দেশজুড়ে কেন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ?
মাসখানেক খানিকটা স্বস্তির শ্বাস নিলেও ফের করোনা আতঙ্ক গ্রাস করেছে দেশবাসীকে। ব্যতিক্রম নয় এ রাজ্যও। সকলের একটাই প্রশ্ন, এটাই কি সেকেন্ড ওয়েভ? এই মারণভাইরাস থেকে নিস্তার পেতে প্রার্থনা করছে গোটা ভারত। এই কঠিন পরিস্থিতিতে পুনের আইসিএমআর-ন্যাশনাল এইডস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর তথা নয়াদিল্লির আইসিএমআর (হেড কোয়ার্টার)-এর এপিডেমিনোলজি অ্যান্ড কমিউনিকেবল ডিজিসেস ডিভিশনের প্রধান ডাঃ সমীরণ পাণ্ডার মতামত শুনলেন সন্দীপ স্বর্ণকার।
বিয়ের পর নতুন জামাইকে নেমন্তন্ন না করলে কি যেচে শ্বশুরবাড়ি যায়? যায় না। বাঙালি পাঠক বেজায় রসিক! ফলে বুঝবেন ধরে নিয়েই সামান্য হেঁয়ালি করে গোড়াতেই এটা বললাম। কোভিড-১৯-এর ভাইরাস ‘সার্স কোভ-টু’ও ঠিক তাই। এই যে করোনার সেকেন্ড ওয়েভ বা দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে আলোচনায় দেশ উত্তাল, কিন্তু এর জন্য দায়ী কে? দায়ী আমরাই। আমরাই ভাইরাসটাকে ফের জামাই আদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে ডেকে এনেছি। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে করোনার প্রকোপ যেই না সামান্য কমল, ব্যস, আমরা গাছাড়া ভাব শুরু করে দিয়েছি। অপ্রয়োজনে ঘোরাঘুরি করছি, পার্টি করছি, করোনা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অস্বীকার করে আগের মতো আচরণ করেছি। আজ তারই ফল ভুগতে হচ্ছে। তাই সহজ কথায় শুনব না, বুঝেও মানব না, ডাণ্ডা না পড়লে শুধরোব না...এই যদি আমাদের মানসিকতা হয়, তাহলে একবার কেন, বার বার ঢেউ আসবে। তছনছ করে দিয়ে যাবে শরীর ও স্বাস্থ্য। দুর্বল করে দেবে দেশের অর্থনীতি।
তাও তো ভালো কথা, দেখতে সেকেন্ড ওয়েভ হলেও আদতে তা গোটা দেশজুড়ে নয়। আমাদের প্রতিটি মানুষের কৃতকর্ম যেমন কোনও না কোনওভাবে গোটা দেশের ওপর প্রভাব ফেলে, সেই অর্থে করোনার এই সংক্রমণের সাংঘাতিক অবস্থাও সার্বিক রেখাচিত্রে ফুটে উঠছে বটে, তবে আসলে এটিকে গোটা দেশের প্রেক্ষিতে দ্বিতীয় ঢেউ বলা যায় না। কয়েকটি মাত্র রাজ্যেই সংক্রমণের এই বাড়বাড়ন্ত লক্ষ করা যাচ্ছে। সেই হিসেবে কোনও রাজ্যে হয়তো তৃতীয়, কোথায় বা চতুর্থ ঢেউও এসে গিয়েছে। কিন্তু সার্বিকভাবে গোটা দেশের পরিপ্রেক্ষিতে যেহেতু গতবারের সর্বোচ্চ একদিনের সংক্রমণের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে, তাই দ্বিতীয় ঢেউ হিসেবে ব্যাখ্যা করে সাধারণ মানুষের কাছে চিত্রটি তুলে ধরা হচ্ছে।
কিন্তু একটু গভীরে গিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে— মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড়, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, গুজরাত, দিল্লি, কর্ণাটক, কেরল, তামিলনাড়ু, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, পাঞ্জাব, তেলেঙ্গানা, উত্তরাখণ্ড, অন্ধ্রপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ— এই ১৬টি রাজ্যেই সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ বাড়ছে। তাও আবার সব জেলায় নয়। দেশের মোট ৭৩৯টি জেলার মধ্যে ৮২ থেকে ১০০ জেলায় এই সংক্রমণ ছড়াচ্ছে বা বাড়ছে। এর মধ্যে আবার শহরাঞ্চলে বেশি। অন্যদিকে, সিকিম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, লাক্ষাদ্বীপ, দমন-দিউ, দাদরা-নগর হাভেলির মতো কয়েকটি রাজ্য তথা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে এক একদিনে কোনও সংক্রমণের খবরই নেই। তাই প্রকৃত অর্থে এটি দেশজুড়ে করোনার সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ বলতে পারছি না।
লক্ষণীয় বিষয় হল, যেখানে জনঘনত্ব বেশি, দোকানপাঠ, শপিংমল, সিনেমা হল, বড় বাজার, জমায়েতের জমকালো আয়োজন— সেখানেই সংক্রমণ বেশি। কারণ, ভিড় পেলেই ‘সার্স কোভ-টু’ ভাইরাসটি জমিয়ে বসার সুযোগ পায়। ফাঁকা এলাকায় বা দূরে দূরে থাকলে সুযোগ কম। বিভিন্ন রাজ্যের যেসব শহরে বা অঞ্চলে সংক্রমণের খবর আপনারা নিত্যদিন লক্ষ করছেন, তাতেই এটা স্পষ্ট। এটা বোঝার জন্য গবেষকও হতে হয় না, প্রয়োজন পড়ে না রকেট সায়েন্সেরও।
এর মধ্যে আবার অন্য একটি বিষয় হল— রি-ইনফেকশন বা ফের সংক্রমণ। প্রশ্ন হল, একবার কেউ কোভিড-১৯ আক্রান্ত হলে দ্বিতীয়বার কি করোনা পজিটিভ হতে পারেন? হলেও বা কতদিন পর? আর কেনই বা? বিশ্বজুড়ে এ ব্যাপারে গবেষণা হয়েছে। তাতে প্রথম প্রশ্নটির উত্তর হ্যাঁ। আর এই রি-ইনফেকশনের ব্যাপারে এক একটি জায়গায় একরকম সময়ের অন্তর লক্ষ করা গিয়েছে। তবে করোনার রি-ইনফেকশন নিয়ে আইসিএমআর-এর সমীক্ষা এবং গবেষণার প্রেক্ষিতে যে সংজ্ঞা তৈরি হয়েছে, তা সর্বজনগ্রাহ্য। ‘সার্স কোভ-টু রি-ইনফেকশন: ডেভলপমেন্ট অব অ্যান এপিডেমিওলজিক্যাল ডেফিনেশন ফ্রম ইন্ডিয়া’র সেই গবেষণাপত্রের সঙ্গে আমিও জড়িয়ে রয়েছি।
বিভিন্ন দেশে সার্স কোভ-টু ভাইরাসে যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের সাতদিন, দশদিন, ১৫ দিন, ২০ দিন পর আরটি-পিসিআর টেস্ট করা হয়েছে। দেখা হয়েছে, ভাইরাসটার কোনওঅংশ বেঁচে
আছে কি না। সার্স কোভ-টু শরীরে প্রবেশ করার পর তার নিঃসরণ হয়। স্বাভাবিক নিয়মই তাই। তাতে সব সময় যে ভাইরাসটা জীবিত থাকবে, তা নয়। কিন্তু তার অস্তিত্ব ল্যাবরেটরিতে ধরা পড়বে। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর) যে টেস্ট করছে, তার মধ্যে থেকে ৯০ লক্ষ নমুনা নাড়াচাড়া করে ভাইরাসের নিঃসরণ পরীক্ষা হয়েছে। দেখা গিয়েছে, ১ হাজার ৩০০ লোকের মধ্যে মাত্র ৫৮ জনের রি-ইনফেকশন হয়েছে। শতাংশের হারে যা ৪.৫-এর কাছাকাছি। পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে ১০২ দিনের পরে আর ভাইরাসটার নিঃসরণ হয়নি। তাই কেউ একবার করোনা পজিটিভ হয়ে মাঝে নেগেটিভ হওয়ার ১০২ দিন পর ফের পজিটিভ হতেই পারেন। পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যাঁরা দ্বিতীয়বার সংক্রমিত হলেন, তাঁদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি। তারই মধ্যে আবার স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা অধিক। কারণ, সাধারণভাবে পুরুষরা বাইরে বেশি বের হন। স্বাস্থ্যকর্মীরা কোভিডের চিকিৎসা করছেন, রোগীর মুখোমুখি হচ্ছেন। তাই আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি।
এখন প্রশ্ন হল, দ্বিতীয় ঢেউ হোক বা পুনঃসংক্রমণ। এ কি রোখা সম্ভব? জবাব হল, সম্ভব। কীভাবে? সব সময় তো ঘরে বসে থাকা যায় না। বাইরে তো বেরতেই
হবে। কাজকর্মও করতে হবে। অথচ বাইরে বেরলেই মানুষের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ, বাজার দোকান করা, বাসে, ট্রামে, ট্রেনে, প্লেনে চড়া ইত্যাদি যত বেশি হবে, যাকে বলে এক্সপোজার, ততই সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি। আর সেই কারণেই মহামারী যখন আসে, তখন কেউ কারও দিকে আঙুল তুলে দায় এড়াতে পারে না। দায় সকলেরই। দায়িত্বও।
তবে হ্যাঁ, কিছু ক্ষেত্র রয়েছে, যেখানে ঝুঁকি এড়ানোর সুযোগ থাকলেও হচ্ছে না। যেমন, কুম্ভমেলা, নির্বাচনী জনসভা। কাতারে কাতারে লোক। ভক্তের দল। আর সেখানেই বিশ্বাসের সঙ্গে বিজ্ঞানের বিতর্ক। আমার মতামত, কোনও সচেতন ভোটারেরই নেতাদের দেখতে বা খুশি করতে জনসভার ভিড়ে যাওয়া উচিত নয়। কারণ, নির্বাচন শেষে আমার আপনার ভোটে নেতারা যখন ক্ষমতার কুর্সিতে বসবেন, তখন দেখা যাবে আমি আপনি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে করোনা আক্রান্ত হয়ে খাবি খাচ্ছি!
তাই ১৯১০ সালের মাঞ্চুরিয়ান প্লেগ, ১৯১৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা প্যানডেমিকের (যাকে স্প্যানিশ ফ্লু বলে প্রচার করা হয়) অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, মাস্ক হল সার্স কোভ-টু ভাইরাসকে আটকানোর সহজ উপায়। তার সঙ্গে ভ্যাকসিন। সে সময়ে চিকিৎসায় যে গজ ব্যবহার করা হতো, তা দিয়ে মাস্ক তৈরি হতো। দু’টি ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে মাস্ক প্রচণ্ড কার্যকরী। পরবর্তীকালে, সিভিয়র অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (সার্স), মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (মার্স)-এর ক্ষেত্রেও একই বিষয় দেখা গিয়েছে। কাজে দিয়েছে মাস্ক। এখন সার্স কোভ-টু ভাইরাসকেও আটকাতে পারে মাস্ক। মনে রাখতে হবে, শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ করতে পারে, এমন ভাইরাস হল সার্স কোভ-টু। কিন্তু সরাসরি তো আর ফুসফুসে চলে যেতে পারে না ভাইরাস। এটা তো বুলেট নয় যে বুকের দেওয়াল ভেদ করে যাবে! যাবে নাক, মুখ দিয়েই। তাই সেই রাস্তাটা সবার আগে আটকাতে হবে। সেই কাজ করে মাস্ক। ০.৩ মাইক্রন সাইজের ভাইরাসের অংশও রুখে দিতে পারে মাস্ক। তাছাড়া সেরোলজিক্যাল সার্ভেই যখন সতর্ক করে দিয়েছে যে, এখনও ভারতের ৭৯ শতাংশ নাগরিকের সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে, তখন তো সতর্কতা অবলম্বন করতেই হবে।
তবে, মাস্ক পরতে হবে সঠিকভাবে। থুতনির কাছে নামিয়ে বা গলায় পরলে হবে না। সঠিকভাবে নাক-মুখ ঢেকেই পরতে হবে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, হংকং, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়ার লোকেরা দ্রুত মাস্ক পরা অভ্যাস করে ফেলেছেন। সমীক্ষায় এও দেখা গিয়েছে যে, মাস্ক আবশ্যিক করলে আমেরিকায় কমপক্ষে ৪৯ হাজার মানুষকে বাঁচানো যেত। কানাডার সাপ্তাহিক সংক্রমণ কমপক্ষে ২৫ শতাংশ কমানো সম্ভব হয়েছে মাস্ক আবশ্যিক করেই। ৪০ শতাংশ দৈনিক সংক্রমণ হ্রাস সম্ভব করেছে জার্মানিও। অথচ ভারতের ৫৬ শতাংশ নাগরিক ঠিক করে মাস্কই পরেন না।
তাই আমাদের পরামর্শ, মাস্ক মাস্ট। কারণ, যতই ‘দো গজ কি দূরি’র দাওয়াই দেওয়া হোক, আদতে বাস, ট্রাম, লোকাল ট্রেনের মতো সাধারণ পরিবহনে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়। সেখানে কাজে দেবে একমাত্র মাস্ক। তবে দু’বছরের কম বয়সি শিশু এবং সেরিব্রাল পালসির মতো রোগী বা যাঁরা নিজেরা মাস্ক পরতে-খুলতে অক্ষম, তাঁদের মাস্ক পরার প্রয়োজন নেই। ওতে শ্বাসকষ্ট হয়ে হিতে বিপরীত হতে পারে।
বাজারে তিন ধরনের মাস্ক রয়েছে— ১) সাধারণ কাপড়ের মাস্ক, ২) মেডিক্যাল মাস্ক ও ৩) রেসপিরেটরি মাস্ক (এন-৯৫ এবং এন-৯৯)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু’র পরামর্শ, সাধারণ ব্যবহারের জন্য কাপড়ের ত্রিস্তরীয় মাস্কই যথেষ্ট। এতে ৭০ শতাংশ জীবাণু আটকায়। অন্যদিকে, যাঁদের কোভিড-১৯-এর প্রবল ঝুঁকি, তাঁদের জন্য প্রয়োজন মেডিক্যাল মাস্ক। এতে ৯৯ শতাংশ জীবাণুর কণা আটকায়। আর যাঁরা কোভিড আক্রান্ত বা স্বাস্থ্যকর্মী, তাঁদের জন্য উপযুক্ত রেসপিরেটরি মাস্ক। এতে ৯৯.৯ শতাংশ ক্ষুদ্র জীবাণুর কণা রুখে দেয়।
তাই করোনার যত ঢেউই আসুক, সার্স কোভ-টু ভাইরাসের সঙ্গে লড়তে গেলে একদিকে যেমন মাস্ক পরতে হবে, অন্যদিকে নিতে হবে ভ্যাকসিন। কারণ, যাঁদের কাবু হওয়ার ঝুঁকি বেশি, তাঁদের তো যুদ্ধ করতে গেলে শুধু বর্ম পরলে চলবে না, চাই অস্ত্রও। তরবারি। এক্ষেত্রে করোনা ভাইরাসের সঙ্গে লড়তে মাস্ক হচ্ছে বর্ম, ভ্যাকসিন তরবারি। কিন্তু সবারই কি ভ্যাকসিন প্রয়োজন? জবাব হল, না। স্বাস্থ্যকর্মী, যাঁরা সংক্রমণের ঝুঁকিতে কাজ করছেন তাঁদের সবার জন্য ভ্যাকসিন জরুরি। বাকি, একটা বৃহত্তর অংশ যদি ভ্যাকসিন নিয়ে নেয়, তাহলেই তো অন্যের সংক্রমণের সুযোগ কমে গেল। সেই কারণেই সকলের ভ্যাকসিন দরকার নেই। আবার যাঁদের প্রয়োজন, তাঁরা যদি অবজ্ঞা করেন, তাহলেও বিপদ। তাই কেবল নিজের কথা না ভেবে মহামারী রুখতে সচেতন নাগরিক হিসেবে সমাজে সামান্য অবদান তো রাখা দরকার। আর এটা যদি মন থেকে করতে পারি, তাহলে করোনার যত বড় ঢেউই আসুক না কেন, মানবজাতি তা পেরিয়ে যাবেই। ভাইরাস পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ চলে না গেলেও তার সঙ্গে সহবস্থানে অভ্যাস হয়ে যাবে।
25th April, 2021