতৃত্ব। তবে, ক্ষোভে ফুঁসছে আরএসএস। তাদের বক্তব্য, গোরু আমাদের ‘দ্বিতীয় মা’। মাতৃদুগ্ধ ছাড়া একজন শিশু বড় হয় গোরুর দুধ খেয়ে। সন্তান প্রসবের সময় মা মারা গেলে শিশুর জীবন বাঁচায় গোরুর দুধ। তাই গোরু আমাদের কাছে ‘গোমাতা’। আমরা হিন্দুরা গোরুকে দেবতাজ্ঞানে পুজো করি। সেই গোরুর মাংস সীমান্তে নাকাচেকিংয়ে না আটকানোর সুপারিশ করেছেন বিজেপির মন্ত্রী। শান্তনুবাবু যদি চাল, ডাল, এমনকী কাশির সিরাপ ছেড়ে দেওয়ার সুপারিশ করতেন তাহলেও আমাদের বলার একটা জায়গা থাকত। আমরা বলতে পারতাম, কাঁটাতারের ওপারে বসবাসকারী পরিবারের জরুরি প্রয়োজনে তিনি এই সুপারিশ করেছেন। কিন্তু গোমাংসের ‘পারমিট’ দেওয়ার পক্ষে আমরা কী সাফাই দেব?
বিজেপি এবার আড়াইশো টপকাতে না পারায় নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহরা বেশ চাপে রয়েছেন। একদিকে শরিকি চাপ, অন্যদিকে সরকারের উপর আরএসএস-এর প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা। গেরুয়া শিবিরের খবর, গোরুর মাংসের পারমিট ইস্যুতেও আরএসএস চেপে ধরতে চাইছে। কিন্তু তাতেও খুব একটা সুবিধে হবে না। কারণ অভিজ্ঞতা বলছে, দিল্লি বিজেপি বারেবারে শান্তনু ঠাকুরের চাপের কাছেই নতি স্বীকার করেছে। সে দাদা সুব্রত ঠাকুরের বিধানসভার টিকিটই হোক বা নাগরিকত্ব ইস্যু।
কেন্দ্রীয় সরকার পাঁচ বছর আগে সিএএ আইন করলেও তা কার্যকর করার জায়গায় ছিল না। কিন্তু শান্তনু ঠাকুর এক কর্মিসভায় ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, লোকসভা ভোটের আগেই সিএএ লাগু হবে। দিল্লির বিজেপি নেতারা মুখে যত আসনই দাবি করুন না কেন, বাংলায় যে দলের অবস্থা ভালো নয়, সেটা তাঁরা জানতেন। তার উপর শান্তনু ঠাকুর বেঁকে বসলে আম ও ছালা দু’-ই যেত। তাই কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই কেন্দ্রীয় সরকার তড়িঘড়ি সিএএ চালু করে দিয়েছে। এর পরিণতি কী হবে, এদেশে আসা সকল মতুয়া নাগরিকত্ব পাবেন কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু নামকা ওয়াস্তে সিএএ লাগু করিয়ে শান্তনু ঠাকুর ভোটটা করিয়ে নিয়েছেন।
এরাজ্যে ১২জন সাংসদের মধ্যে কে কে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় স্থান পাবেন, তা নিয়ে বিজেপিতে জোর চর্চা ছিল। লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য তদ্বিরে খামতি ছিল না। সংসদীয় রাজনীতিতে অভিজ্ঞতার নিরিখে বঙ্গ বিজেপিতে সৌমিত্র খাঁয়ের ধারেকাছে কেউ নেই। একবার বিধায়ক, তিনবারের সাংসদ। মন্ত্রিত্ব না পেলে তিনি বেসুরো হওয়ার ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও চিঁড়ে ভেজেনি। অথচ প্রথম থেকেই মন্ত্রিত্ব নিয়ে নিশ্চিন্তে ছিলেন শান্তনু ঠাকুর। কারণ তিনি হরিচাঁদ ঠাকুরের উত্তরাধিকারী। গেরুয়া শিবিরের বিশ্বাস, তাঁর জন্যই মতুয়া প্রভাবিত আসনে ভালো ফল করে বিজেপি। এই মিথ যতদিন বজায় থাকবে ততদিন তাঁর কেশাগ্র স্পর্শ করার সাহস বিজেপির কারও হবে না। উল্টে নরেন্দ্র মোদির মাগ্গিগন্ডার সংসারে তাঁর তোয়াজ বাড়বে। তাই শান্তনু ঠাকুর বিজেপি সাংসদ হয়েও গোরুর মাংস ‘পাচারে’র পারমিটে সই করেন নির্দ্বিধায়। আর সে-কথা বলেনও বুক ফুলিয়েই।