পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি কর্মে ব্যস্ততা। ব্যবসা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা। ... বিশদ
আমাদের শারীরিক শক্তি আছে। কারও আর্থিক শক্তি আছে। কেউ উচ্চশিক্ষিত। কেউ মাঝারি। কেউ হয়তো প্রথাগত শিক্ষায় বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি। আমাদের সব আছে হয়তো। অর্থাৎ লোকবল। অর্থবল। মানসিক শক্তি। কিন্তু ধরা যাক যা নেই, তা হল, এই সমাজে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। তার নাম সোর্স। অর্থাৎ এই যে আমরা আমাদের পরিশ্রম করে অর্জন করা অর্থ থেকে সারাদিন ধরে, সারা মাস ধরে, সারা বছর ধরে সরকারকে ট্যাক্স দিয়ে চলেছি নানারকম নামের আড়ালে, তা সত্ত্বেও আমাদের ক্রাইসিসের সময় কোনও পরিষেবাই কিন্তু পাব না। কারণ আমাদের সোর্স নেই। হঠাৎ হাসপাতালে কোনও স্বজন ভর্তি হওয়ার পর রক্ত লাগলে, আমরা কি যখন তখন অনায়াসে রক্ত পাব? হাসপাতালের বেড? অথবা অপারেশনের ডেট? সবই সোর্স। কোভিডকালে যারা দিল্লি থেকে মুম্বই। জয়পুর থেকে বেঙ্গালুরুতে, অক্সিজেন না পেয়ে বড়লোকদের হাসপাতালেও অবিরত প্রাণ হারিয়েছেন, তারা কিন্তু নিয়মিত ট্যাক্স দিয়েছিলেন। কোনও রাজ্যে অথবা কেন্দ্রীয় সরকারে, একজনও মন্ত্রী, বিধায়ক, এমপিদের দেখা যায়নি যাঁদের অক্সিজেন না পেয়ে মৃত্যু হয়েছে।
এই জানা কথাগুলো আবার বলা হচ্ছে কেন? কারণ সম্প্রতি জুলাই মাসের শুরুতেই কেন্দ্রীয় সরকার একটি বার্তা দিয়েছে যে, এবার থেকে আর প্রতি মাসে কত টাকা জিএসটি বাবদ সরকার আদায় করেছে এই হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না। এত বছর ধরে কিন্তু সরকার প্রতি মাসের হিসাব নিয়ম করে প্রকাশ করেছে। এমনকী মে মাসের হিসাবও পেয়েছি আমরা। কেন এই সিদ্ধান্ত? মনে করা হচ্ছে, জিএসটি আদায় লাফিয়ে লাফিয়ে যেভাবে বাড়ছে, সেটা কার্যত মানুষের মধ্যেও প্রশ্ন তৈরি করছে যে, আমাদের থেকে সরকার এই বিপুল অর্থ আদায় করছে, আমরা বিনিময়ে কী পাচ্ছি? অথবা সরকার কি তাহলে দেশবাসীকে রীতিমতো আর্থিকভাবে সন্ত্রাসই চালাচ্ছে? কথাটি সত্যি। শেষ হিসেব পর্যন্ত এক মাসে সরকার ১ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকা আদায় করেছে জিএসটি থেকে। যেভাবে জিএসটি আরোপ করা চলছে এবং ট্যাক্স কাঠামোর বদলের দিকে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক অথবা জিএসটি কাউন্সিল, আগামী দিনে দ্রুত ২ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে জিএসটি আদায়।
আয়কর এবং কর্পোরেট ট্যাক্স বাবদ সরকার প্রায় ২০ লক্ষ কোটি টাকা আয় করেছে বিগত আর্থিক বছরে। মনে রাখতে হবে, এর বাইরে রয়েছে জিএসটি আদায়। যা অন্তত ১৫ লক্ষ কোটি টাকা হবেই। যারা কর্পোরেট ট্যাক্স ও ব্যক্তিগত আয়কর দিচ্ছে, তারাও জিএসটি দিচ্ছে। আমরা প্রত্যেকেই যারা করযোগ্য আয় করি, তাদের উপর আয়কর, জিএসটি, সেস, সার্ভিস ট্যাক্স, এক্সাইজ ট্যাক্স সব পৃথক পৃথকভাবে আরোপিত হয়। একই মানুষ সরকারকে অসংখ্য ট্যাক্স দিয়ে চলেছি। অথচ আয় একটাই। যেই অতিরিক্ত আয়ের চেষ্টা কেউ করবে, সেটা যদি সাদা টাকা হয়, সঙ্গে সঙ্গে আবার ট্যাক্স দিতে হবে।
একটি হাসপাতাল নির্মাণ করতে কত টাকা ব্যয় হয়? দেশের রাজ্যে রাজ্যে অনেক বেশি সরকারি মেডিকেল কলেজ কেন নির্মাণ করা হয় না? সরকারি হাসপাতাল রাজ্যে রাজ্যে বাড়ে না কেন? ২ লক্ষ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে মুম্বই থেকে আমেদাবাদে বুলেট ট্রেন তৈরি করতে। আমাদের কী কাজে লাগবে? ধনীদের বিলাস ছাড়া বুলেট ট্রেনের সামান্যতম প্রয়োজনীয়তা ভারতে নেই। বিশেষ করে কোভিডে যেখানে অক্সিজেন, হাসপতাল বেড আর ব্ল্যাকমার্কেটে ওষুধ না পেয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তাদের শেষ নিঃশ্বাসের বাতাস কেটে বুলেট ট্রেন যাচ্ছে, এই দৃশ্যটির মধ্যে সভ্য সমাজের চরম লজ্জা জড়িয়ে থাকবে।
ইন্ডিয়া রেটিংস রিসার্চ মঙ্গলবার যে সমীক্ষা রিপোর্ট পেশ করেছে সেটা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। কেন্দ্রীয় সরকারের দুটি সিদ্ধান্ত এবং একটি কোভিড মিলিয়ে ভারতের সমাজ ও অর্থনীতির একটি বৃহৎ অংশের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। ১০১৬ সালের নোটবাতিল, ২০১৭ সালের নতুন জিএসটি চালু এবং ২০২০ সালের কোভিড, এই তিন ফ্যাক্টর মিলিয়ে সাড়ে ১১ লক্ষ কোটি টাকার লোকসান হয়েছে ভারতের। অসংগঠিত সেক্টরের ১ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়ে গিয়েছে। ৬৩ লক্ষ অসংগঠিত সংস্থা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে ক্ষুদ্র পাড়ার কারখানা, দোকান কিংবা ছোটখাটো উৎপাদন ইউনিট এমনকী শাড়ি ব্লাউজ বিড়ি লেদ মেশিনের উৎপাদন ইউনিটও হতে পারে। ভারতের মোট ওয়ার্কফোর্সের ৪৪ শতাংশই এই অসংগঠিত সেক্টরে কাজ করে। অকৃষিক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের অবস্থা কতটা উদ্বেগজনক? ২০১৬ সালে কর্মীসংখ্যা ছিল ১২ কোটি। কমতে কমতে ২০২২ সালে সেটা হয় ১০ কোটি।
হাজার হাজার মানুষ কাজ হারিয়েছে নোটবাতিলের সময়। কোভিডের সময়। অথচ আমরা বিগত বছরগুলিতে সরকারকে দেখেছি যে, তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে শিক্ষা নিয়ে? ওই পরিস্থিতি আবার এলে যাতে এরকম ভয়ঙ্কর কর্মহীনতা অথবা মৃত্যুমিছিল আর না আসে, এরকম কোনও মরিয়া মনোভাব দেখা গিয়েছে? আমরা কি দেখতে পাচ্ছি যে, আমাদের চারপাশে প্রচুর অক্সিজেন প্লান্ট তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় সরকার? কারণ সেই ঘোষণাই তো করা হয়েছিল ওই সময়! রাজ্যে রাজ্যে নাকি একঝাঁক করে অক্সিজেন প্লান্ট তৈরি হবে? নতুন সংসদ ভবন, রামমন্দির, চন্দ্রযান, জি টুয়েন্টি নিয়ে রাষ্ট্রকে যতটা উত্তাল এক উৎসবের দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন রাষ্ট্রনায়ক, সেই অনুপাতে বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, বিনা চিকিৎসা, সঞ্চয়হীনতা ইত্যাদি মানুষের চরম সঙ্কটমোচনে কী কী উৎসব হয়েছে? জিরো! গত ১০ বছরে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে ৪৬ শতাংশ। অথচ ট্যাক্স ছাড়ের ৮০ সি ধারায় সঞ্চয়ের ঊর্ধ্বসীমা বেড়েছে সেই ১০ বছর আগে। ২০১৪ সালে। তারপর থেকে এক টাকাও বাড়ানো হল না।
রাষ্ট্রের তো উচিত ছিল ওষুধের দাম কমাতে কমাতে একেবারে সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসা! আদতে কি তাই হল? বরং গত এপ্রিল মাসে সাড়ে আটশোর বেশি ওষুধের দাম কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। সরকারের ড্রাগ প্রাইসিং কমিটিই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জেলা সদরে একটি করে জেলা হাসপাতাল। মহকুমা হাসপাতাল। ব্লক হাসপাতাল। প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র। এই তো প্যাটার্ন। বিগত ৩০ বছরে এই ফরম্যাটের কোনও বদল দেখছি আমরা? আজও তো সেইসব হাসপাতালকেই সরকারি হাসপাতাল নামে চিনি, যেগুলো ৩০ বছর আগেও ছিল। স্বাস্থ্য খাতে কেন্দ্রীয় সরকার ৯০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেটে। আমাদের রাজ্য কী কী পেল ওই টাকায়? কী কী বদলেছে?
১ লক্ষ ৬৪ হাজার কোটি টাকা নিয়ে বিএসএনএলের পুনরুজ্জীবন প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছিল ২০২২ সালের ২৭ জুলাই। এই যে ২ বছর কেটে গেল, আমরা আম জনতা জানতে চাইছি যে, ওই ১ লক্ষ ৬৪ হাজার কোটি টাকায় কী কী কাজ হল? উল্টে তো বেসরকারি টেলিকম কোম্পানিদের লুটপাট চালানোর ব্যবস্থা করে নেওয়া হল! যে যেমন পারছে রিচার্জের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের যাদের খুব সীমিত আয়, তাদের সরকারি পরিষেবাই হতে পারত শেষ আশ্রয়। বৃহৎ কর্পোরেট হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ক্ষমতা নেই। বিল দিতে পারব না। স্বাস্থ্যবিমার প্রিমিয়ামও আয়ত্তের বাইরে। তাই সরকারি হাসপাতাল ভরসা। বেসরকারি টেলিকম কোম্পানির উচ্চহারের রিচার্জ অথবা পোস্টপেইড বিল দিতে সক্ষম নই। তাই সরকারি বিএসএনএলের দিকে তাকিয়ে থাকি। অথচ কই, সরকার তো জানাচ্ছে না ১ লক্ষ ৬৪ হাজার কোটি টাকায় কী কী করা হয়েছে? টাকার অঙ্কটা তো আমরা কাগজে কলমে লিখতেই পারব না সংখ্যায়! কিন্তু আমরা সরাসরি প্রশ্ন করছি, ওই টাকা কোথায় গেল? বিএসএনএল পুনরুজ্জীবিত হল না কেন? কত টাকা জিএসটি থেকে আদায় হচ্ছে এবার থেকে সেটা গোপন রাখা হবে কেন? মানুষ লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা ট্যাক্স দিচ্ছে। অথচ সরকার সেই মানুষকে কিছু দিচ্ছে না। রক্ষকই ভক্ষক! সরকারের উত্তর হবে কেন ট্যাক্সের টাকা দিয়ে রাস্তা হয়, সেতু হয়, রেললাইন হয়। তাই নাকি? একের পর এক সেতু ভেঙে পড়ছে। ট্রেন দুর্ঘটনা নিয়মে পরিণত। একটি বর্ষায় রাস্তা সাফ। টাকাগুলো কোথায় যায়?
সবথেকে বিস্ফোরক তথ্য দেখা যাচ্ছে বিগত আর্থিক বছরের কর আদায়ের পরিসংখ্যানে। মোট যত ট্যাক্স সরকার আদায় করেছে, তার মধ্যে বেনজিরভাবে এই প্রথম কর্পোরেট ট্যাক্সের তুলনায় ব্যক্তিগত আয়কর জমা হওয়ার পরিমাণ বেশি হয়েছে! ধনী আয় করবে বেশি, ট্যাক্স দেবে কম। মধ্যবিত্ত আয় করবে কম, ট্যাক্স দেবে বেশি! ২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন,আজ থেকে নতুন কালচক্র শুরু হল। এক হাজার বছর থাকবে এই কালচক্র। অর্থাৎ রামরাজ্য। এটাই প্রকৃত সেই নতুন কালচক্র। রাষ্ট্রকে টাকা জোগাবে আম জনতা। বিনিময়ে রাষ্ট্র দেবে জ্ঞানগর্ভ ভাষণ আর স্লোগান?