শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহ বৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে ... বিশদ
‘যাস না, আমি বারণ করছি। ভালো হবে না বলে দিচ্ছি ...’ ষণ্ডা লোকটির হুঙ্কার শোনা যায়।
‘যাব, আমি ভোট দিতে যাবই...’ মহিলা পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যান।
ষণ্ডামার্কা লোকটা আবার পথ আটকায়। মহিলার হাত টেনে ধরে, ‘যাসনি বলচি...এর ফল কিন্তু ভালো হবে না...সামলাতে পারবি তো!’
মহিলা হাত ছাড়িয়ে এগিয়ে যান, ‘যা পারিস করে নিস। দেখা যাবে। আমার ভোট আমি দেবই।’
তখনও থ্রেট চলে, ‘ঠিক আছে দেখা যাবে। ভালো করছিস না!’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ যা পারিস করে নিস...’ বলে মহিলাটি বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে গেলেন।
এই ছবি গত বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে বিহারের বিধানসভা ভোটের সময় বিদ্যুতিন মাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল দ্রুত। মহিলাটির এই ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের দিকে সটান এগিয়ে যাওয়ার ছবিটা যেন ভারতের মানচিত্রের রেখা ধরে ধরে উড়ে উড়ে চলেছে।
***
অ্যানি বেসান্ত গাড়ি থেকে নামলেন। শাড়ির উপর কাশ্মীরি কাজের শাল নিয়েছেন জড়িয়ে। অবলা বসু নামলেন গাড়ির উল্টো দিকের দরজা দিয়ে। শাড়ির উপর হাঁটু অবধি ঝুলের কোট পরেছেন তিনি। কোটের হাতার প্লিটে ও শেষ প্রান্ত জুড়ে আছে ফুল-লতা-পাতার নকশা। সেপ্টেম্বর মাসের সকাল। দিল্লিতে বেশ ঠান্ডা পড়ে গিয়েছে। ১৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯১৭। এক্ষুনি এসে পড়বেন মার্গারেট ই কাজিন্স, উমা নেহরু, রমাবাঈ রানাডে, ডরোথি জিনারাজদাসা— সবাই মিলে ভারতের ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড চেমসফোর্ডের অফিসের সামনে। কাউন্সিল হাউসের সামনে জড়ো হচ্ছেন ভারতবর্ষের অগ্রণী মহিলাদের প্রতিনিধিরা। এডুইন মন্টেগু, সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ইন্ডিয়া এসেছেন ভারতবর্ষে। তিনি এবং লর্ড চেমসফোর্ড তৈরি করেছেন একটা কমিশন। কমিশন বিভিন্ন অবস্থানের মানুষের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলছে। ভারতবাসীর জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতা কতখানি দেওয়া যায় তার নীতি নির্ধারণ করাই এই কমিশনের উদ্দেশ্য। তবে, আজ ওঁরা দু’জনেই দেশের অন্য কোনও রেসিডেন্সে গিয়েছেন। এখানে নেই। রয়েছেন কমিশনের অন্য প্রতিনিধিরা। তাঁদের কাছেই রাখবেন নিজেদের দাবি ভারতবর্ষের মহিলারা— অ্যানি বেসান্ত ও লেডি বসুর নেতৃত্বে।
লেডি বসু। অবলা বসু। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর স্ত্রী। ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা, যিনি ডাক্তারি পড়তে গিয়েছিলেন মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজে। কলকাতায় তখনও মহিলাদের ডাক্তারি পড়া শুরুই হয়নি। ১৮৮৫ সালে অবলা বসু মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজ থেকে প্রথম মহিলা এলএমএস পাশ করেন। অসুস্থ হচ্ছিলেন বারবার মাদ্রাজের আবহাওয়ায়। একা থাকছিলেন। অসুস্থতার কারনে ফাইনাল পরীক্ষা না দিয়ে ফিরে আসেন ১৮৮৬ সালে। ১৮৮৭ সালের ২৮ জানুয়ারি বিয়ে হয় বিজ্ঞানী অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে। ‘মিড ওয়াইফার’ পরীক্ষায় ভারতলক্ষ্মী স্বর্ণপদক পাওয়া অবলা ডাক্তারির শেষ পরীক্ষা দিতে পারেননি। পড়া ছেড়ে চলে আসেন জগদীশচন্দ্র বসুর গবেষণায় নেপথ্য-শক্তি হিসাবে। জগদীশচন্দ্রের সে এক অসম্ভব লড়াইয়ে নীরব সেনানি অবলাকে ত্যাগ তিতিক্ষার প্রতীক রূপে দেখা গেল দেশে-বিদেশে স্বামীর পাশটিতে। বহুবার বিদেশ সফর এবং পৃথিবীর বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের সঙ্গে মত বিনিময় ও মেলামেশার ফলে অবলা যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে নিজেকে তৈরি করে তুলেছেন। বঙ্গে মহিলাদের অবস্থা ও অবস্থান নিয়ে তিনি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। ওয়াকিবহাল বিশ্বের নারী আন্দোলন তথা নারী জাগরণ সম্বন্ধেও। মহিলাদের শিক্ষা ও স্বনির্ভরতা নিয়ে তিনি তখন কাজ করছেন কলকাতায়। সঙ্গে তাঁর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির বিদুষীরা। বিশেষ করে সরলা দেবী চৌধুরানি। এগিয়ে এসেছেন কামিনী রায়, মৃণালিনী সেন, কুমুদিনী বসু, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বঙ্গ সমাজের শিক্ষিত মহিলারা।
অ্যানি বেসান্তের বয়স সত্তর হলেও সুঠাম তাঁর শরীর। সটান ঋজু তাঁর দাঁড়াবার ভঙ্গি। ক’দিন আগেই কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে তাঁকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। তখনই অ্যানি বেসান্ত আলোচনায় বসেন কলকাতায় লেডি বসু, সরলা রায়, সরলা দেবী সহ শহরের প্রগতিশীল মহিলাদের সঙ্গে। বঙ্গীয় নারী সমাজ তৈরি হয়েছে অবলা বসুর নেতৃত্বে। ব্রাহ্ম মহিলা বিদ্যালয়ে শুরু হয়েছে স্ত্রী শিক্ষা। মহিলাদের শিক্ষার প্রসার নিয়ে অবলা বসুর অনেক ভাবনা রয়েছে। মহিলাদের অধিকার নিয়ে রোকেয়া একের পর এক প্রবন্ধ লিখছেন। কথা হচ্ছে নারী শিক্ষা সমিতি তৈরি করার। মহিলাদের শিক্ষা প্রসারের বীজ বপন করে দিয়ে গিয়েছেন সিস্টার নিবেদিতা। লেডি বসুর সঙ্গে নিবেদিতার রোজকার আলোচনা ও কাজ। জগদীশচন্দ্র বসুর কাজের ও সংগ্রামে নিবেদিতার সর্বশক্তি নিয়ে উপস্থিতি সর্বজনবিদিত। এমনকী, ১৯১১ সালে নিবেদিতার মৃত্যুর সময়ও পাশে ছিলেন তাঁর পরম বন্ধু অবলা বসু ও জগদীশচন্দ্র বসু। আয়ারল্যান্ড থেকে এসেছিলেন নিবেদিতা তথা মার্গারেট নোবেল— ভারতবর্ষের নারী জাগরণের পুরোধা।
অবলা এগিয়ে গেলেন আয়ারল্যান্ডের নারী আন্দোলনের নেত্রী মার্গারেট এলিজাবেথ কাজিন্সের দিকে। ঊনচল্লিশ বছরের কাজিন্স খটখটে মহিলা। সম্পাদনা করছেন ‘Stri Dharma’ নামে মহিলাদের পত্রিকা পুনে থেকে। ভারতে এসেছেন এই আইরিশ নেত্রী মাত্র দু’বছর আগে ১৯১৫ সালে। ১৯১২ সালে আইরিশ কবি ডব্লু বি ইয়েটসের কাছে প্রথম রবীন্দ্রনাথের কবিতার সঙ্গে পরিচয় এবং ভারতবর্ষের সঙ্গে সাক্ষাৎ। ব্রিটেনে মহিলাদের ভোটাধিকারের আন্দোলনের এই নেত্রী গ্রেপ্তার হন ১৯১৩ সালে। তারপর জেল মুক্তি। অ্যানি বেসান্তের খবরের কাগজে চাকরি করেন মার্গারেটের স্বামী জেমস কাজিন্স। ১৯১৫ সালে অ্যানি বেসান্তের কথায় ভারতবর্ষে আসেন। ১৯১৭ সালে অ্যানি বেসান্তের সঙ্গে গঠন করলেন সর্বভারতীয় মহিলা সমিতি।
অবলা এগিয়ে গিয়ে নমস্কার বিনিময় করেন কাজিন্সের সঙ্গে। মহিলাদের ভোটাধিকার নিয়ে লড়াইয়ের অগ্রণী নেত্রী। কাজিন্সের দেশ আয়ারল্যান্ডে কিন্তু ইউরোপের অন্য দেশগুলির তুলনায় অনেক পরে ১৯২২ সালে মহিলাদের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, যা শুরু হয়েছে ১৯১৪ সালে। যার প্রভাব বিশ্ব রাজনীতির মানচিত্র পাল্টে দিচ্ছে। এই আবহাওয়ায় যুদ্ধক্ষেত্রে, কলকারখানায় ও সমাজে মহিলাদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা সুপ্রতিষ্ঠিত করে মহিলাদের সমানাধিকার ও ভোটাধিকারের বিষয়টি। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আন্দোলন শুরু হয় মহিলাদের নেতৃত্বে। ব্রিটেনে ও জার্মানিতে মহিলাদের এই দাবি মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে আলাপ আলোচনা চলছে। আমরা দেখব, ব্রিটেন ও জার্মানি মহিলাদের এই দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় ১৯১৮ সালে। তার ঠিক এক বছর আগে ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে যখন অ্যানি বেসান্ত, কাজিন্স, লেডি বসুদের নেতৃত্বে মহিলারা দিল্লির ভাইসরয়ের অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে, ঠিক সেই সময়ই ওই একই দাবি অর্থাৎ মহিলাদের ভোটাধিকার কানাডায় সরকারের স্বীকৃতি পেল। অ্যানি বেসান্তের হাত জড়িয়ে মার্গারেট কাজিন্স বললেন, ‘কানাডার মেয়েরা জিতেছে, খবরটা নিশ্চয়ই তোমার কাছে এসেছে।’
অ্যানি বেসান্তের মুখে প্রশস্তির হাসি, ‘হ্যাঁ, ব্রিটেন ও জার্মানিও ভাবছে। চলো ভারতবর্ষে বাস্তবায়িত করার পথে এগই। তবে ভারতবর্ষের পরাধীনতা মহিলাদের ভোটাধিকারের ক্ষেত্রে একটা বাধা হতে পারে। চলো আমরা বোধহয় সঠিক সময়ে উপস্থিত হয়েছি।’
কাজিন্স তাকালেন ডরোথি জিনারাজদাসার দিকে। হাত বাড়িয়ে দিলেন রোকেয়ার দিকে, ‘নারীদের অধিকার নিয়ে সম্প্রতি আপনার লেখা প্রবন্ধ তো ঢেউ তুলেছে। আমাদের স্ত্রী ধর্ম পত্রিকায় একটা লেখা দিন।’ রোকেয়া ঘাড় নাড়েন, ‘মাই প্লেজার!’ রমাবাঈ, উমা রানাডে সবাই একে অপরকে নমস্কার বিনিময় করে এগিয়ে চললেন ভাইসরয়ের অফিসের দিকে— মহিলাদের ভোটাধিকার নিয়ে দাবি জানাতে। ভাইসরয়ের অফিসের উপরে তখন ইউনিয়ন জ্যাক। হাওয়া কম। নড়ছিল কম।
১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯১৭ অ্যানি বেসান্তের নেতৃত্বে ভারতবর্ষের মহিলা প্রতিনিধির দলটি দুপুরের দিকে সন্তুষ্টচিত্তে বেরিয়ে এলেন ভাইসরয়ের অফিস থেকে। যথেষ্ট যুক্তি ও তথ্য দিয়ে মন্টেগু-চেমসফোর্ড কমিশনের প্রতিনিধিদের বোঝাতে পেরেছেন ভারতীয় মহিলাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষমতা দেওয়ার ও রাজনীতিতে সরাসরি অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা। ১৯১৮ সালের ২৪ মে ও ৭ জুন দু’দিন যখন কমিশন রিপোর্ট পেশ করল ব্রিটিশ ক্যাবিনেটে, তখন সবাই দেখল যে, ভারতীয় মহিলাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ ও রাজনীতিতে অংশগ্রহণের বিষয়টি প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। অ্যানি বেসান্তরা গেলেন জয়েন্ট সিলেক্ট কন্ট্রোলার অব হাউস অব লর্ডস ও হাউস অব কমনসের কাছে। জানালেন দাবি। ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে তখন মহিলাদের ভোটাধিকার চালু হয়েছে। গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট, ১৯১৯-এ প্রথম উল্লেখ হল ভারতীয় মহিলাদের ভোটাধিকারের কথা। ভোট দিতে পারবেন মহিলারা, কিন্তু এই অধিকার নির্ণয় হবে শিক্ষা, সম্পত্তি ও অর্থনৈতিক অবস্থানের উপর।
***
প্যারা মিলিটারি ফোর্স নিয়ে যেতে চাইছে গ্রামের মেয়েদের ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের দিকে। মেয়ে-বউয়েরা চিৎকার করছে, ‘কাইলকে যখন পুলিস থাইকবেক না, তখন মোদের কে বাঁচাইতে আসবে!’ টিভির বুমার ধরেছে এক সালোয়ার-কামিজ, মাথায় ‘কিলিপ’, অষ্টাদশীর রোদপোড়া মুখে। চোখে তার জল। কাঁদছে!
বুমার, ‘আপনার এই বছরেই প্রথম ভোট ছিল, দিতে পেরেছেন?’
ফুঁপিয়ে ওঠে মেয়েটি, ‘ওরা বুথ থেকে বার কইরে দিল...।’ প্রথম অধিকার প্রয়োগের অহঙ্কার তছনছ হয়ে যাওয়ার দুঃখ, ক্ষোভ, হতাশা তার ভ্রমর চোখে।
আমাদের সবার খুব পরিচিত এই ছবিটি বয়ে নিয়ে চলেছে ভারত একবিংশ শতাব্দীতেও।
***
১৯২১ সাল। বাংলা আইন পরিষদের ( Bengal Legislative Council) কক্ষে আস্তে আস্তে নম্র ও ঋজু শ্যামলা কিন্তু বেশভূষাতে আভিজাত্য ও শিক্ষা ছড়িয়ে প্রবেশ করলেন এক মহিলা। গ্যালারিতে মহিলাদের বসার নির্দিষ্ট স্থানটিতে বসেছেন তিনি। লেডি অবলা বসু। জগদীশচন্দ্র বসুর ভাগ্নে এস এম বসু আইন পরিষদের সদস্য। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। একবার তাকিয়ে দেখে নিলেন মামিমার মুখ স্থির। মামিমা লেডি বসু কি আস্তে থুতনিটা নামিয়ে বললেন অস্ফুটে, ‘বলো, শুরু করো। বাংলা তথা ভারতের নারীরা তোমার দিকেই তাকিয়ে আছে! শুরু করো বক্তব্য!’ এস এম বসু শুরু করলেন তাঁর বক্তব্য। রামায়ণ, মহাভারতের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্তমান বিশ্ব মানচিত্রে মহিলাদের অবস্থান সহ ভারতের মহিলাদের রাজনীতিতে প্রবেশের সপক্ষে যুক্তির পর যুক্তি। নিশ্চুপ আইন পরিষদের কক্ষ। আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে ভারতবর্ষের কোনও আইন পরিষদের কক্ষে উত্থাপিত হল মহিলাদের ভোটাধিকার সম্পর্কে আইন তৈরি করার যুক্তিপূর্ণ প্রস্তাব। মার্গারেট কাজিন্স তাঁর ‘The Awekening of Asian Womenhood’ বইতে এই ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন— ‘During the debate on the subject of Women suffrage in the Bengal Legislative Council in 1921 Lady Bose was to be seen each day in the Ladies Gallery, for she is a strong supporter of the movement for the removal of sex disqualification in political affairs... Her nephew, Mr. S.M. Bose, brought forward the suffrage Resolution in the Bengal Council...’ ভোটাভুটি হয় এই প্রস্তাবের পক্ষে ও বিপক্ষে। এস এম বসুর আনা মহিলাদের ভোটাধিকার প্রস্তাবটি ভোটে হেরে গেল। অবলা বসু দিনের পর দিন চুপ করে লেডিস গ্যালারিতে বসে এই প্রস্তাব নিয়ে শুনে গিয়েছেন বিতর্ক। পুরুষদের যুক্তির পর যুক্তি মহিলাদের ভোটাধিকার থাকা উচিত কি উচিত নয়। সে বিতর্কে কোনও মহিলা নেই! পুরুষরাই ভোট দিল বিপক্ষে। চুপচাপ চোয়াল শক্ত করে বেরিয়ে এলেন কক্ষ থেকে অবলা। আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে বাংলার ঘরে ঘরে, পথে পথে। ১৯২১ সালেই বাংলায় শুরু হল মহিলাদের ভোটাধিকারের আন্দোলন অবলা বসুর নেতৃত্বে বঙ্গীয় নারী সমাজ সংগঠনের মাধ্যমে। একশো বছর আগে বাংলার শিক্ষিত অগ্রণী মহিলাদের আন্দোলন ছিল ঐতিহাসিক এক দাবিকে কেন্দ্র করে। ভোটাধিকার প্রয়োগ ও মহিলাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অধিকারের লড়াই শুরু হল। কামিনী রায়, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, সরলা দেবীদের মতো লেখিকাদের পাশাপাশি ব্রাহ্ম মহিলারা যেমন এগিয়ে এসেছেন এই আন্দোলনে, তেমনই তাঁদের পাশে থেকেছেন রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, অধ্যাপক মহলানবীশ প্রমুখ বাংলার প্রথিতযশা মানুষজন। সামাজিক আন্দোলনের নেতৃত্বে ‘বঙ্গীয় নারী সমাজ’। এই সামাজিক আন্দোলনের ছবি আমাদের কাছে তত বেশি আলোচিত হয়নি একশো বছর পরেও। কিন্তু এই আন্দোলনের ফলে ১৯২৩ সালে মহিলাদের ভোটদানের অধিকার আইনত লিখিত হল ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যালিটি অ্যাক্ট, ১৯২৩- বেঙ্গল অ্যাক্ট, ১৯২৩-এ। কলকাতা মিউনিসিপ্যালিটির ইলেকশন প্রথম অনুষ্ঠিত হয় ১৬ এপ্রিল, ১৯২৪-এ। সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে মহিলাদের ভোটাধিকার ও রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অধিকার সূচিত হল। এই নির্বাচনেই দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ হলেন কলকাতার প্রথম ভারতীয় মেয়র। আর মহিলাদের সামাজিক অধিকার অর্জনের একটা মাইল ফলক হয়ে রইল বাংলার সামাজিক উত্থানের উঠোনে। ১৯২১ সালে কলকাতার আইন পরিষদে উত্থাপিত একটি প্রস্তাব একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় প্রশাসনে আইনি স্বীকৃতি পেল। এই ১৯২১ সালেই ভারতবর্ষের ইতিহাসে প্রথম মহিলাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ আইনত স্বীকৃতি পায় মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে। মাদ্রাজ সিটি কর্পোরেশনের ১৯২১ সালের নির্বাচনে ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা অংশগ্রহণকারিণীর নাম এম সি দেবাদস। অ্যানি বেসান্ত, অবলা বসু, উমা রানাডে, মার্গারেট কাজিন্স প্রমুখ মহিলাদের এই আন্দোলনে পাশে থেকেছেন মহাত্মা গান্ধী সহ জাতীয় নেতৃত্ব। সামাজিক পরিবর্তনের এই গভীর চেতনা সম্পন্ন জয়কে একশো বছর পরে আর কতটা মান্যতা দিচ্ছি এবং কতটা স্মরণে রাখছি, এইটাই আজকে বড় প্রশ্ন একবিংশ শতাব্দীতে। আজ পশ্চিমবঙ্গের মোট ভোটারের প্রায় ৪৯ শতাংশ মহিলা ভোটার। আজও মহিলারা তাঁদের অধিকারগুলির সুরক্ষার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। সারা বিশ্বজুড়ে দেখা যাচ্ছে রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মহিলারা। দেশ তথা রাজ্য বা স্থানীয় শাসন ব্যবস্থার শীর্ষস্থানে মানুষ মহিলাদের ভোটদানের মাধ্যমে নির্বাচিত করছেন। রাজনৈতিক দলের শীর্ষে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মহিলারা। এটাও যেমন সত্য, তেমনই সত্য রান্নাঘরের কোণে জমে থাকা চাপ চাপ আতঙ্ক ও কান্নার দাগ।
বিডিও সাহেবের কোয়ার্টারের বাইরেই বিরাট নিমগাছ দাঁড়িয়ে আছে। ভোরবেলা দাঁতব্রাশ করতে বেরিয়ে নজরে পড়ে বিডিও সাহেবের নিমগাছের গোড়ায় কে যেন বসে। আলো এখনও তেমন ফোটেনি। জেলায় মিটিং আছে। বেরনোর আগে কিছু কাজ আছে। কিন্তু নিমগাছের গোড়ায়! এগিয়ে গেলেন তিনি। মেয়েটি উঠে দাঁড়ায় ধড়মড় করে। বসেছিল গাছের গোড়ায় শিকড়ের উপর। আরও এগতেই দৌড়ে আসে বিডিওর কাছে। পায়ে পড়ে, ‘আমোক বাঁচান ছাড়, মুঁই ভোইটে দাঁড়াবক নাই, আমাকে উঁরা...।’ কান্নায় ভেঙে পড়ে। পাশের জয়েন্ট সাহেবের কোয়ার্টারে কেউ ওঠেনি তখনও। ‘কে তুই?’ প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেন বিডিও।
‘সোমা সোরেন। নমিনি দিছিলাম...ভোইটে দাঁড়ামু নাই...উঁরা মাইরে ফেলবে...’ কাঁপছে মেয়েটি। কালো হরিণ চোখে ছিন্নভিন্ন হবার চূড়ান্ত ভয়।
‘আমোক এট্টা কাগজ লিখি দ্যান। মুঁই ভোইট দাঁড়াবক নাই। লইলে মাইরে ফেইলবে...’
অ্যানি বেসান্ত, অবলা বসু, রোকেয়া সাখাওয়াত, কামিনী রায়, সরলা দেবী ওই ওই এক ঝাঁক মহিলা হেঁটে চলেছেন ভারতবর্ষের মানচিত্রের রেখায় রেখায়। তাদের লুটোনো আঁচলে এখনও মুছে নিচ্ছে চোখের জল ভারতের কোণে কোণে মহিলারা, তাদের অধিকার অর্জনের শতবর্ষ পরেও। তাই নিঃশব্দে চলে যায় একটি সামাজিক অধিকার অর্জনের শতবর্ষ।
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : অভিষেক গোস্বামী