পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি কর্মে ব্যস্ততা। ব্যবসা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা। ... বিশদ
যুবকের অনর্গল অপমান করার প্রবণতা প্রতিটি বাক্যবাণে। সন্ন্যাসী ভাবলেশহীন। বিশাল এক বেলেপাথর খাড়াভাবে দণ্ডায়মান। বিশাল বটবৃক্ষে হেলান দিয়ে রাখা। ওই বটবৃক্ষের তলায় আজও বসে বৈঠক।
তারকেশ্বরে এক রাজনৈতিক ডাকাতির পরিকল্পনা চলছে। বিপ্লবীদের গুপ্ত সংগঠন থেকে এসেছে চিরকুট। সম্মতি দিয়েছেন যতীন্দ্রনাথ। ওই পাথরের পাশে কিছুক্ষণ আগেই জ্বালিয়ে দিয়েছেন কোড ওয়ার্ড। কোনও প্রমাণ রাখা সম্ভব নয়। আগামী প্রজন্ম হয়তো যতীন্দ্রনাথকে এক বিপ্লব বিমুখ ব্যক্তিত্ব হিসেবে জানবে। ক্ষতি নেই। রাজনৈতিক ডাকাতি, ব্রিটিশ গুপ্তচর হত্যা—এমন নানা ঘটনার ঘনঘটায় আলোড়িত এক নবযুগের সূচনা হয়েছে বাংলায়। এ অগ্নিনির্ঝর সময়ের রণশিঙা যিনি বাজিয়েছিলেন, ধর্মপ্রচারের অছিলায় দেশীয় রাজাদের বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আগুন যিনি প্রজ্জ্বলিত রেখেছিলেন, সেই সন্ন্যাসীর বিপ্লব প্রচেষ্টা সম্পর্কে দেশবাসী কি কখনও জানবে? তিনি কি কেবলই এক হিন্দু সন্ন্যাসী হয়ে থেকে যাবেন ইতিহাসে?
আকাশের আলো নিভে এসেছে। প্রদীপ শিখার মতো অস্তাচলে সূর্য। রক্তিম আভা শতাব্দী প্রাচীন বটগাছের ডাল ভেদ করে এসে পড়েছে যতীন্দ্রনাথের স্নেহাস্পদ তরুণ বিপ্লবীর মুখে। এক মুহূর্তের বিভ্রমে আঁতকে উঠলেন যতীন্দ্রনাথ। এ যে বিদ্রোহী সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ! অবিকল সেই চোখ, সেই মহাজ্ঞানের প্রকাশ রয়েছে ছেলেটার মুখাবয়বে! ভুল ভাঙল নিমেষে। তরুণ বিপ্লবী ভূপেন্দ্রনাথের পরিচয়, তিনি স্বামী বিবেকানন্দের ভাই। দাদার অনুসারি হলেও ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত এই পরিচয়কে অপছন্দ করেন। বাংলার পবিত্র মাটিতে সামান্য এক ধূলিকণা, এতটুকুই তাঁর শংসাপত্র। স্বামীজির ভাই নন, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যে ভূপেন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত এক বিপ্লবী। চান্না আশ্রমে বসেও যতীন্দ্রনাথ তাঁর সব খবর রাখেন।
একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন মস্ত বেলে পাথরটার দিকে। স্বামী নিরালম্ব ৫ই অগ্রহায়ণ আশ্রম চান্না—পেরেক ঠুকে ঠুকে শব্দগুলি লেখা। যতীন্দ্রনাথের সন্ন্যাসী জীবনের পরিচয় স্বামী নিরালম্ব। জন্মতারিখ ৫ অগ্রহায়ণ ১২৮৪। দিনটি স্বয়ং তিনিই খোদাই করে রেখেছেন।
কেঁপে উঠল সন্ন্যাসীর ঠোঁট, ‘এই কথা আজ অরবিন্দ স্বীকার করবেন না, আমিই তাঁকে রাজনীতিতে অবতরণ করিয়েছিলাম।’ দু’জনের মুখেই কোনও কথা নেই কিছুক্ষণ। ঝিঁঝির ডাক অরণ্যের রোদনের ন্যায় ধ্বনিত হতে লাগল। খড়ি নদী নিস্তব্ধ। জলে স্রোত নেই। সাঁওতালদের গ্রামে দূর থেকে কোনও দুগ্ধাবলম্বী শিশুর কান্নার ক্ষীণ শব্দ এসে প্রকৃতিকে মোহময়ী রূপে সাজিয়ে তুলেছে। বিপ্লব প্রত্যাশী সন্ন্যাসীর দিকে নিবিষ্ট মনে চেয়ে রয়েছেন ভূপেন্দ্রনাথ। ক্ষোভ-অন্তর্দাহ কবেই অন্তর্হিত।
‘আমি তিলকের কাছে ভারতবর্ষে কংগ্রেস রাজনীতির কথা শুনতাম, বরোদায় গিয়ে অরবিন্দকে বিচার বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে সব বলতাম। স্বভাবসিদ্ধ ধীর-স্থির ভঙ্গিতে তিনি সব শুনে বলতেন—‘তাই নাকি? এমনটাও হয় তবে?...’
অন্তরাত্মায় অবগাহন করে যতীন্দ্রনাথ সংগ্রহ করে আনতে লাগলেন একের পর এক ইতিহাসের স্মৃতিচিহ্ন। সত্যসন্ধানী ভূপেন্দ্রনাথ মন প্রাণ দিয়ে সব শুনতে লাগলেন। অগ্নিযুগের গোড়ার কথা। মন্দ্রিত হতে লাগল অরণ্যের লতায় পাতায় আর সেই ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে থাকা বটবৃক্ষে!