পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি কর্মে ব্যস্ততা। ব্যবসা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা। ... বিশদ
রক্তাক্ত ট্রাম্পের মুষ্টিবদ্ধ হাত তোলার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছিলেন ছেলে এরিক ট্রাম্প। ছবির ক্যাপশনে লেখা, ‘এই যোদ্ধাকেই আমেরিকার প্রয়োজন।’ আমেরিকার রাজনীতিতে এমন একটি ঘটনা নিয়ে এরই মধ্যে যে লড়াইয়ের সূচনা হয়েছে, তা আগামীতে আরও কুৎসিত রূপ নেবে বলেই ধারণা করা যায়। আর এটাই এই নির্বাচনের প্রচারের ধরন বদলে দেবে। ট্রাম্প নিজেকে একজন ‘ভিকটিম’ হিসেবেই উপস্থাপন করতে চাইবেন, যাতে তাঁর
প্রতি সহানুভূতি বাড়ে। নিজেকে ‘প্রায়-শহিদ’ হয়ে যাওয়া একজন বলে হাজির করতে চাইবেন। ফলে এই একটা ঘটনায় ডেমোক্র্যাটদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে!
এই হতাশা অবশ্য হঠাৎ করে আসেনি। দিন কয়েক আগে এক সকালবেলা ডেমোক্রেটিক পার্টির এক সোর্সকে মেসেজ পাঠিয়েছিলেন শার্লট। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে চান। উত্তর এল, ‘Death is better than this।’ মেসেজ দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন টাইম ম্যাগাজিনের প্রখ্যাত সাংবাদিক শার্লট অল্টার।
আসলে আমেরিকার বাতাসে কান পাতলেই এখন এই হতাশা আর আশঙ্কার কথা শোনা যাচ্ছে। সর্বত্র আলোচনার বিষয় সেই একই—‘এটা কী ভোট হচ্ছে? আমরা তো আবার একই কাজ করতে চলেছি?’ ভোট দিতে হবে— এই চিন্তায় দেশের মানুষ এখন ভয়ে কাতর। সমীক্ষায় প্রতি ১০ জনে চারজন প্রাপ্তবয়স্ক মার্কিন নাগরিক বলেছেন, এই নির্বাচন হবে ‘ভয়ঙ্কর’। কেউ কেউ আবার বলছেন, এই ভোট ‘ক্লান্তিকর’, ‘হতাশাব্যঞ্জক’, ‘গতানুগতিক’। দলের কর্মীরাও ক্লান্ত। স্বেচ্ছাসেবীরা পা ঘষছেন। পাঠক-শ্রোতা-দর্শকরা আর রাজনৈতিক খবরে আগ্রহ পাচ্ছেন না। জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলে রাজনৈতিক খবরের চাহিদায় ভাটা পড়ে গিয়েছে। আসলে সবারই মোহভঙ্গ ঘটেছে। আর এটাই এই নির্বাচনের থিম।
বিভিন্ন সমীক্ষার তথ্য বলছে, ট্রাম্পের কাছে বাইডেন পরাজিত হবেন। ২০২০ সালেও এমন হয়নি। ওই সময় ভোটারদের অংশগ্রহণের হার ছিল সবচেয়ে বেশি। অল্পের জন্যই রক্ষা পেয়েছিলেন বাইডেন। এবার ট্রাম্প রাউন্ড টু-তে খেলতে নেমেছেন। অনুজ্জ্বল জোট, ভোটের ফ্যাকাশে ফল এবং সমর্থকদের মধ্যে গেঁড়ে বসা ধারণা যে, প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনে বাইডেন অনুপযুক্ত। বাইডেন এই ম্যাচে নেমেছেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। লরি গোল্ডম্যান ট্রাম্পকে হারাতে আট বছর ধরে কাজ করছেন। ‘ফেমস অ্যান্ড ডেমস’ এর প্রতিষ্ঠাতা গোল্ডম্যান মিশিগানে ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে সদস্য সংগ্রহ, প্রার্থীদের জন্য তহবিল সংগ্রহের কাজ করেছেন। সেই গোল্ডম্যান বলছেন, ‘আমরা আমেরিকার রাজনীতি নামে একটা নিষ্ক্রিয় প্রতিষ্ঠানে আটকা পড়েছি। এই পরিস্থিতির উন্নতির কোনও সুযোগ নেই। এখন নিজেকে প্রশ্ন করি, ‘এত কিছু কেন করেছি? সপ্তাহান্তে এই যে এত এত মানুষকে ফোন করে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা, স্কুলের পরে তহবিল সংগ্রহ, বৃষ্টি আর বরফ উপেক্ষা করে প্রচার চালানো, সন্তানদের বঞ্চিত করা—কী লাভ হল?’ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে যাঁরা টাকাপয়সা দিতেন, তাঁরাও এখন আর টাকা খরচ করতে চাইছেন না। হতাশা আর হতাশা!
ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধ বাইডেনের নড়বড়ে জোটকে আরও দুর্বল করেছে। তরুণ ও প্রগতিশীল ভোটারদের মনে বাইডেনকে নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। অথচ, ২০২০ সালে এই ভোটাররাই ট্রাম্পকে পরাজিত করতেই ভোটকেন্দ্রে গিয়েছিলেন। এখন তাঁরা বলছেন, ডেমোক্র্যাটদের ধারা এমন নয়। রিপাবলিকানরা হয়তো এভাবে চলতে পারে। এসবই ২০১৬ সালের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। ওই সময় অনলাইনে হিলারি ক্লিনটনকে নিয়ে যা-ই বলা হতো, সঙ্গে সঙ্গে আক্রমণ শুরু হয়ে যেত। জো বাইডেনের অবস্থাও এখন একই।
অবস্থা এমন যে, ভোট বিতর্কের মঞ্চে জো বাইডেন কী বলেছেন, সেটা বড় ব্যাপার ছিল না, তিনি কীভাবে বলেছেন, সেটাই মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। তাঁর গলার স্বর ছিল খুব দুর্বল। বারবার তিনি কথার খেই হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি কী বিষয়ে কথা বলছেন, তা–ও বারবার ভুলে যাচ্ছিলেন। তাঁকে অতি বার্ধক্যজর্জর দুর্বল মানুষ মনে হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে প্রথম টিভি বিতর্কে অংশ নেওয়ার পর বাইডেন এমনই বিব্রতকর ও বিপর্যয়কর অবস্থার মুখে পড়েছিলেন। বিতর্কের পর মিত্র ও শত্রু উভয় শিবির থেকে উত্তপ্ত সমালোচনার ঝড় বাইডেনের সাদা চুলের মাথার উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে। ট্রাম্প শিবির বলছে, টিভি বিতর্কে বাইডেনের লক্ষ্য ছিল একটাই। ৮১ বছর বয়সে এসেও তিনি যে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনের জন্য শারীরিকভাবে ঠিক আছেন, সেটা প্রমাণ করা। তাতে তিনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ। রিপাবলিকানদের এই ধারণায় অনেক আমেরিকানই একমত। তবে বিতর্কে ট্রাম্পের কাছে বাইডেনের ধরাশায়ী হওয়ার বিষয়টি দোদুল্যমান ভোটারদের কতটা প্রভাবিত করবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। অনেকেই বলছেন, বাইডেনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরিয়ে দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে প্রচণ্ড আত্মগৌরবে ভুগতে থাকা একগুঁয়ে বাইডেনকে বসিয়ে দেওয়ার যেকোনও চাপ তিনি প্রতিহত করবেন। তিনি কিছুতেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়াবেন না। এটা তিনি জানিয়েও দিয়েছেন। ডেমোক্র্যাটদের প্রথম সারির নেতারা যে মুখ ফুটে বাইডেনকে সরে দাঁড়াতে বলবেন, সেটিও কারও পক্ষে সম্ভব নয়। আমেরিকার জন্য এটা নিঃসন্দেহে তীব্র নির্বাচনী সঙ্কটের একটি মুহূর্ত। তবে বাইডেন ও ডেমোক্র্যাটদের পুনর্নির্বাচনের আশাকে কবর দেওয়ার আগে বিশ্বের একটু বিরতি নেওয়া ও গভীর শ্বাস নেওয়া উচিত।
ব্রিটিশ দৈনিক ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর কলামিস্ট সাইমন টিসডাল লিখছেন, বিতর্কের গোলমালের মধ্যে ট্রাম্পের নিজের জঘন্য পারফরম্যান্সও ঢাকা পড়ছিল। তাঁকে যতটা না প্রেসিডেন্টের মতো দেখাচ্ছিল, তার চেয়ে বেশি দেখাচ্ছিল শিকারির মতো। তাঁকে যতটা না প্রার্থী মনে হচ্ছিল, তার চেয়ে বেশি ঘৃণ্য উৎপীড়ক মনে হচ্ছিল। তিনি অবলীলায় একের পর এক মিথ্যা বলে গিয়েছেন। তাঁর কাছে সব নীতিই হল কুসংস্কার। মানুষটি যে কত বিপজ্জনক, তার সময়োপযোগী অনুস্মারক হয়ে রইল এই বিতর্ক। ট্রাম্পের আক্রমণ ও আঘাতগুলি বাস্তব-বিবর্জিত ভিত্তিহীন বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে ছিল। তিনি দাবি করেন, বাইডেন দুর্নীতিগ্রস্ত এবং চীনের কাছ থেকে তিনি নাকি অর্থ নিয়েছেন। কিন্তু এ কথার সমর্থনে তিনি কোনও প্রমাণ হাজির করেননি। ট্রাম্প বলেছেন, অবৈধ অভিবাসীদের ঢেউ ‘আমাদের নাগরিকদের উপর আছড়ে পড়ছে এবং আমাদের হত্যা করছে’। এই কথাও ভিত্তিহীন ও অযৌক্তিক। ট্রাম্পের সবচেয়ে হাস্যকর বক্তব্য ছিল, বাইডেন নাকি রাশিয়াকে ইউক্রেনে হামলা চালাতে ‘উৎসাহিত’ করেছিলেন। অথচ, সবাই জানেন, ট্রাম্পই ভ্লাদিমির পুতিনের প্রশংসা করে থাকেন। সবাই জানেন, ট্রাম্প পুতিনের মতোই স্বৈরশাসক হতে চান। তিনি ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছেন, নির্বাচিত হলে একদিনের জন্য হলেও তিনি ‘ডিক্টেটর’ হবেন। সব রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে তিনি কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন। বাইডেন এই তালিকার বাইরে নন।
২০২০ সালে ট্রাম্প পরাজিত হওয়ার পর উদারপন্থীদের মধ্যে স্বস্তি নেমে এসেছিল। কিন্তু সমীক্ষা বলছে, ট্রাম্পের ফিরে আসা সময়ের অপেক্ষা। ট্রাম্পের ফিরে আসার প্রকৃত বিপদ সম্পর্কে বুঝতে হলে তাঁর হোয়াইট হাউসে থাকাকালীন সবচেয়ে বেশি সময় ধরে তাঁর চিফ অব স্টাফের দায়িত্ব পালন করা জন কেলির সাক্ষ্য তুলে ধরা যেতে পারে। কেলি তাঁর প্রাক্তন বস ট্রাম্প সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমেরিকা কীসের উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেই সম্পর্কে তাঁর কোনও ধারণাই নেই। তিনি স্বৈরাচারী ও খুনি স্বৈরশাসকদের প্রশংসা করেন এবং আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, আমাদের সংবিধান ও আইনের শাসনের প্রতি তাঁর অবজ্ঞা ছাড়া আর কিছুই নেই।’
সেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে প্রথম বিতর্কে ব্যর্থ হওয়ার পর জো বাইডেনকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর দাবি ক্রমে জোরালো হচ্ছে। প্রথমে সেই দাবি তুলেছিলেন ডেমোক্র্যাটিক প্রচারকরা, তারপর ডেমোক্র্যাটিক সমর্থক কলাম লেখকেরা। এখন দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও আওয়াজ তোলা শুরু করেছেন। বাইডেনের সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে একাধিক প্রার্থীর নাম শোনা যাচ্ছে। এর অধিকাংশই কোনও না কোনও অঙ্গরাজ্যের ডেমোক্র্যাটিক গভর্নর। যেমন, ক্যালিফোর্নিয়ার গেভিন ন্যুসাম ও মিশিগানের গ্রেচেন হুইটমার। এমনকী মিশেল ওবামার নামও শোনা যাচ্ছে। তালিকায় ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের নামও। সমীক্ষা অনুযায়ী, এই মুহূর্তে ট্রাম্প বাইডেনের তুলনায় ৬ পয়েন্টে এগিয়ে (৪৯:৪৩)। ব্যাটলগ্রাউন্ড হিসেবে পরিচিত গুরুত্বপূর্ণ সাতটি অঙ্গরাজ্যের পাঁচটিতেই তিনি বাইডেনের তুলনায় ৫ থেকে ১২ পয়েন্ট এগিয়ে। অন্যদিকে ট্রাম্প ও কমলার মুখোমুখি লড়াইয়ে তাঁদের ব্যবধান মাত্র ২ শতাংশ (ট্রাম্প ৪৭, কমলা ৪৫)। নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, নিজের ‘ইগো’কে প্রাধান্য না দিয়ে বাইডেন দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ বিবেচনায় রেখে সরে দাঁড়াবেন— সেটাই কাম্য। ডেমোক্র্যাটরাও আশা করছেন, বালিতে মাথা গুঁজে না রেখে তিনি দেওয়ালের লিখন পড়বেন।
বাইডেনকে এগিয়ে আসতে হলে নভেম্বরের মধ্যে ছোটখাটো কোনও অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে হবে।
তবে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, বাইডেনের বিকল্প ‘ভয়ঙ্কর’। এক মার্কিন নাগরিক যেমন বলেছেন, ভোটারদের এখন একজন বৃদ্ধ ও একজন বাটপার— এই দু’জনের মধ্যেই একজনকে বেছে নিতে হবে। এটাই ভয়ঙ্কর!