পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি কর্মে ব্যস্ততা। ব্যবসা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা। ... বিশদ
সংবিধান হত্যা দিবস বিতর্ক
সংবিধান বদলে ফেলতে চাইছে বিজেপি। মোদির আমলে দেশে বিরোধী পরিসর লুট হয়ে গিয়েছে, বিরোধীদের বিরুদ্ধে চলছে এজেন্সিরাজ, সব মিলিয়ে কায়েম হয়েছে এক অলিখিত জরুরি অবস্থা। লোকসভা নির্বাচনের প্রচার পর্বে এই প্রশ্নেই সরব হয়েছিল কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস এবং অন্য বিরোধী দলগুলি। কেঁদেকঁকিয়ে ক্ষমতায় ফিরে নরেন্দ্র মোদি ওই আক্রমণের জবাব ফেরানোকেই কতখানি অগ্রাধিকার দিয়েছেন তা আমরা দেখেছি।
ভারতের গণতন্ত্রে ২৫ জুন একটি স্পর্শকাতর দিন। ১৯৭৫ সালের ওই দিনটিতে ইন্দিরা গান্ধী দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করেন। এবছর লোকসভার স্পিকার নির্বাচনের দিনটি স্থির হয় ওই বিশেষ দিনটির পরদিন, ২৬ জুন। আমরা আরও দেখেছি, স্পিকার নির্বাচনে সংসদ কোনোভাবেই ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি। ধ্বনি ভোটে ওম বিড়লা পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁকে কুর্সিতে যৌথভাবে স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী এবং সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু। উল্লেখ্য, বিরোধী দলনেতা হিসেবে রাহুলের জীবনে দিনটি ছিল প্রথম। দায়িত্ব নিয়েই বুঝিয়ে দেন যে, সংসদকে শাসকের যথেচ্ছাচারের জায়গা আর হতে দেবেন না তিনি। তাঁর দাবি, বিরোধীদের অনেক বেশি বলার সুযোগ দিতে হবে। সংবিধান রক্ষার প্রশ্নে কংগ্রেস এবং ‘ইন্ডিয়া’ এবার কোনোরকম আপস করবে না। মানুষ, দেশ এবং সংবিধানের প্রতি যেকোনও অন্যায়ের প্রতিবাদকে বিরোধীরা পাখির চোখ করেছে। রাহুল বলেন, ‘‘সরকারের কাছে রাজনৈতিক ক্ষমতা আছে ঠিকই, কিন্তু বিরোধীদের কাছেও আছে জনগণের আওয়াজ, আর এবার তা অনেক বেশি শক্তিশালী।’’ বস্তুত স্পিকারকে মাধ্যম রেখে এনডিএ সরকারের উদ্দেশে রাহুলের কড়া চ্যালেঞ্জ, ‘‘বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করে অগণতান্ত্রিকভাবে হয়তো সভা চলতে পারে, কিন্তু নির্বাচন জানিয়ে দিয়েছে, সংবিধান বাঁচানোর জন্য বিরোধীদের যে বক্তব্য তা শুনতেই হবে।’’
সেইমতো গোটা বিরোধী বেঞ্চও মুখর ছিল সেদিন। ডিএমকে মুখপাত্র টি আর বালু স্পিকারের
উদ্দেশে একটি স্মরণযোগ্য দার্শনিক মন্তব্য করেন, ‘‘বিড়লাজি, আপনি পদ্ম প্রতীকে জিতে এসেছেন, তাই স্পিকার হয়ে পদ্মফুলের চরিত্রটাও মনে রাখবেন—ফুলটি জলে জন্মায় বটে কিন্তু তার পাতায় জল দাঁড়াতে দেয় না।’’
তাল কেটে দিতে সরকার পক্ষের খেলাটি শুরু হয় তার অব্যবহিত পরই। স্পিকার আচমকা জরুরি অবস্থা প্রসঙ্গ পাঠ করতে শুরু করেন। তৎক্ষণাৎ সমস্বরে প্রতিবাদ জানান বিরোধীরা। তাঁরা প্রশ্ন তোলেন, স্পিকার নির্বাচনের মতো একটি শুভদিনে এমন প্রসঙ্গ কেন? কিন্তু ওম বিড়লা তাতে কান না দিয়ে একই গতিতে পড়ে গেলেন, ‘‘কংগ্রেসের তানাশাহি দেশকে সেসময় বরবাদ করে দিয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধী বিরোধী নেতাদের জেলে ভরে দেশটাকেই জেলখানা বানিয়ে ছেড়েছিলেন! … ওটা ছিল অন্যায়কাল।’’
বিরোধী পক্ষে ফাটল ধরাবার এমন মোক্ষম মওকা মোদিবাবু ছাড়েন কী করে! জরুরি অবস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য স্পিকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘জরুরি অবস্থার দিনগুলিতে নির্যাতনের শিকার নাগরিকদের সম্মানে উঠে দাঁড়িয়ে নীরবতা, একটি সুন্দর সহবত। জরুরি অবস্থা ৫০ বছর আগের একটি ঘটনা হলেও বর্তমান প্রজন্মেরও তা জানা দরকার। সংবিধানকে পদদলিত করার, জনমত স্তব্ধ করে দেওয়ার এবং প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধ্বংস করে ফেলার নিকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত তখনই তৈরি হয়।’’
বিশেষ অধিবেশনেই দিশেহারা দেখা গিয়েছে বিজেপি তথা এনডিএ’কে। মুখরক্ষার বস্তুত কিছুই যে সরকারের হাতে নেই তা বোঝা যায়, অর্ধশতকের পুরনো ঘটনার প্রাসঙ্গিকতা ফেরাবার মরিয়া চেষ্টায়। বিষয়টিকে কেবল সংসদ বিতর্কের গণ্ডিতে বেঁধে রেখেই আর স্বস্তি বোধ করছেন না সঙ্ঘানুগামীগণ। ১২ জুলাই কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে ঘোষণা করা হল, এখন থেকে ২৫ জুন পালিত হবে ‘সংবিধান হত্যা দিবস’ হিসেবে। ওই নির্দেশিকা পোস্টসহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এক্স-এ লেখেন, ‘‘১৯৭৫-এর ২৫ জুন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জরুরি অবস্থা জারিসহ গণতন্ত্রের আত্মাকে গলা টিপে হত্যা করেন। অসংখ্য নির্দোষ মানুষকে জেলে ভরা হয়। স্তব্ধ করে দেওয়া হয় সংবাদমাধ্যমকে। তাই সরকার প্রতিবছর ‘সংবিধান হত্যা দিবস’ পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেসময়ে অমানবিক কষ্টের শিকার জনগণের উদ্দেশে উৎসর্গ করা হবে দিনটি।’’ একই পথে হেঁটেছেন প্রধানমন্ত্রীও। এক্স-এ তাঁরও অনুরূপ ‘অমরবাণী’ পড়েছি আমরা।
বিজেপি এবং সরকারের এই চরম ভণ্ডামি নিয়ে কংগ্রেসের তরফে পাল্টা আক্রমণও অবশ্য অব্যাহত রয়েছে। দলের মুখপাত্র জয়রাম রমেশ লিখেছেন, ‘‘খবরের শিরোনামে আসার জন্যই নন-বায়োলজিক্যাল প্রধানমন্ত্রীর এটি আর-একটি ভণ্ডামি। একদশক যাবৎ তিনিই অলিখিত জরুরি অবস্থা চালিয়ে এসেছেন। ৪ জুন ভারতের মানুষ তাঁকে ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক ও অনৈতিক ‘পরাজয়’ উপহার দিয়েছে। দিনটি ইতিহাসে ‘মোদিমুক্তি দিবস’ হিসেবে লেখা থাকবে।’’ প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি বিজেপি ও সঙ্ঘকে আক্রমণ শানিয়ে জয়রাম যথার্থই লেখেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী ভারতের সংবিধান এবং তার নীতি, মূল্যবোধ ও প্রতিষ্ঠানগুলিকে নিয়মিত আক্রমণ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর আদর্শগত পরিবার ১৯৪৯-এ সংবিধান মানতে চায়নি, কারণ তা মনুস্মৃতি থেকে অনুপ্রাণিত নয়।’’ পরে নোটবাতিল প্রসঙ্গে তাঁর কটাক্ষ, ‘‘এখন থেকে প্রতিবছর ৮ নভেম্বর ‘জীবিকা হত্যা দিবস’ হিসেবে পালিত হবে এবং দ্রুত জারি হবে তার নির্দেশিকা।’
১৩ জুলাই তীব্র আক্রমণ শানান কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধীও। এক্স মারফত তাঁর দাবি, ‘‘যাঁরা সংবিধান বিরোধী ও সংবিধানকে মুছে ফেলার কথা বলেন, এই ধরনের নেতিবাচক রাজনীতি তাঁদেরই মানায়। ঐতিহাসিক লড়াইয়ের পর ভারতের জনগণ স্বাধীনতা ও সংবিধান অর্জন করেছে। যাঁরা সংবিধান তৈরি করেছেন এবং তাতে আস্থা রাখেন, তাঁরাই রক্ষা করবেন সংবিধানকে।’’ একইভাবে বিজেপির তীব্র সমালোচনা করেছেন এনসিপি (শারদ) মুখপাত্র ক্লায়েড ক্রাস্তো, ‘‘লোকসভায় এবার ৪০০ আসন পেলে হয়তো ‘সংবিধান বদলি দিবস’ পালন করত বিজেপি! ওদের পরিকল্পনাটি সফল হয়নি বলেই ‘সংবিধান হত্যা দিবস’ পালনের কথা বলেছে।’’
ইমারজেন্সি চাপিয়ে দেওয়ার ভুল, ইন্দিরা নিজেই পরে বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁর ‘বিশ্বস্ত’ আইনি পরামর্শদাতার চাল তিনি ধরতে পারেননি। এজন্য অনুশোচনাও করেছিলেন তিনি। তবু পাঁচদশকের সেই শুকনো পাঁকে জলসিঞ্চন কী মতলবে? বৃহত্তম গণতন্ত্রের প্রতি শাসকের দায়বদ্ধতার একদশকের রেকর্ড তো ভয়াবহ! তার বিরুদ্ধে ভোটযন্ত্রে গণধিক্কার কি জন্মভূমির কথাই মনে পড়াচ্ছে পদ্মকে?
অনন্ত প্রতীক্ষা
ভারতের গণতন্ত্র যতদিন না ‘কোয়ালিটি’ অর্জন করে, অনুমান হয় যে, কাচের ঘরের দিকে ঢিল ছোড়াছুড়ির এই খেলা চলতেই থাকবে। তবে এইভাবে সংবিধান রক্ষা পাওয়ার কোনও সুযোগ ও সম্ভাবনা নেই। দেশ ও দেশবাসীকে রক্ষা করাই হল সংবিধানের মূল বার্তা। দেশ থেকে ক্ষুধা নির্মূলকরণ, সবার জন্য সুশিক্ষা, সুস্বাস্থ্য, স্বাস্থ্যকর গৃহ, উপযুক্ত চাকরি বা কাজ এবং বৈষম্যহীন সমাজই হল ভারতের চাহিদা। সাতাত্তর বছরেও এর সবগুলিই অধরা। ‘যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ’—এই ছবিটা বদলে ফেলার ব্যাপারে কোন কোন রাজনৈতিক দল আন্তরিক? হাত তুলুক তারা প্রকাশ্যে এবং বাজে তরজা ছেড়ে অঙ্গীকার মতো কাজটিও করুক। তবেই দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র এবং সুখ শান্তির সুস্থায়ী আবহ ফিরবে। আমরা অপেক্ষা করে থাকব, সেই দিনটির জন্যই—নশ্বর দেহে যারা পারব না, দেহান্তরেই!