পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি কর্মে ব্যস্ততা। ব্যবসা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা। ... বিশদ
১৮৭৩ সালের ২৯ জুন। রবিবার। ইংরেজ আমল। আজকের মতোই একটা ছুটির দিন। ১৫১ বছর আগে এই দিনে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মৃত্যুশয্যায় হাজির হিন্দু-খ্রিস্টান দু’পক্ষেরই লোকজন। এর মধ্যে একপক্ষ ৩০ বছর আগে মধুকবির ধর্মান্তরিত হওয়ার সময় ব্যাপক হইচই করেছিল। তারা চাইছিল, প্রভু যিশুর কাছে নতমস্তক হয়ে নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা জাহির করুন মাইকেল। আর অন্যপক্ষ মানে হিন্দুরা চাইছিল, যদি শেষ সময়ে মধুকবি অনুশোচনার বশবর্তী হয়ে পুনরায় হিন্দু ধর্মে ফিরে আসার জন্য আবেদন করেন। দু’পক্ষকেই নিরাশ করলেন মাইকেল।
প্রেম নয়, মধুসূদন দত্ত খ্রিস্টান হয়েছিলেন মূলত কেতাদুরস্ত ‘ইংরেজ’ হয়ে ইংল্যান্ড যাওয়ার জন্য। সাহিত্য সৃষ্টির জন্য। তাঁর ধর্মান্তরিত হওয়ার নেপথ্যে অন্য কোনও আদর্শগত কারণ ছিল না। তাই কোনওদিনই খ্রিস্টধর্মের কোনও নিয়মকানুন তিনি মানেননি। এমনকী গির্জায় পর্যন্ত যাননি। ফলে মৃত্যুশয্যায় তিনি ‘কনফেশন’ দেবেন, এটা খ্রিস্টানদের আশা করাটাই ভুল ছিল। আর ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ রচনা করে অনেক আগেই গোঁড়া হিন্দুদের ‘রামে’র নামে চটিয়েছিলেন মাইকেল। তাঁর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ অবধি হয়েছিল। ফলে হিন্দুদের কাছে এমনিতেই তিনি পরিত্যাজ্য। কিন্তু ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ভেবেছিলেন মধুকবি হয়তো মৃত্যুশয্যায় তাঁদের কথা শুনবেন। কিন্তু তিনি শোনেননি।
এই দু’পক্ষকে চটানোর ফল কী হতে পারে বুঝতেই পারছেন! না মিলল কফিন, আর না মিলল দাহ করার শ্মশান। খ্রিস্টান ‘মাইকেল’, আর হিন্দু ‘মধুসূদনে’র টানাপোড়েনে মৃতদেহ পড়ে রইল মর্গে! টানা দেড় দিন।
এবার একটু ফিরে যাওয়া যাক কয়েকমাস আগের ঘটনায়। ১৮৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে মধুসূদন গুরুতর অসুস্থ। কার্যত শয্যাশায়ী। তখন তিনি থাকেন এন্টালির কাছে ছোট্ট একটি ঘরে। স্ত্রী হেনরিয়েটাও শয্যাশায়ী। চিকিৎসা তো দূর অস্ত, তাঁদের না ছিল রোজগার, আর না ছিল খাবার। অন্যের অনুগ্রহে কোনওরকমে দিন কাটছিল।
মধুসূদনের প্রথম জীবনীকার যোগীন্দ্রনাথ বসু লিখছেন—‘মধুর স্বাস্থ্য দ্রুত ভেঙে পড়ছিল। গলায় ঘা দেখা দিয়েছিল। মাঝে মধ্যে রক্ত পড়ত গলা থেকে। জ্বর হতো কখনও কখনও। যক্ষ্মা বা গলার ক্যান্সার হয়েছিল কি না, জানা যায় না। যকৃতের সিরোসিস থেকেও এমন লক্ষণ দেখা দেওয়া সম্ভব।’
এই সময় এগিয়ে আসেন উত্তরপাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। দয়াপরবশ হয়ে মাইকেল, স্ত্রী হেনরিয়েটা এবং তাঁদের দুই সন্তানকে উত্তরপাড়া লাইব্রেরিতে তিনি নিয়ে আসেন। গঙ্গাতীরে লাইব্রেরির দোতলার ঘরে আশ্রয় নেন মধুসূদন। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই অসুস্থ। কে কাকে দেখবেন, সেটাই ছিল তখন বড় প্রশ্ন।
মাইকেল যখন এই অবস্থায় উত্তরপাড়ায় দিন কাটাচ্ছেন, তখন হাওড়ার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে এলেন প্রিয় বন্ধু গৌরদাস বসাক। প্রায়দিনই মাইকেলকে দেখতে তিনি হাজির হতেন উত্তরপাড়া লাইব্রেরিতে। শেষবার সেখানে গৌরদাস যে দৃশ্য দেখতে পান, তার স্মৃতিচারণ করে লিখছেন—‘আমি সেই হৃদয় বিদারক দৃশ্যের কথা কোনওদিনও ভুলব না। দেখলাম, বিছানায় শায়িত মধু রক্তবমি করছেন আর মেঝেতে শুয়ে হেনরিয়েটা রোগ যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। তাঁর সন্তান দু’টি খিদের জ্বালায় পচা পান্তাভাত খেয়ে ঘরের এক কোণে শুয়ে আছে। আর তাদের ভুক্তাবশেষ সেই পান্তা ভাতের ওপরে শত শত মাছি পড়েছে। আমি হেনরিয়েটার কাছে গেলাম, তিনি তাঁর স্বামীর দিকে আঙ্গুলি নির্দেশ করে অস্ফুট শব্দে বললেন, আমাকে নয় ওঁকে দেখুন।’
এই দৃশ্য বাল্যবন্ধু গৌরদাসকে বিচলিত করে। বন্ধুকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন মধুসূদন। প্রিয় বন্ধু গৌরদাসকে দেখে তাঁর মনে ভিড় করে কতশত পুরনো স্মৃতি। হিন্দু কলেজে পড়ার সময়ই গৌরদাসের পাশাপাশি তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় রাজনারায়ণ বসু, বঙ্কুবিহারী দত্ত, ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের মতো মানুষদের।
একবার মধুকবির খিদিরপুরের বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে হাজির হয়েছিলেন বন্ধু গৌরদাস আর ভোলানাথ। বাড়ির বৈঠকখানায় প্রবেশ করেই তো দুই বন্ধুর চক্ষু ছানাবড়া হওয়ার জোগাড়। পিতা-পুত্র একসঙ্গে আলবোলায় টান দিচ্ছেন। পিতা একবার পুত্রের দিকে নল এগিয়ে দিচ্ছেন আর পুত্রও টানা শেষ হলে তা ফিরিয়ে দিচ্ছেন পিতার দিকে। গৌর এই ঘটনা চাক্ষুষ করে পরে মধুকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর মিলল—‘আমরা পিতা-পুত্র অনেকটা বন্ধুর মতো। পিতা আদ্যিকালের বস্তাপচা নিয়ম সংস্কারের তোয়াক্কা করেন না। আমরা তো মাঝেমধ্যে একসঙ্গে মদ্যপানও করি।’ উত্তর শুনে গৌরদাস হতবাক। সময়কাল মনে রাখবেন, প্রায় একশো বছর আগের কথা বলছি।
হিন্দু কলেজে পড়ার সময় সাহিত্যের প্রিয় অধ্যাপক ডেভিড রিচার্ডসন ছাড়া অন্য ক্লাসে তেমন মন ছিল না মধুসূদনের। কলেজে পড়তে পড়তেই নিজের পিতার অনুসরণে মদ্যপান করতে শিখলেন। আর প্রিয় অধ্যাপক রিচার্ডসনের থেকে শিখলেন যে, সাহিত্য যদি ঠিক করে বুঝতে হয় তা হলে শুধু কাব্য পড়লে হবে না। নাটক পড়তে হবে এবং নিয়মিত ইংরেজি থিয়েটার দেখতে যেতে হবে। ঠিক তারপরেই ধুতি-আচকান পরা ‘বাঙালি মধুসূদন’ হঠাৎ করে কোট-প্যান্ট পরে কলেজে আসতে শুরু করলেন। সেই ইংরেজিয়ানার শুরু। বাঙালি মধুসূদন হলেন ‘ইংরেজ মধুসূদন।’
রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের তখন কলকাতাজুড়ে বেশ নামডাক। কারণ তাঁর ধর্মান্তকরণ নিয়ে তখন মুখে মুখে চর্চা হতো। সেই সব মুখরোচক কাহিনি শুনে মধুসূদন একদিন গেলেন কৃষ্ণমোহনের বাড়ি। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের ইচ্ছাপ্রকাশ করলেন। কৃষ্ণমোহন রাজি হলেন মধুকে খ্রিস্টান করতে।
কলকাতার লাল গির্জা যা ওল্ড মিশন চার্চ নামে পরিচিত, সেখানেই খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেন মধুসূদন। সেই চার্চ ঘিরে রেখেছিল ইংরেজ সেনাবাহিনী। পাছে পিতার লেঠেল বাহিনী মধুকে তুলে নিয়ে যায়!
মধুসূদনকে দীক্ষিত করেছিলেন পাদরি ডিলট্রি। তিনিই ‘মাইকেল’ নামকরণ করেন। এরপর মধুসূদন পরিচিত হন ‘মাইকেল মধুসূদন দত্ত’ নামে। খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নেওয়ার কয়েকদিন আগে এক মোহর খরচ করে ফিরিঙ্গি কায়দায় চুল ছেঁটেছিলেন তিনি। ইংরেজদের মতো কোট-প্যান্ট তো আগেই পরতেন, এবার চুলও কাটলেন। আদব-কায়দা, কথাবার্তা, হেয়ার কাটিং...সবেতেই মধুসূদনের মধ্যে একটা ইংরেজ ছাপ ফুটে উঠল।
মধুসূদনের ধর্মান্তর কলকাতার সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করল। পিতা রাজনারায়ণ লেঠেল বাহিনী পাঠালেন। মধুকে খ্রিস্টানরা লুকিয়ে রাখল ফোর্ট উইলিয়ামে। আর এই সবের সূত্র ধরে হিন্দু কলেজে পড়ার পাঠও চুকে গেল। মাইকেল ভর্তি হলেন গঙ্গার ওপারে, হাওড়ার শিবপুরের বিশপস কলেজে। বিশপস কলেজ ছিল গোঁড়া খ্রিস্টান কলেজ। আর খরচা ছিল প্রচুর।
এদিকে রাজনারায়ণ দত্ত ‘বিধর্মী’ মধুসূদনকে ত্যাজ্যপুত্র বলে ঘোষণা করলেন। আর পুনরায় পুত্রসন্তানের আশায় আরও তিন-তিনটি বিবাহ থেকেও পিছপা হলেন না।
যদিও প্রথমদিকে পুত্রকে পরিত্যাগ করলেও, বিশপস কলেজে পড়ার বিপুল ব্যয়ভার বহন করছিলেন রাজনারায়ণ। চার বছর অপেক্ষার পর যখন তিনি দেখলেন পুত্র আর ফিরবে না, তখন টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেন।
গোঁড়া বিশপস কলেজে পড়ার সময় প্রতিনিয়ত বর্ণবিদ্বেষের সাক্ষী ছিলেন মাইকেল। একদিন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদও করলেন। বিশপস কলেজের কাগজপত্রে কেন তাঁর নাম একটিবারও ‘মাইকেল’ বলে লেখা হয়নি, তা নিয়ে খুব হইচইও করলেন। কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ কিছু হল না। বুঝলেন, তিনি শুধু ‘মধুসূদন ডাট’ হয়েই থেকে গিয়েছেন। কোথাও ‘মাইকেল’ নামটি তাঁর সঙ্গে জোড়েনি। এক জায়গায় মধুসূদন লিখছেন—‘একজন কৃষ্ণাঙ্গের সঙ্গে ব্রিটিশ অথবা ইউরোপীয় নাম বা উপাধি ইংরেজরা কিছুতেই মেনে নিতে পারতেন না।’
বিশপস কলেজে পড়া শেষ করে কলকাতায় চাকরির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন মধুসূদন। এরপর বিশপস কলেজের কয়েকজন মাদ্রাজি বন্ধুর সঙ্গে ভাগ্যান্বেষণে মাদ্রাজ অভিমুখে যাত্রা। সেখানে যাত্রীদের নামের তালিকায় মধুসূদন লেখেন, ‘মিঃ এম এম ডাট অব বিশপস কলেজ।’
মাদ্রাজে স্থানীয় খ্রিস্টান ও ইংরেজদের সহায়তায় একটি স্কুলে ইংরেজি শিক্ষকের চাকরি পান মধুকবি। তবে সেখানে বেতন যা পেতেন, তাতে তাঁর ব্যয়সংকুলান হতো না। সেই কারণে ইংরেজি পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। মধুসূদনের সাংবাদিক জীবন শুরু হয়। ‘ইউরেশিয়ান’, ‘মাদ্রাজ হিন্দু ক্রনিকলে’র সাংবাদিক এবং ‘মাদ্রাজ স্পেক্টেটর’ কাগজের সহকারী সম্পাদকও হন।
এই নিদারুণ দারিদ্র্যের মধ্যেই মাইকেল রচনা করেন ‘দ্য ক্যাপটিভ লেডি’। এটি ছিল তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। তারপর অবশ্য কবি ও দক্ষ ইংরেজি লেখক হিসেবে মাইকেলের নাম দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল, এমনটা একেবারেই নয়। কলকাতায় বেথুন সাহেবকে বই পাঠিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ইংরেজি ছেড়ে বাংলায় লিখলেই বোধ হয় ভালো হয়।’
মাদ্রাজে আসার কিছুকাল পরেই মধুসূদন রেবেকা ম্যাকটিভিস নামে এক ইংরেজ যুবতীকে বিবাহ করেন। মাদ্রাজে যে স্কুলে তিনি পড়াতেন, সেই স্কুলের ছাত্রী ছিলেন রেবেকা। আট বছরের দাম্পত্যজীবনে রেবেকা-মধুসূদনের দুই পুত্র ও দুই কন্যার জন্ম হয়। মাদ্রাজ জীবনের শেষ পর্বে রেবেকার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হয় তাঁর। এর অল্পকাল পরেই মধুসূদন এক ফরাসি তরুণীকে বিবাহ করেন। নাম হেনরিয়েটা। ইতিহাস বলছে, হেনরিয়েটা-মধুসূদনের আইনি বিবাহ হয়নি। অদ্ভুত এক জীবন!
দীর্ঘ আট বছর মাদ্রাজ অবস্থানকালে তাঁর পৈতৃক বাসভবনটি বেদখল হয়ে যায়। পিতা-মাতার মৃত্যুসংবাদও তাঁকে জানানো হয়নি। কলকাতা ফিরে পুলিস কোর্টে সামান্য এক কেরানির চাকরিগ্রহণ করেন মধুসূদন। পেটের দায়ে সেই চাকরি করেন কিছুদিন। এর সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যরচনাও চলতে থাকে জোরকদমে।
এরপর মধুর স্বপ্নপূরণের জন্য ইংল্যান্ড যাত্রা। তারপর ইংল্যান্ড থেকে ফ্রান্সে। সেসময় দারুণ অর্থকষ্টে পড়লেন। প্রথম যৌবনের সেই দম্ভের উক্তি—‘রাজনারায়ণ দত্তের ছেলে টাকা গুনে ব্যয় করে না...’ সেকথা মনে করতেন প্রায়শই। কিন্তু মধুসূদন বেঁচেছেন নিজের শর্তেই। ধার করেও ঘি খেয়েছেন, খাইয়েছেন।
আর্থিক সেই অনটনের দিনে ‘করুণাসাগর’ রূপে সহায় হন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। মধুসূদনের কথায়—‘মাই ডিয়ার ভিড!’ আর্থিক অনটনের মধ্য দিয়ে ব্যারিস্টারি শেষ করে দেশে ফেরেন। কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করার অনুমতি পেলেন ঠিকই, কিন্তু ওকালতি ব্যবসায় সফল হলেন না। ছেড়ে দিলেন ওকালতি। ধার-দেনা জমতে জমতে পাহাড়ের আকার নিল। এদিকে হাজারো সমস্যায় জর্জরিত বিদ্যাসাগরও নিজেকে সরিয়ে নিলেন মধুসূদনের কাছ থেকে।
১৮৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের পরের কথা। শয্যাশায়ী মধুসূদন স্ত্রী এবং দুই সন্তানকে নিয়ে মধ্য কলকাতার এন্টালির ভাড়াবাড়ি থেকে চলে এসেছেন উত্তরপাড়া লাইব্রেরিতে। উত্তরপাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের বদান্যতায় আশ্রয় মিললেও থাকা-খাওয়ার কষ্ট কম ছিল না। লাইব্রেরির দোতলার ঘরে মাইকেল ও স্ত্রী হেনরিয়েটা দু’জনকেই শয্যাশায়ী অবস্থায় পড়ে থাকতে সহ্য করতে পারেননি বন্ধু গৌরদাস। হাওড়ায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বদলি হয়ে আসার পর থেকে বিভিন্ন উপায়ে তিনি সাহায্য করতেন বন্ধুকে। গৌরদাসকে দেখলেই কান্নায় ভেঙে পড়তেন মধুসূদন। চোখ ভিজে আসত গৌরদাসেরও। উন্নত চিকিৎসার জন্য তিনি অবিলম্বে মধুসূদনকে কলকাতায় নিয়ে যেতে চাইলেন। রাজি হলেন কবি। এরপর বজরায় করে অসুস্থ মধুসূদনকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হল।
কলকাতায় এসে হেনরিয়েটা উঠলেন জামাতা উইলিয়াম ওয়াল্টার এভান্স ফ্লয়েডের বাড়িতে। সেই বাড়ির ঠিকানা ছিল, ১১ নম্বর লিন্ডসে স্ট্রিট। ইংরেজ এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পাড়া ছিল এই লিন্ডসে স্ট্রিট, যা চৌরঙ্গী রোডের সঙ্গে সংযুক্ত। স্ত্রীর সংস্থান হলেও মাইকেলের নিজের থাকার জায়গা তখনও জোটেনি।
ঘনিষ্ঠরা যখন দেখলেন কারও বাড়িতে রেখে চিকিৎসা সম্ভব নয়, তখন তাঁরা মাইকেলকে ভর্তি করে দিলেন আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে। সেই যুগে হাসপাতালে ভর্তি হওয়াকে শাস্ত্রবিরুদ্ধ বলে মনে করা হতো। আর এই আলিপুর হাসপাতালটি ছিল মূলত বিদেশি এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের জন্য সংরক্ষিত। কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির অনুরোধে এবং খ্রিস্টান পরিচয়ের সুবাদে আলিপুর হাসপাতালে ভর্তির অনুমতি পেলেন মধুকবি। শুরু হল চিকিৎসা। সাময়িক স্বস্তি পেলেও মুখ দিয়ে প্রতিমুহূর্তে চলকে চলকে রক্ত বেরনো শুরু হল। স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকল খুব দ্রুত। চিকিৎসকরা জানালেন—‘সিরোসিস অব লিভার।’ আর বাঁচবেন না। জীবনীকার যোগীন্দ্রনাথ বসু লিখছেন, ‘অপরিমিত মদ্যপান করে মৃত্যুকে তিনি ত্বরান্বিত করেছিলেন।’
হাসপাতালে একদিন মাইকেলের দেখা করতে এলেন তাঁর এক সময়ের মুন্সি মনিরুদ্দিন। কবির কাছে তার পাওনা ছিল ৪০০ টাকা। সেই টাকা ফেরত দেওয়ার জায়গায় মধুকবি উল্টে মনিরুদ্দিনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘পকেটে কত টাকা আছে মণি?’ মনিরুদ্দিন পকেট হাতড়ে বললেন, ‘মাত্র দেড় টাকা আছে।’ মধু সেটাই চাইলেন। পাছে ওই টাকায় বাবু মদ কিনে নেন, তাই দিতে একটু অস্বস্তি বোধ করছিলেন মনিরুদ্দিন। অনেক মানসিক দ্বন্দ্ব শেষে তিনি সেই টাকা কবির হাতে তুলে দিলেন। হাসপাতালে সেবা শুশ্রুষাকারিণী নার্সকে ডেকে ওই দেড় টাকা তাঁর হাতে তুলে দিলেন মধুসূদন। বিষয়টি দেখে মনিরুদ্দিনের চোখে জল চলে এল।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই হেনরিয়েটার মৃত্যুসংবাদ পেলেন মাইকেল। যদিও সেই দুঃসংবাদের থেকে তিনি অনেক বেশি চিন্তিত ছিলেন স্ত্রীর শেষকৃত্য কীভাবে হবে, সেটা নিয়ে। তাঁকে সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছিল একটাই বিষয়—অর্থ আসবে কোথা থেকে। অবশেষে তাঁকে আশ্বস্ত করলেন বন্ধু এবং আত্মীয় মনমোহন ঘোষ। তিনি মধুসূদনকে জানালেন, হেনরিয়েটার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ঠিকমতো হয়েছে। কোনও খামতি হয়নি। মাইকেল তখন জানতে চান, স্ত্রীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর এসেছিলেন কি না। মনমোহন জানান, তাঁদের খবর দেওয়া সম্ভব হয়নি।
কবি তখনও মৃত্যুশয্যায়। হঠাৎই একদিন হাসপাতালে এসে হাজির হলেন রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায় এবং রেভারেন্ড চন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। উদ্দেশ্য একটাই—খ্রিস্টধর্ম অনুযায়ী কবির শেষ স্বীকারোক্তি আদায় করা। মধু একথা শুনে বললেন, ‘মানুষের তৈরি চার্চের আমি ধার ধারিনে। আমি আমার স্রষ্টার কাছে ফিরে যাচ্ছি। তিনিই আমাকে তাঁর সর্বোত্তম বিশ্রামস্থলে লুকিয়ে রাখবেন। আপনারা যেখানে খুশি আমাকে সমাধিস্থ করতে পারেন; আপনাদের দরজার সামনে অথবা গাছ তলায়। আমার কঙ্কালগুলোর শান্তি কেউ যেন ভঙ্গ না করে। আমার কবরের উপর যেন গজিয়ে ওঠে সবুজ ঘাস।’
৪৯ বছর বয়সে মৃত্যু হল মাইকেলের। মৃতদেহ নিয়ে এরপর শুরু হল এক বিচিত্র দ্বন্দ্ব। খ্রিস্টান এবং হিন্দুপক্ষ উভয়ের কেউই কবির মৃতদেহের দায়িত্ব নিতে চাইলেন না। চক্ষুলজ্জার খাতিরে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন ছুটলেন কলকাতার প্রধান বিশপের কাছে। কলকাতার প্রধান বিশপ তখন লর্ড রবার্ট মিলম্যান। তিনি ছিলেন একজন গোঁড়া খ্রিস্টান। ধর্মান্তরিতদের সম্পর্কে নিয়মিত সমস্ত খবরাখবরও রাখতেন। মাইকেলের ঔদ্ধত্য সম্পর্কে আগেই শুনেছিলেন। তাই মধুকবির মৃতদেহ খ্রিস্টানদের গোরস্থানে সমাহিত করার অনুমতি দিলেন না বিশপ। ফলে মৃত্যুর পরের দিন সকালেও মাইকেলের নিথর দেহ পড়ে রইল মর্গে।
মাইকেলের জ্ঞাতিদের কেউই হিন্দুধর্মের নিয়ম মেনে মধুসূদন দত্তকে শ্মশানে নিয়ে যেতে রাজি হলেন না। উলটে একথা বলতে শোনা গেল—‘মধুসূদন! সে তো উচ্চস্বরে একসময় ঘোষণা করেছিল যে একটা আলপিনের ডগায় যতটা জল ধরে আমি সেটুকুও হিন্দু ধর্মকে বিশ্বাস করি না! ওরকম একজন নাস্তিককে গঙ্গার ঘাটে আমরা পোড়াতে নিয়ে যাব কোন লজ্জায়!!’ আষাঢ় মাসের ওই গরমের দিনে ধর্মীয় বিরোধের কারণে মাইকেলের মরদেহ মর্গেই পচতে থাকল।
ঠিক সেই সময় পরিত্রাতা হয়ে এলেন এক ব্যাপটিস্ট ধর্মযাজক। নাম রেভারেন্ড পিটার জন জার্বো। তিনি নিজের দায়িত্বে বিশপের অনুমতি ছাড়াই মাইকেলের মৃতদেহ সমাধিস্থ করার উদ্যোগ নেন। অবশেষে ৩০ জুন বিকেলে, মৃত্যুর দেড়দিন পর মাইকেলের মৃতদেহ নিয়ে মানুষজন এগিয়ে যান লোয়ার সার্কুলার রোডে স্থিত খ্রিস্টান গোরস্থানের দিকে। সেখানেই দিন চারেক আগে কবর খোঁড়া হয়েছিল তাঁর স্ত্রী হেনরিয়েটার জন্য। স্ত্রীর ঠিক পাশেই কবর খুঁড়ে কফিনে শোয়ানো হল দত্তকুলোদ্ভব মাইকেল মধুসূদন দত্তকে।
এক ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানের মৃতদেহকে নিয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতে নারাজ ছিল খ্রিস্টান সম্প্রদায়। যে কারণে চার্চের ‘বারিয়াল’ রেজিস্টারে তাঁর নাম নথিভুক্ত করা হল না। যে কারণে লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে রক্ষিত চার্চের রেজিস্টারে মাইকেল এবং তাঁর স্ত্রী হেনরিয়েটাকে সমাধিস্থ করার কোনও তথ্যই নেই। যেভাবে স্বামী বিবেকানন্দের প্রয়াণ নিয়ে কলকাতার সংবাদপত্রগুলি সেভাবে খবর করেনি, একইভাবে মাইকেলের মৃত্যু নিয়েও তারা ছিল একেবারে নীরব। সেই সময়ের বিখ্যাত কাগজ ‘ইংলিশম্যান’ খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মৃত্যুহার ও জীবনযাপন নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠল। অন্যদিকে, মিশনারিদের কাগজ ‘ফ্রেন্ডস অব ইন্ডিয়া’ মাইকেলের বিরুদ্ধে নিম্নমানের কিছু সমালোচনা করে খুব সংক্ষেপে তাঁর মৃত্যু সংবাদ ছাপল। হাজারো দ্বন্দ্বের মাঝে নীরবে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই হল দত্তকুলোদ্ভব শ্রীমধুসূদনের!