পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি কর্মে ব্যস্ততা। ব্যবসা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা। ... বিশদ
বাংলাদেশ ও শিলং থেকে ফিরে প্রায় সাত মাস বেলুড় মঠে ছিলেন স্বামীজি। কখনও জুতো পরে, কখনও চটি বা খালি পায়ে ঘুরে বেড়াতেন মঠ চত্বরে। তখন তাঁর পোষ্য হয়েছে অনেকগুলো। হাঁস, কুকুর, ছাগল, সারস, হরিণও ছিল তার মধ্যে। স্বামী ব্রহ্মানন্দের উপর মঠে তরকারি ও ফুলের বাগান তৈরির ভার ছিল। স্বামীজির পোষ্য ছাগল সেই বাগানে প্রবেশ করলেই তিনি আপত্তি করতেন। স্বামীজি পোষ্যদের পক্ষ নিয়ে এমন বলতেন, যেন গাছ নষ্ট করে কোনও দোষই করেনি তারা। দুই মহাযোগীর শিশুসুলভ আচরণে সকলেই মুগ্ধ হতেন। এ সবই ছিল স্বামীজির সমাধিমগ্ন মনকে নীচে নামিয়ে রাখার প্রচেষ্টা।
দক্ষিণেশ্বরে বসে শ্রীরামকৃষ্ণ একদিন তাঁর অন্য যুবক সন্তানদের বলেছিলেন, ‘নরেন যখন নিজেকে চিনবে তখন আর এ জগতে থাকবে না!’ ঠাকুরের সেই কথা স্মরণে ছিল সকলেরই। তাই তাঁরা কখনও স্বামীজির স্বরূপ নিয়ে কোনও কথা বলতেন না। একদিন ধ্যানঘরে হাসিঠাট্টার ছলে কেউ জিজ্ঞাসা করেন, ‘নরেন ভাই, তুমি কি এখন নিজেকে চিনতে পারছ?’ সকলকে হতচকিত করে উত্তর এল, ‘হ্যাঁ, পাচ্ছি!’ মুহূর্তে পরিবেশ বদলে গেল! সকলের মনে আতঙ্ক, তবে কি নরেন দেহত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? কেউ আর টুঁ শব্দটি করলেন না। যোগী যে প্রস্তুত, তাঁর ইঙ্গিত অনেকেই পাচ্ছিলেন। কারণ, স্বামীজি বারংবার বলছিলেন, ‘তোরা সব বুঝে নে! আমি আর কতদিন!’ নরেন্দ্রনাথের মন তখন শ্রীরামকৃষ্ণমুখী।
স্বামীজি কোনও দেবতার কাছে সহজে মাথা নোয়াতেন না। সেই কারণে ঠাকুর একদিন সন্দেশের মধ্যে জগন্নাথের প্রসাদ ভরে খাইয়ে দেন! অন্য সময় স্বামীজি কিছু মন্তব্য করতেন, সেদিন করলেন না! নীরবে দুজনে মঠে ফিরে এলেন। একদিন আহিরীটোলা থেকে নৌকায় মঠে ফিরছেন, সঙ্গে শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী! তিনি হঠাত্ স্বামীজির কাছে ঠাকুর কী বলতেন, জানতে চাইলেন। তিনি হেসে বললেন, ‘আমি তাঁর দৈত্যদানোদের মধ্যে কেউ একটা হব! তাঁর সামনেই তাঁকে কখনও কখনও গালমন্দ করতুম!’ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে অস্ফুট স্বরে গান ধরলেন তিনি,
‘(কেবল) আশার আশা ভবে আসা, আসামাত্র হল।
এখন সন্ধ্যেবেলা ঘরের ছেলে ঘরে নিয়ে চল।’
ঘরে ফেরার তাড়া বড় বেশি হয়ে উঠেছিল। নিবেদিতাকে ২৯ জুন বলেন, তাঁর মধ্যে বিরাট তপস্যার ভাব জেগে উঠছে। স্বামীজি বুঝেছিলেন যে, দিন ফুরিয়ে আসছে! ঢাকায় বক্তৃতার পর বলেছিলেন, ‘আমি বড়জোর এক বছর আছি!’ বেলুড় মঠে একথা শুনে একজন জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘যাবেন কেন?’ উত্তর দিয়েছিলেন, ‘বড় গাছের ছায়া ছোট গাছগুলোকে বাড়তে দেয় না, তাদের জায়গা করে দেবার জন্য আমাকে যেতেই হবে!’ দেহত্যাগের কিছুদিন আগে স্বামী শুদ্ধানন্দের থেকে একটি পঞ্জিকা চেয়ে নিলেন। নিবিষ্ট মনে দেখছিলেন। মনে হচ্ছিল, কোনও শুভদিনের খোঁজ করছেন। মহাসমাধির পরে সকলের মনে হয়েছিল শ্রীরামকৃষ্ণও ঠিক এমনই করেছিলেন। মহাসমাধির তিনদিন আগে মঠে ঘুরে বেড়ানোর সময় হঠাত্ বিল্ববৃক্ষের পাশের সবুজ তৃণে আচ্ছাদিত জায়গাটি দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার দেহ গেলে ওইখানে সত্কার করবি!’ জুন মাস থেকেই জাগতিক খবরে স্বামীজির অনীহা সকলের চোখে পড়ল। একজনকে স্পষ্ট বললেন, ‘আমি মৃত্যুর জন্য তৈরি হচ্ছি।’ আর মৃত্যুর দিন? স্বামী প্রেমানন্দ শুনলেন ঠাকুর ঘর থেকে নামতে নামতে অস্ফুট স্বরে তিনি বলছেন, ‘আরেকটা বিবেকানন্দ এলে বুঝত, এ বিবেকানন্দ কী করে গেল!’ ৪ জুলাই তাঁর শরীর সকাল থেকে বেশ ভালো ছিল। সেদিন মঠে ইলিশ মাছ রান্না হয়েছিল। তার আগেই একাদশীর দিন দুধ আর কাঠালের বিচি সেদ্ধ খেয়ে খিদে চাগাড় দিয়েছে। ইলিশ মাছের নানা পদ তৃপ্তি সহকারে খেয়ে ঠাট্টা করেছিলেন স্বামীজি, ‘একাদশীর পর খিদেটা বড় চাগাড় দিয়ে উঠেছিল, ঘটিবাটিগুলো খুব কষ্টে ছাড়লুম!’ বিকেলে অনেকটা পথ হেঁটে সন্ধ্যায় নিজের ঘরে জপে বসলেন। একঘণ্টা পর সেবারত ব্রহ্মাচারীকে বাতাস করতে বলে শুয়ে পড়লেন। হাতে তখনও জপের মালা! বাঁ-পাশ থেকে দক্ষিণ পাশে ফিরলেন। মুখে অস্ফুট শব্দের সঙ্গে সঙ্গে মাথা এলিয়ে পড়ল বালিশে। মহাযোগী মহাধ্যানে প্রবেশ করলেন। চোখদু’টি অর্ধমুদিত। অর্ধখোলা সাদা অংশ থেকে যেন জ্যোতি বের হচ্ছে। সেই রাতে ভগিনী নিবেদিতা স্বপ্ন দেখলেন, শ্রীরামকৃষ্ণ আবার দেহত্যাগ করেছেন। ঘুম ভাঙল দরজায় প্রবল করাঘাতের শব্দে। দরজা খুলে দেখলেন মঠ থেকে স্বামী সারদানন্দ চিঠি পাঠিয়েছেন, ‘কাল রাতে স্বামীজি ঘুমিয়ে পড়েছেন, সেই ঘুম থেকে তিনি আর কোনওদিন উঠবেন না!’ আমেরিকার স্বাধীনতা প্রাপ্তির দিনে জগত থেকে বিদায় নিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তবে তাঁর জাগ্রত বিবেক এখনও আমাদের প্রাণিত করে। গভীর প্রাণের মর্মস্থলে!