পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি কর্মে ব্যস্ততা। ব্যবসা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা। ... বিশদ
গত ক’দিন ধরেই জামাই ষষ্ঠী মনে বেশ পুলক জাগাচ্ছিল। সাতমহলা শ্বশুরবাড়ি। পেল্লায় ঝাড়বাতি, বেলজিয়াম থেকে আনা দু’মানুষ সমান আয়না। ভেনিস থেকে আনা শ্বেতপাথরের সব মূর্তি। পোর্সেলিনের কয়েক শো পুতুল। কালো কুচকুচে বার্নিস করা বার্মা টিকের দেরাজ, তেপায়া টেবিল, ইজি চেয়ার। আলমারি ভরা বই। বাড়ির অন্দরমহলেই বাগান। দাঁড়িয়ে রয়েছে সাদা পাথরের ভেনিস। ঘরে রবি বর্মা, যামিনী রায়ের ওরিজিন্যাল। ছাদটায় নাইন সাইড ক্রিকেট খেলা যায়। পিয়ানোটা এখনও সুরে বাজে। দেড় মানুষ উঁচু ঘড়িটার গং শুনলে বুক কেঁপে ওঠে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়, তবু বাড়ি ঘুরে দেখা শেষ হয় না। ফলে বিয়ের পর প্রথম জামাই ষষ্ঠীর নেমতন্ন পেতেই মনটা যাওয়ার জন্য ছটফট। ভোর থাকতে থাকতে সেজেগুজে তৈরি।
‘বলো কী বাবা। বচ্ছরকার দিন। এটুকু খাবে না। মাথা খাও আমার। এক ফোঁটা ফেলে উঠবে না। তেতো দিয়ে শুরু করো, খিদে বাড়বে’-শাশুড়ির জবাব এল। থালার ওদিক পানে এতক্ষণ তো তাকানোই হয়নি। উচ্ছে, নিম-বেগুন, তেতোর শাক। শুক্তো। পাঁচ রকমের ভাজা। তারপর পটল পোস্ত। চিংড়ি দিয়ে এঁচোড়। লাউ দিয়ে কুচো চিংড়ির ডালনা। এই গন্ধমাদন পেরিয়ে তবে আমিষে পা রাখা যাবে। শুরুতে ভেটকি। আর মাছের পদ শেষ হচ্ছে দই-সর্ষে-ইলিশ দিয়ে। পেটি-গাদা মিলিয়ে পেল্লায় দু’পিস। ভিতরে ডিম। ‘ভালো করে খাও। তোমার জন্য সোনা কাকিমা বাংলাদেশ থেকে পাঠিয়েছে। ফেল না কিছু, বুঝলে।’ গম্ভীর গলাটা শ্বশুরমশাইয়ের। কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন টের পাইনি। মুখ নিচু করেই ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাতে হল। এরপর পাঁঠার বাটি।
আর পারা যাচ্ছে না। বনেদি শ্বশুর বাড়ির খাবার ঘরটি বিশাল। দু-দু’টো এসি চলছে। দু’টো পাখা বনবন করে ঘুরছে। তারমধ্যে কে জানে কেন শাশুড়ি লাল লেস দেওয়া একটি হাতপাখা নেড়ে সমানে বাতাস করে চলেছেন। তাতেও কপাল থেকে আর পিঠ বেয়ে নামছে ঘাম। পেটটা মনে হচ্ছে ফেটেই গেল বুঝি। এবার গলা শোনা গেল বউয়ের, ‘শোনো, হাজি সাহেবের দোকান থেকে বাবা নিজে গিয়ে কিনে এনেছে। অতটা গেছে ড্রাইভ করে। ন্যাকামি করে, পারব না, বলবে না কিন্তু।’ ততক্ষণে ইলিশ-কই-চিংড়ি-শুক্তো-শাক সব মিলেমিশে কিম্ভুতমার্কা ঢেঁকুর ওঠা শুরু হয়ে গিয়েছে। সুস্বাদু মাংসটারও যেন কোনও টেস্ট নেই। তবু প্রাণের দায়ে চিবিয়ে যেতে হচ্ছে। শুনলাম, দই মোল্লার চক থেকে আনা। ক্ষীরের পুর দেওয়া রাজভোগ এমনিতে খুব প্রিয়। কিন্তু এখন কেমন বিস্বাদ। উচ্ছে ভাজার মতো তেতো লাগছে। শরীরের ওজন বেড়ে গিয়েছে যেন। নিজেকে একটা মোষের মতো মনে হচ্ছে। এবার চেয়ার ভেঙে না পড়তে হয়। তবে ভালো-মন্দ সবকিছুরই শেষ আছে। গলাধঃকরণের পর্বও অবশেষে শেষ হল। আইঢাই করছে শরীর। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসার জোগাড় প্রায়। তবে না শাশুড়ি-না শ্বশুর-না বউ, কেউ এই পারফরম্যান্সে খুশি নয়। ‘লজ্জা করে খেয়েছে বুঝলে মা’-বক্তব্য গিন্নির। ‘এখন ছেড়ে দিলাম, বিকেলে কিন্তু ফলপাকুড়যা দেব সব খেতে হবে। তখন ছাড়ব না, এখনই বলে রাখলুম’-শাশুড়ি খানিক রুষ্ট হয়েই বললেন বোঝা গেল। শ্বশুর দারোগা সুন্দরবাবুর মতো একটা ‘হুম’ বলে প্রস্থান করলেন। শ্বশুর বাড়ি আসার যে ফূর্তি ছিল সব পুলক এখন পগারপার। একপ্রকার ফাঁসির খাওয়া খেয়ে মৃত্যু যখন আসন্ন প্রায়, তখনও দেখা যাচ্ছে খুশি হননি কেউ-ই। বেঁচে যাওয়া খাবারগুলো ঠেসে ঠেসে গলায় ঢুকিয়ে দিতে পারলে হয়ত শান্তি পেতেন।
তবে ফলগুলো ব্যাগে ভরে ‘কাল অবশ্যই খাব মা’ বলে নিয়ে আসা গেল। এক হাঁড়ি রাজভোগ- দু’টো গোটা ইলিশ-জ্যান্ত কই পনেরোটা-আর এক হাঁড়ি দই গাড়িতে তোলা হল। এবার যেতে হবে। শ্বশুরের পাকানো গোঁফটা দেখলে বাচ্চারা প্রায়শই কেঁদে ফেলে। সেই গম্ভীর শ্বশুরের চোখটাকি একটু ছলছল করছে? পাহাড়ের মতো গম্ভীর একটা লোক কাঁদে নাকি? আগে দেখিনি তো! ‘বাড়িটা খাঁ খাঁ করে। কী ওই চার কামরার ফ্ল্যাটে থাক? এখানে থেকেই অফিস টফিস করতে পার’-নাক টানছেন শ্বশুর। শাশুড়ি ঘাড় ঘোরালেন। যাওয়ার সময় চোখের জল দেখলে অকল্যাণ হয়।
সাতমহলা বাড়িটা আবার খাঁ খাঁ করবে। দুপুরে পায়রার বকবকম তালা ধরাবে কানে। সোনার মতো চকচকে কাঁসার বাসনগুলি কালো হতে শুরু করবে আবার। বার্নিস করা দেরাজ ঢাকবে ঝুলে। ঝোড়ো হাওয়ায় ধুলো উড়বে ছাদে। তখন দুপুরে ইজিচেয়ারে বসে শূন্য চোখে কড়িকাঠ গুনবেন পাকানো গোঁফ। পালঙ্কে শুয়ে এপাশওপাশ করবেন জরিপাড় সাদা শাড়ির মোমের পুতুলের মতো দেখতে বৃদ্ধা। বালিশের একটা কোণ চোখের জলে ভিজে দাগ কেটে রেখে দেবে আবার। তবে জামাই ষষ্ঠী আবার আসবে। সেদিন আবার জানলাগুলো দিয়ে বাড়তি রোদ ঢুকবে ঘরে। প্রাক বর্ষার বৃষ্টিতে ভিজে সবকিছুর মতো ঝকঝক করে উঠবে দুটো প্রবীণের মন। বাড়ি নয়, বই নয়, শুধু দু’টো মানুষের জন্য সেজেগুজে ফের আসতে হবে।
গানটি গিন্নির খুব প্রিয় বলে গাড়িতে সারক্ষণই চলে। এখনও বাজছে,‘হৈমবতী শিব সোহাগী রাজার নন্দিনী/তার কপালে পাগলা ভোলা লোকে কী কবে? লোকে কী কবে? লোকে কী কবে?/সাজতে হবে, সাজতে হবে শিব তোমাকে সাজতে হবে।’