শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহ বৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে ... বিশদ
যবনিকা সরে যায়। আড়াইশো বছরেরও অধিক কালের বঙ্গভূমি। অতীতের পৃষ্ঠা থেকে ভেসে আসে এক ছবি।
নদীতীরবর্তী এক শ্মশানে মহাসমারোহে চলছে সতীদাহের উৎসব। সহমরণের পবিত্র সনাতনী রীতি মেনে এক তরুণী বধূর অগ্নিদাহ। ঢাকঢোল সহকারে উদ্দাম নৃত্য, উত্তাল জনতার চিৎকৃত উল্লাস— সেই মহাসমারোহে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে তরুণী বধূর আর্ত ক্রন্দন ধ্বনি। বাঁচার তীব্র আকাঙ্খায় জলন্ত চিতা থেকে ঝাঁপ দিয়েও ব্যর্থ হয় বাঁচার চেষ্টা। তার হাত-পা বেঁধে মৃত স্বামীর জলন্ত চিতায় তাঁকে সহমৃতা করার আদিম উল্লাসে পরিবেশ মুখরিত।
সেকালের বঙ্গসমাজে এ এক অতি পরিচিত দৃশ্যপট! সতীর জয়ধ্বনিতে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। কোনও প্রতিবাদ নয়, সতী রমণীর অক্ষয় স্বর্গবাস অভিমুখে যাত্রাকে সকলেই পরম পুণ্য বলে মেনে নিয়েছে।
সেই প্রচলিত কুসংস্কার ও রীতির বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন এক সম্ভ্রান্ত অভিজাত তরুণ। তিনি খবর পেয়েছেন তাঁর দাদার মৃত্যুতে তাঁর বউদিকেও জীবন্ত দাহ করার প্রস্তুতি চলেছে, জান্তব উল্লাসে শ্মশানে সমাগত সমাজপতি সহ জনগণ মিলেছে মারণ উৎসবে, যার পোশাকি নাম সতীদাহ বা সহমরণ।
এই নিষ্ঠুর বীভৎস দৃশ্য দেখে বিচলিত, প্রতিকারহীন শক্তের অসহায়তায় ক্ষুব্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজপতিদের বিধানে ক্রূদ্ধ সেই যুবকের নাম রামমোহন রায়। রবীন্দ্রনাথ যাঁকে বলেছেন,‘নব্য ভারতের চিত্তদূত’।
আজ থেকে আড়াইশো বছর আগে হুগলি জেলার রাধানগরে অভিজাত ধনী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মেছিলেন বাংলার নবজাগরণের প্রধান রূপকার রাজা রামমোহন রায়। জ্যেষ্ঠভ্রাতা জগমোহন রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী অলোকমণি দেবীর সতী হওয়ার সংবাদ পেয়ে রংপুর থেকে ছুটে এসেছিলেন রামমোহন। কিন্তু তার আগেই সুসম্পন্ন হয়েছে পুণ্য সতীদাহ পর্ব!
রামমোহনের অন্তর আত্মায় বিদ্ধ হয়ে আগুন জ্বলে উঠল। সেই অগ্নিকে সাক্ষী রেখে তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন নিজের কাছেই। সহমরণ প্রথা নিষিদ্ধ ও বন্ধ করাই হল তাঁর প্রধান কর্তব্য।
সেই পথ ধরেই পঞ্চাশ বছর পরে আর এক তেজস্বী ব্রাহ্মণ তনয় ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় অসহায় হিন্দু বিধবা নারীর পুনর্বিবাহ প্রচলনের জন্য আমরণ সংগ্রাম ও আন্দোলন করেছিলেন। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে উনিশ শতকের প্রথমার্ধ এই দুই তেজস্বী মহামণীষীর আবির্ভাবে সূচিত হয়েছিল বাংলার রেনেসাঁ বা নবজাগরণ।
সেই নবজাগরণের মূল স্থপতি রাজা রামমোহন রায়। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে (মতান্তরে ১৭৭৪) যাঁর জন্ম। হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামের রামকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিনি দ্বিতীয় পুত্র। তাঁর প্রপিতামহ ছিলেন মুর্শিদাবাদের নবাব সরকারের উচ্চপদস্থ আধিকারিক। নবাবের কাছ থেকে পাওয়া খেতাব ‘রায়’ তাঁরা পদবি হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেন।
পলাশির যুদ্ধ পরবর্তী সেই সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে দেশের শাসন ভার। সারা দেশে অরাজকতা। তখন ধনী পরিবারের সন্তানেরা সংস্কৃতের সঙ্গে আরবি, ফারসি ভাষা ও সাহিত্যে শিক্ষা লাভ করতেন। রামমোহন মূল কোরান, আরবি-ফারসি সাহিত্য পাঠের ফলে ‘একেশ্বরবাদ’ ও উদার মানবতা বিষয়ে জ্ঞানলাভ করেন। প্রচলিত সনাতনী ধর্মীয় সংস্কার বিরোধিতার ফলে পিতার বিরাগভাজন হয়ে মাত্র পনেরো বছর বয়সে গৃহত্যাগ করেন। চার পর পরে আবার পিতৃগৃহে ফেরেন ও কাশীতে গিয়ে হিন্দু শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন।
পিতার মৃত্যুর পরে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রভূত সম্পত্তি লাভ করেন এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরি সূত্রে অতি সম্পদশালী হন। এখানে জন বিগবির সঙ্গে বন্ধুত্বের ফলে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে দক্ষ এবং ইউরোপের রাজনীতিতে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন তিনি। ফলে অতি নবীন বয়সে সংস্কৃত, আরবি, ফারসি ও ইংরেজি ভাষা আয়ত্ত করেন। বিভিন্ন ভাষার সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের পাঠ নেন— গীতা, বাইবেল ও কোরান তাঁর অধিগত হয়।
এরপর নবজাগরণের যাত্রাপথে তাঁর পদার্পণ কলকাতায়। সেটা ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দ। সেখানে সমমনস্ক বন্ধুদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আত্মীয় সভা’। সেখানে যুক্তিবাদ ও একেশ্বরবাদের চর্চা হতে থাকে। এই সময়েই প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত রচনা ‘বেদান্ত গ্রন্থ’, যেটিকে বঙ্গীয় নবজাগরণের উৎস মনে করা হয়।
ধর্ম সম্বন্ধে রামমোহনের নিজস্ব চিন্তাধারা ছিল আধুনিক। ইহজীবনের উৎকর্ষ সাধনকেই তিনি ধর্ম মনে করতেন, পরকাল সর্বস্বতা নয়। তাই সাধারণভাবে মনে করা হয়— মানুষ যখন পরকালের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ইহকালের দিকে তাকিয়েছিল, তখনই যথার্থ নবজাগরণের সূচনা। এই জীবনমুখী চেতনার প্রচার ও প্রসার ঘটালেন রামমোহন। সেই সঙ্গে বেদান্ত মতে বিচার করে একেশ্বরবাদের শ্রেষ্ঠত্ব ও পৌত্তলিকতার অসাড়তা প্রমাণ করেন।
ইতিমধ্যে নিজের মত প্রচারের জন্য আরবি, ফারসিতে রচনা করেছেন ‘তুহফাতুন মুয়াহদ্দিন’ (একেশ্বরবাদীদের জন্য উপহার), সংস্কৃতে রচনা করেছেন ‘বেদান্ত সার’ এবং ইংরেজিতে লিখে ফেলেছেন ‘এন আপিল টু খ্রিশ্চান কমিউনিটি’ (খ্রিস্টান সমাজের প্রতি আবেদন)।
ধর্মতত্ত্ব প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক শিক্ষা বিস্তারে ছিল তাঁর আগ্রহ। তাঁর আত্মীয় সভাতে আসতেন ডেভিড হেয়ার, দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং ভূকৈলাস ও পাইকপাড়ার রাজারা। এখান থেকেই আসে আধুনিক শিক্ষার জন্য কলেজ স্থাপনের চিন্তা। প্রধানত ডেভিড হেয়ারের এই প্রস্তাবে উৎসাহী হয়ে সর্বপ্রকার সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন রামমোহন। কিন্তু তৎকালীন গোঁড়া হিন্দু সমাজপতিরা ‘নাস্তিক’, ‘ধর্মদ্রোহী’ রামমোহনকে সেই উদ্যোগে শামিল হতে দিলেন না। রাধাকান্ত দেব প্রমুখেরা বিদেশিদের চাঁদা নিলেন, কিন্তু রামমোহনকে সেই কলেজ কমিটিতে স্থান দিলেন না। শিক্ষার স্বার্থে, জাতির স্বার্থে, দেশের স্বার্থে রামমোহন নিজেই সরে দাঁড়ালেন। তাঁকে বাদ দিয়েই গড়ে উঠল তাঁর সাধের বিদ্যানিকেতন, স্বপ্নের কলেজ— সেদিনের হিন্দু কলেজ আজকের প্রেসিডেন্সি কলেজ।
কিন্তু তাঁর কর্মযোগ থেমে থাকেনি। নিজের একটি স্কুল খোলেন— অ্যাংলো হিন্দু স্কুল। সেই স্কুলের ছাত্র ছিলেন তাঁর নিজের ছেলে রমাপ্রসাদ, দ্বারকানাথ ঠাকুরের ছেলে দেবেন্দ্রনাথ ও রাজনারায়ণ বসু। সেখানে শিক্ষার মধ্যে এল সর্বধর্মসমন্বয়— হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের মিলন। এখানেই তাঁর শিক্ষা বিস্তারের উদ্যোগ থামল না। কলকাতার চার্চ অব স্কটল্যান্ডের প্রধান বিশপের সঙ্গে আলোচনা করে স্কটল্যান্ড থেকে এ দেশে আনলেন ডাফ সাহেবকে। ডাফ সাহেবের সেই স্কুল পরিণত হল আজকের স্কটিশ চার্চ কলেজে।
শুধু কলেজ বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই নয়, তাঁর মতবাদ ও স্বাধীন চিন্তার প্রকাশ ঘটাতে সংবাদপত্র প্রকাশ করলেন— ফারসিতে ‘মিরাৎ-উল-আখবার’ ও বাংলায় ‘সম্বাদ কৌমুদী’। এখানে তাঁর চিন্তাশীল প্রবন্ধ প্রকাশিত হতো এবং এখানেই বাংলা গদ্য ভাষাকে তিনি দিলেন আভিজাত্য। তিনি সাহিত্যিক ছিলেন না, ছিলেন সমাজ সংস্কারক। বাংলা গদ্যকে রামমোহন দিলেন তাঁর স্বীকৃত মর্যাদা। যা পরে বিদ্যাসাগরের হাতে পেল পূর্ণতা। যুক্তিপূর্ণ ভাষার মাধ্যমে তিনি নিজের মতকে প্রচার করলেন। পাঠ্য পুস্তকের বাইরে নিয়ে এলেন বাংলা গদ্যকে। সমালোচক গোপাল হালদার বলেছেন, ‘রামমোহনের ভাষা ছিল কর্মীপুরুষের ভাষা। একজন তাত্ত্বিকের ভাষা, সেভাষা ভাবুকের ভাষা নয়, শিল্প রসিকের ভাষা নয়— প্রাঞ্জল কিন্তু সরস নয়।’ তাঁর বিখ্যাত গদ্যগ্রন্থ ‘বেদান্ত’ (১৮১৫), ‘বেদান্ত সার’ (১৮১৫), ‘ভট্টাচার্যের সহিত বিচার’ (১৮১৭), ‘সহমরণ বিরোধী প্রস্তাব’ (১৮১৭)।
নিজের ধর্মের কুসংস্কার ও গোঁড়ামি মেনে নিতে পারেননি তাই প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ব্রাহ্মসমাজ’, ১৮২৮ সালের ২০ আগস্ট। ঔপনিষদিক হিন্দু ধর্মকে এক নতুন সমন্বয়ী রূপে উজ্জীবিত করলেন। হিন্দুর বেদান্ত, সুফিদের অদ্বৈতবাদ ও ইউরোপীয় বস্তুনিষ্ঠ ভাবধারা মিলে গড়ে উঠেছিল তাঁর ধর্মাদর্শ।
তিনি মনোধর্মে ছিলেন আন্তর্জাতিক। তাই শুধু স্বদেশের উন্নয়নেই নিয়োজিত ছিলেন না, বহির্বিশ্বের কর্মযজ্ঞেও তাঁর উৎসাহ ছিল সমান। আয়ারল্যান্ডের দুর্ভিক্ষে তিনি রিলিফ ফান্ড খুলেছিলেন, অস্ট্রিয়ার আক্রমণে ইতালির স্বাধীনতা লোপে তিনি তীব্র ভাষায় ধিক্কার জানিয়েছিলেন। অন্যদিকে ফরাসি বিপ্লবের সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন।
বিদেশিদের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব থাকলেও আত্মমর্যাদাবোধ ছিল প্রখর। তাই প্রয়োজনে তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদীও হয়ে উঠতেন। আমরা বিদ্যাসাগর ও কার সাহেবের সাক্ষাৎকারের বহু আলোচিত ঘটনা জানি— যেখানে টেবিলে জুতো পরা পা তুলে বসা কার সাহেবকে বিদ্যাসাগর একইভাবে চটি পরে টেবিলে পা তুলে বসে বুঝিয়েছিলেন, ভারতীয়রাও প্রতিবাদ করতে জানে।
রামমোহনের ঘটনাটি ইষৎ অনালোচিত। ভাগলপুরের কালেক্টর হ্যামিলটন ছিলেন প্রবল নেটিভ বিরোধী। একদিন রামমোহন পাল্কি চেপে যাওয়ার সময় লক্ষ করেননি সেই পথের একধারে দাঁড়িয়ে আছেন হ্যামিলটন সাহেব। তাঁকে সেলাম না করে কালা আদমি পাল্কি চেপে যাওয়ায় তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে পাল্কির কাছে এসে অকথ্য ভাষায় রামমোহনকে গালিগালাজ শুরু করেন। রামমোহন ভদ্রভাবে জানান যে, তিনি সাহেবকে দেখতে পাননি, তাই নিয়মমাফিক সম্মান জানাতে পারেননি। হ্যামিলটন সে কথায় কর্ণপাত না করে তীব্র ভাষায় তিরস্কার করেন। এত বড় অপমান রামমোহন সহ্য করেননি। তিনি গভর্নর জেনারেল লর্ড মিন্টোর কাছে এই অপমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কড়া চিঠি পাঠান। তার ফলে শেষ পর্যন্ত গভর্নরের নির্দেশে হ্যামিলটনকে নিজের ভুল স্বীকার করতে হয়। এই আপোসবিহীন নির্ভীক ব্যক্তিত্বের নাম রামমোহন রায়।
বহু বিচিত্র প্রতিভাশালী ও প্রবল কর্মযোগী ছিলেন রামমোহন। তাঁর গদ্য ভাষার ওজস্বিতা, শিক্ষা প্রসারে উৎসাহ, ধর্ম মোহ থেকে একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠা, ব্রাহ্ম সমাজ স্থাপন, নির্ভীক মনস্বিতা ও চারিত্রিক প্রখরতার চেয়েও সর্বসাধারণের কাছে তাঁর প্রথম ও প্রধান পরিচয় সতীদাহ বন্ধের প্রধান কারিগর রূপে। আজও এই আড়াইশো বছর অতিক্রান্ত বর্তমান সময়েও তাঁর সর্বাধিক পরিচিতি সতীদাহ বিরোধী এক ব্যক্তিত্ব রূপে।
প্রাচীনকালে নারীর সতীত্ব প্রমাণের জন্য যখন অগ্নিপরীক্ষা ছিল প্রচলিত, তখন রামমোহন নারীকে সেই বহ্নিমান চিতাশয্যা থেকে তুলে এনে দিয়েছিলেন নবজীবনে প্রতিষ্ঠা। হিন্দু নারীদের এই নিষ্ঠুর অনুশাসনের কথা পরবর্তীকালের সাহিত্যে ছায়া ফেলে গিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘মহামায়া’ গল্পে সহমরণের বীভৎস প্রথার কথা এনেছেন। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘সহমরণ’ কবিতায় শুনেছি বৃদ্ধ স্বামীর চিতা শয্যা থেকে পালিয়ে বাঁচা অর্ধদগ্ধ কন্যার বেদনার কথা—
‘কুলীন পিতা কুলের গোলে
ফেলে দিলেন বুড়োর গলে।’
এমন শত শত বালিকা বধূকে সহমরণের অগ্নিশয্যায় জীবন্ত দগ্ধ হতে হয়েছিল। ইতিহাসে সেই চরম কুপ্রথাকে সাহিত্যে রূপ দিয়েছেন কবি ও কথাকাররা। আর রামমোহন সেই প্রথা নির্মূল করে সৃষ্টি করেন নতুন ইতিহাস। যেমনভাবে আরও পঞ্চাশ বছর পরে বিদ্যাসাগর সেই বাল্যবিধবাদের পুনর্বিবাহ দিয়ে নবজীবন দান করেন।
রামমোহনের প্রতিবাদী সত্তা তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল নিজের বউদিকে সতীদাহে জীবন্ত দগ্ধ হতে দেখে। তৎকালীন ইংরেজ শাসকের সহায়তায় তাঁর আন্দোলন শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত লর্ড বেটিঙ্কের নির্দেশে আইন করে সতীদাহ বন্ধ হয়। রামমোহন এক যুগান্তকারী ইতিহাসের স্রষ্টা হয়ে জাতির জীবনে চিরস্মরণীয় হয়ে ওঠেন। ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর সতীদাহ বন্ধের আইন পাশ হয়। কিন্তু সনাতন ধর্মধ্বজীরা এই আইনের বিরোধিতা করে ইংল্যান্ডের প্রিভি কাউন্সিলে আবেদন করেন। ‘নাস্তিক’ রামমোহনের এত বড় জয় তাঁদের কাছে মনে হল ধর্মের পরাজয়।
তাঁদের সেই আবেদন বিফল করার মানসে রামমোহন এবার ইংল্যান্ড যাত্রার প্রস্তুতি নিলেন। সুযোগও এসে গেল। দিল্লির বাদশাহ দ্বিতীয় আকবর তাঁর কিছু ন্যায্য অধিকার দাবি করে ইংল্যান্ডে রাজার কাছে দূত প্রেরণের মনস্থ করেন। তাঁর কাছে এ ব্যাপারে রামমোহনের চেয়ে যোগ্যতর আর কেউ ছিলেন না। তিনি রামমোহনকে ‘রাজা’ উপাধি দিয়ে নিজের দূত করে ইংল্যান্ডে প্রেরণ করেন।
রামমোহন প্রথম ভারতীয় যিনি কালাপানি পেরিয়ে ইংল্যান্ডের মাটিতে পা রাখলেন। ১৮৩০ সালে তাঁর যাত্রা শুরু। এলবিয়ন জাহাজে চড়ে রামমোহন ইউরোপের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলেন। পালিতপুত্র রাজারাম ও দু’জন ভৃত্য তাঁর সহযাত্রী হলেন। জাহাজে করে ইংল্যান্ড যেতে তখন সময় লাগত ছ’মাস। শেষ পর্যন্ত ১৮৩১ সালের ৮ এপ্রিল রামমোহন লিভারপুলে পৌঁছলেন। প্রচুর অভিনন্দন ও অভ্যর্থনা তাঁকে ঘিরে শুরু হল। এই ভারতীয় মণীষী ইংল্যান্ডে পরিচিত ছিলেন তাঁর অসামান্য প্রতিভা ও কর্মোদ্যোগের জন্য। দেশের চেয়ে বিদেশেই তিনি অধিকতর সম্মান ও অভ্যর্থনা পেলেন। লিভারপুল থেকে ম্যাঞ্চেস্টার এবং লন্ডনে তিনি পৌঁছলেন। সারা লন্ডন শহর এই ভারতীয় পুরুষসিংহকে দেখার জন্য প্রবল উৎসাহে ছুটে এল। দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, সাহিত্যিক ও সাধারণ মানুষ এমনকী, সেখানকার কারখানার কুলিমজুররাও তাঁকে জানাল উষ্ণ অভিনন্দন। জাহাজে আসার সময় এক দুর্ঘটনায় তাঁর একটি পা ভেঙে গিয়েছিল, যা শেষদিন পর্যন্ত আর জোড়া লাগেনি। কিন্তু এই ভাঙা পা নিয়েই অদম্য মানসিক শক্তিতে রামমোহন লন্ডনে পৌঁছে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাঁর বহুবিধ কাজের মধ্যে আছে সতীদাহ বিল, বাদশাহ দ্বিতীয় আকবরের প্রদত্ত কাজ, আর সেই সঙ্গে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে রিফর্ম বিল নিয়ে আলোচনা।
ভারতে থাকাকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যে সম্মান তাঁকে দেয়নি, লন্ডনের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তারা তাঁকে সেই সম্মান দিয়েছিলেন। এমনকী, হাউস অব কমন্সে কোম্পানির নতুন সংবিধান চালু করার ব্যাপারে তাঁকে আহ্বান জানানো হল। তাঁর সবচেয়ে আনন্দের বিষয় প্রিভি কাউন্সিলে সতীদাহ বন্ধ করার জন্য তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হল।
কিন্তু রামমোহন আজীবন স্বাধীনতা, মৈত্রী ও বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত। তাই মহাবিপ্লবী দেশ ফ্রান্সে যাওয়া ছিল তাঁর স্বপ্ন। তাই শেষ পর্যন্ত ১৮৩৩ সালে তিনি পৌঁছলেন ফ্রান্সে। সেখানে সোসাইটি এশিয়াটিক অব প্যারিস তাঁকে দিল সম্মানিত সদস্যপদ। এমনকী, রাজা লুই ফিলিপ তাঁকে নিমন্ত্রণ করলেন। এরপর আবার ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। কিন্তু তখন কিছুদিনের জন্য প্রবল অর্থকষ্টে পড়েন। এই সময় তাঁর এক প্রিয় বন্ধু রেভারেন্ড কার্পেন্টার তাঁকে সাহায্য করেন। কিন্তু অতিরিক্ত পরিশ্রমে তাঁর শরীর ভেঙে পড়েছিল। অবশেষে চির সংগ্রামী রণক্লান্ত রামমোহন চির বিশ্রাম নিলেন— বিস্টলে তাঁর প্রয়াণ ঘটল। দিনটি ছিল ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৩৩।
অমনীয় দৃঢ় ইস্পাত কঠিন ঋজু ব্যক্তিত্বের প্রতীক রামমোহন আধুনিক ভারতের রূপকার। তিনি ‘প্রফেট অব নিউ ইন্ডিয়া’— রবীন্দ্রনাথের ভাষায় নব্য ভারতের চিত্তদূত।
তাঁকে সংস্কারাচ্ছন্ন জনগোষ্ঠী ধর্মদ্রোহী বললেও তিনি ধর্মবিদ্বেষী ছিলেন না। নিজ মাতৃভূমি ও ধর্মকে অন্তর দিয়ে শ্রদ্ধা করেছেন। তাই ইংরেজ বন্ধুদের প্ররোচনাতেও ধর্মত্যাগের কথা ভাবেননি। ইংল্যান্ডের আর্চ বিশপ মিডলটন সাহেব তাঁকে একবার বলেছিলেন, ‘রাজা, তুমি তো দেখছ, তোমাদের ধর্মে কত ভুলভ্রান্তি। তুমি আমাদের খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করো।’ এর উত্তরে আত্মপ্রত্যয়ী এই ভারত সন্তান বলেছিলেন ‘সাহেব, তোমার মার অনেক ত্রুটি থাকতে পারে। তাই বলে তুমি কি অন্য লোকের মাকে মা বলবে?’ রামোহনের এই অসামান্য উত্তরে মিডলটন সাহেব হয়েছিলেন নিরুত্তর।
তাঁর জন্মের প্রায় আড়াইশো বছর পরে আজ এই ভারতে ভূমিতে দাঁড়িয়ে আমরা যেন ভুলে না যাই দেশকে, মাতৃভূমিকে ভালোবেসে রাজা রামমোহন রায় তাকে নতুন আলোকে ঐশ্বর্যময় করতে চেয়েছিলেন। আধুনিক মননে ও চিন্তনে নতুন ভারত গড়তে উদ্যোগী হয়েছিলেন। নবজাগরণের চিত্তপ্রতীক রামমোহনের কাছে আমরা অপরিশোধনীয় ঋণজালে আবদ্ধ। আজ শ্রদ্ধাবনত চিত্তে তাঁকে জানাই আমাদের অন্তরের সশ্রদ্ধ প্রণতি।
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : বিশ্বজিৎ দে