শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহ বৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে ... বিশদ
১৩ জুলাই ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় বয়কটের ডাক দেওয়া হল খোলাখুলি। ৭ আগস্টে টাউন হলে বয়কটের প্রস্তাব পাশ হয়ে গেল। স্বদেশির পক্ষে পরপর বক্তৃতা দিচ্ছেন একজন কবি। কখনও পড়ছেন ‘অবস্থা ও ব্যবস্থা’ নামক প্রবন্ধ। কখনও মেয়েদের স্বদেশি সভায় পাঠ করছেন অসামান্য ‘ব্রতধারণ’ ভাষণ। এভাবে সেই কবিকে কখনও দেখা যায়নি রাস্তায় নেমে রাজনীতি, ব্রিটিশ বিরোধিতা অথবা প্রকাশ্যে জাতির সম্মান নিয়ে আন্দোলনে নামতে। তিনি এতই ক্ষুব্ধ, আজ রাস্তায় নেমেছেন। সেই কবির নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর মাত্র সাতদিন পর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হবে। ৯ অক্টোবর বাগবাজারে বিজয়া সম্মিলনীতেও প্রবলভাবে বয়কটের ঝাঁঝালো আহ্বানের পুরোধা সেই কবিই।
কিন্তু বঙ্গভঙ্গ ঠেকানো গেল না। তবে একটি দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে দেওয়া হল একটি জাতির অন্তরে। সাড়ে সাত কোটির বেশি জনসংখ্যার বাংলা ভাগের পক্ষে কার্জনের যুক্তি ছিল, এভাবে সবথেকে অবহেলিত হচ্ছে প্রদেশের ইস্টার্ন পার্ট। অর্থাৎ পূর্ব অংশ। সেখানে যাওয়া দুষ্কর। তাই কোনও উন্নয়ন পৌঁছয় না। ভাগ করে দিলে ছোট হয়ে যাবে প্রদেশ। সুবিধা হবে উন্নয়নে। এসব কথার কথা। বাঙালি বুঝল, ডিভাইড অ্যান্ড রুল করতে চাইছে ব্রিটিশ। কার্জন তো বটেই, ব্রিটিশ সরকার ভয় পেতে শুরু করল তখন, যখন দেখা গেল পুনে, বম্বে, পাঞ্জাবে ছড়িয়ে পড়েছে ওই আন্দোলন, অসন্তোষ। অন্য প্রদেশের মানুষও বাঙালির প্রতি এই অনাচারের বিপক্ষে সরব হতে। সবথেকে বড় ঝড় টের পেল খোদ কংগ্রেস। কলকাতা অধিবেশনে তীব্র ধিক্কারধ্বনি শুনতে হল সিনিয়র কংগ্রেস নেতাদের। তারা ব্রিটিশদের সঙ্গে ভারসাম্য রেখে চলছেন, এই অভিযোগে কোণঠাসা নরমপন্থীরা। স্বয়ং দাদাভাই নৌরজিকে আনতে হল সঙ্কট সামলাতে। ঐক্য বজায় রাখতে। কংগ্রেস ভেঙে যায় যায়।
নাগপুরের কংগ্রেস অধিবেশন ১৯০৭ সালে। কিন্তু সেখানে অধিবেশন করা মানে আরও বড় বিপদ। গোটা শহরই তো বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে। সুতরাং হয়তো ভেস্তেই যাবে অধিবেশন। তাই সরিয়ে নেওয়া হল এমন এক জায়গায়, যে শহর শান্ত। সুরাট। কোথায় শান্ত? বরং কংগ্রেসের বিদ্রোহীরা ওই শহরে অফিসিয়াল কংগ্রেস নেতাদের ধিক্কার দিয়ে পৃথক অধিবেশন করলেন। বিদ্রোহী আর চরমপন্থী এই যুবকদের বিক্ষোভ, আন্দোলন কতদিন টিকবে? প্রবীণ কংগ্রেস নেতাকর্মীরা ভাবছেন। তাঁরা জানতে চান, এদের নেতা কারা? দেখা গেল এঁদের নেতা দুই উজ্জ্বলতম অগ্নিশিখা। অরবিন্দ ঘোষ ও বালগঙ্গাধর তিলক। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী নামক কোনও ব্যক্তি তখনও অবতীর্ণ হননি ভারতীয় রাজনীতির মঞ্চে। কিন্তু প্রায় ১২ বছর পর তিনি যে আশ্চর্য কাজটি করবেন অসহযোগ আন্দালনের মাধ্যমে, সেটির প্রকৃত সূত্রপাত যেন করল বাঙালি সম্প্রদায়। অর্থাৎ ভারতবাসীর মনে ন্যাশনালিজম জাগ্রত করে, একটি স্বাধীন সত্তার ইচ্ছাকে উস্কে দিয়ে একজোট হওয়ার শপথ। বঙ্গভঙ্গের এই আন্দোলনের আগে কিন্তু গোটা দেশকে একসূত্রে বেঁধে ফেলার একটি আবেগের জন্ম হয়নি।
সুতরাং, ন্যাশনালিজম নামক উচ্চ দর্শনটির জন্ম হল কলকাতার রাস্তায়। কিন্তু তার তীব্র প্রকাশ ঘটল বিহারের মুজফফপুরে ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল। দুই টিনএজার একটি গাড়িকে লক্ষ্য করে বোমা ছুঁড়লেন। তাঁদের লক্ষ্য কলকাতার প্রাক্তন চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস কিংসফোর্ড। সেদিন কেনেডিদের বাড়িতে কিংসফোর্ড এসেছিলেন তাস খেলতে। ফেরার সময় কিংসফোর্ড আর তাঁর স্ত্রী একটি গাড়িতে, আর একইরকম দেখতে আর একটি গাড়িতে ছিলেন কেনেডি পরিবারের মা ও মেয়ে। ওই দুই তরুণ ভুল গাড়িতে বোমা ছুঁড়লেন। কিংসফোর্ড বেঁচে গেলেন। এই প্রথম নয়। এর আগেও কিংসফোর্ডের বাংলোয় একটি বই পাঠানো হয়েছিল পার্সেলে। হার্বার্টের ব্রুমের লেখা ‘কমেন্টারিজ অন দ্য কমন ল’। আসলে সেটি বই ছিল না। ছিল বোমা। পরেশ মল্লিক নামক এক তরুণ বিপ্লবী সেটি পৌঁছে দিয়েছিলেন। বই খুললেই বিস্ফোরণ হবে। কিন্তু কিংসফোর্ড ব্যস্ত ছিলেন। পার্সেল না খুলে আলমারির উপর রেখে দিলেন। তারপর ভুলেই গেলেন। তাঁর ট্রান্সফার অর্ডারও এসে গেল। ডিস্ট্রিক্ট জজ। মুজফফরপুর। সেখানেই তাঁকে টার্গেট করলেন ওই দুই তরুণ। তাঁদের নাম ক্ষুদিরাম বোস ও প্রফুল্ল চাকী।
দুই যুবা ব্যর্থ হলেন। কিন্তু বীরত্ব আর স্বাধীনতা সংগ্রামের আগুনটি চিরতরে জ্বালিয়ে দিয়ে গেলেন। সে কাহিনি বাঙালির অন্তরে স্থপিত আজও। ব্রিটিশ সরকার ক্ষুদিরাম বোসকে ফাঁসি দিয়ে ভেবেছিল বাঙালি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে যাবে। আর কেউ মাথা তোলার সাহস পাবে না। কিন্তু ভুল। বরং দেখা গেল, ঘরে ঘরে এই দুই তরুণের বীরগাথার বন্দনা শুরু হয়েছে। উজ্জীবিত হয়ে গেলেন হাজার হাজার তরুণ যুবা। সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকা ব্রিটিশ এবার প্রত্যাশিতভাবেই শুরু করল যথেচ্ছ ধরপাকড়। এভাবেই একদিন কলকাতার মানিকতলা এলাকার মুরারিপুকুরের বাগানবাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হল একঝাঁক যুবককে। তাঁরা নাকি চক্রান্ত করছিলেন। কাউকে পাঠানো হল আন্দামানে। কারও বিরুদ্ধে দেশদ্রোহ ও হত্যার চক্রান্তের মামলা। এরকমই একটি মামলার নাম ইতিহাসে উজ্জ্বল। আলিপুর বোমা মামলা।
১৯০৯ সালে ওই মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া জ্যোতিষ্ক অরবিন্দ ঘোষের পক্ষে এক দৃপ্ত আইনজীবী আবেগ ও যুক্তির সংমিশ্রণে আদালতে বললেন, ‘এই অস্থিরতার যখন অবসান হবে, এই বিতর্ক যখন নীরব হবে, দীর্ঘদিন পর যখন তাঁর জীবনাবসান হবে, তখন তাঁকে বলা হবে দেশপ্রেমের কবি, তাঁর সম্পর্কে বলা হবে জাতীয়তাবাদের গুরু, মানবিকতার প্রেমিক। তাঁর উচ্চারিত বাণী প্রতিধ্বনিত হবে শুধুই এই দেশে নয়, সমুদ্র পেরিয়ে অন্য ভূখণ্ডগুলিতেও। তাই মাননীয় জুরিগণ ও বিচারপতি, আপনাদের আমি বলতে চাই, আজ এই মানুষটি দাঁড়িয়ে রয়েছেন শুধু এই আদালতের সামনে নয়, তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন ইতিহাসের হাইকোর্টে!’ অরবিন্দ ঘোষের হয়ে আদালতে উপস্থিত হওয়া এই ব্যারিস্টারের নাম ছিল চিত্তরঞ্জন দাশ। আর বিচারপতি ছিলেন সি পি বিচক্রফট। ঘটনাচক্রে তিনি ছিলেন কেমব্রিজের কিংস কলেজে এই অভিযুক্ত অরবিন্দ ঘোষেরই সহপাঠী। এমনকী, অরবিন্দ ঘোষ গ্রিক ভাষার পরীক্ষায় প্রথম স্থান পাওয়ায় বিচক্রফট ফার্স্ট হতে পারেননি। সেকথা তিনি মনে রেখেছেন। আজ তিনি বাধ্য হলেন এই অসামান্য বাগ্মী আইনজীবীর যুক্তিজাল মেনে নিতে। বন্দিমুক্তি ঘটল অরবিন্দের। কিন্তু আচমকা তিনি নিজে সম্পূর্ণ চলে গেলেন অন্য জগতে। অধ্যাত্মবাদ ও ঈশ্বর বন্দনার এক অন্য বোধে। তবে তাঁর প্রজ্জ্বলিত জাতীয়তাবাদের আগুন নিভল না। বরং ‘অনুশীলন সমিতি’, ‘যুগান্তর’ ইত্যাদি গোপন সংগঠনে ছড়িয়ে পড়ল আদর্শ। এই প্রথম ব্রিটিশ সরকার ভয় পেতে শুরু করল। কীভাবে শিক্ষা দেওয়া যায় বাঙালিকে? শুরু হল প্ল্যান।
কথাটা মনে ধরল লর্ড হার্ডিঞ্জের। তিনি ২৫ আগস্ট একটি চিঠি লিখলেন, সিমলা থেকে লন্ডনে। সেক্রেটারি অফ স্টেট ফর ইন্ডিয়াকে। বললেন, প্রথমত, দিল্লি সেন্ট্রালি লোকেটড। এখান থেকে গোটা ভারতে যাতায়াত, নজর রাখা, প্রশাসনিক সিদ্ধান্তকে দ্রুত কার্যকর করা সহজ। কলকাতা একেবারেই একটি প্রান্তে। সেখানে সমস্যা হচ্ছে। যেটা লিখলেন না, কিন্তু মুখে বললেন এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলকে, সেটা হল, এখন কলকাতা আর নিরাপদ নয়। ব্রিটেন থেকে বহু প্রতিনিধি, অতিথি, সরকারি আধিকারিক, পর্যটক আসেন ভারতে। কলকাতা যেভাবে চরমপন্থী হয়ে উঠেছে, সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। কখন যে আক্রান্ত হতে হবে। লর্ড হার্ডিঞ্জের পাঠানো প্রস্তাব পছন্দ হল স্বয়ং মহারাজা পঞ্চম জর্জের। তবে কোনও সিদ্ধান্ত জানালেন না। তিনি আসছেন ভারতে। আবার দরবার হবে। অভিষেক উৎসব। রাজা জর্জ এবং রানি মেরি। দিল্লিতে আয়োজিত হয়েছে উৎসব।
রাজা ও রানি এলেন। অভিষেক পর্বে ভারতের তাবৎ রাজা-মহারাজারাও এলেন। পঞ্চম জর্জ ও কুইন মেরি লালকেল্লার খোয়াব গাহ এর কাছে একটি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দিল্লির মানুষকে দর্শন দিলেন। এই খোয়াব গাহে সম্রাট শাহজাহান সারাদিনের ক্লান্তির পর বিকেলে এসে বিশ্রাম নিতেন। রাজা জর্জ মনে করলেন ভারতে ব্রিটিশরাজ আর একটি মোগল সাম্রাজ্য হতে চলেছে। এই দরবার উৎসবেই স্বয়ং রাজা ঘোষণা করলেন বাঙালির সর্বনাশ। ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে সরিয়ে আনা হচ্ছে। নতুন রাজধানী দিল্লি! বাঙালির ভাগ্যাকাশে সূর্যাস্তের শুরু! গোটা বাংলা স্থম্ভিত!
স্থির হল, কাজটা ভাগাভাগি করে নেওয়া হবে। লুটিয়েনস ডিজাইন করবেন গভর্নমেন্ট হাউস (আজকের রাষ্ট্রপতি ভবন) এবং গোটা নতুন শহরের লে আউট। তার মধ্যে থাকবে একটি অভিনব মার্কেট কমপ্লেক্স। যার নাম হবে কনট প্লেস। আর বেকার নির্মাণ করবেন দুটো সচিবালয় (আজকের নর্থ ব্লক ও সাউথ ব্লক)। গোটা প্রজেক্টের ৫ শতাংশ করে তাঁরা পাবেন ফি হিসেবে। কেমন হবে বিল্ডিংগুলো? লুটিয়েনস চাইছেন ইউরোপিয়ান ক্লাসিক স্ট্রাকচার। বেকারের পছন্দ এমন এক নতুন স্টাইল, যা হবে ইম্পেরিয়াল। এমন এক স্থাপত্য যেখানে ইউরোপ স্টাইলে মিশে যাবে ভারতীয় কলা।
সুতরাং দু’জনের ডিজাইনে দুরকম চিহ্ন পরিলক্ষিত হল। লুটিয়েনস যে ভাইসরয় হাউসের নকশা তৈরি করলেন, সেটায় ইউরোপীয় ক্লাসিকের ছাপ। বেকারের নর্থ ব্লক ও সাউথ ব্লকে রেনেসাঁ ও ইন্ডিয়ান স্টাইলের মেলবন্ধন। সেখানে দেখতে পাওয়া যাবে জালি, ছত্রী, নকশা। কিন্তু প্রাথমিক এই ডিজাইনের ফারাক একটা সময় সরাসরি মতান্তরে পরিণত হল। সেটা হল কাউন্সিল হাউস নির্মাণে। অর্থাৎ আজকের পার্লামেন্ট হাউস। বেকার চাইলেন একটি ত্রিকোণ তৈরি করতে। কাউন্সিল অফ স্টেটস (রাজ্যসভা), লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি (লোকসভা) এবং চেম্বার অফ প্রিন্সেস। কিন্তু লুটিয়েনসের ইচ্ছা গোল কলোসিয়াম ডিজাইন। প্রবল টানাপোড়েন। ঝগড়া। মতান্তর। কিন্তু লুটিয়েনসের ইচ্ছাই পূর্ণ হল।
কিন্তু অন্য একটি মতপার্থক্য বন্ধুত্বে চিড় ধরালো। ভাইসরয় হাউস ও সেক্রেটারিয়েটকে একই উচ্চতায় রাখতে চাইলেন বেকার। যাতে মানুষের চোখে ভাইসরয় এবং প্রশাসন একই মাপের হয়। সেই কারণে ভাইসরয় হাউসকে একটু পিছিয়ে দিতে হল। যাতে সমমাপের মনে হয়। কিন্তু এর ফলে যেটা হল, সেটা লুটিয়েনস মানতে পারলেন না। রাজপথ থেকে অর্থাৎ রাইসিনা হিলসের থেকে উতরাই ধরে নেমে এসে মধ্যবিন্দুতে দাঁড়ালে সম্পূর্ণভাবে আর ভাইসরয় হাউসকে দেখা যায় না। শুধুই উপরের শীর্ষ গম্বুজ দৃষ্টিগোচর হয়। বহু বছর ধরে দুই দিল্লি কারিগরের মধ্যে প্রবল অভিমান ও ক্ষোভ জমা হয়ে ছিল। পরস্পরকে লেখা চিঠিতে সেটা স্পষ্ট হয় ১৯২৫ সালে।
প্ল্যানটা কী ছিল? রাইসিনা হিলসের উপর থেকে ভাইসরয় সোজা তাকালে দেখতে পাবেন পুরনো কেল্লা। অর্থাৎ শেরশাহ ও হুমায়ুনের নির্মাণ। মোগল থেকে ব্রিটিশ— একটি ইতিহাসের জার্নি যেন সাড়ে ৩ কিলোমিটারেই প্রতিভাত। এর নাম রাজপথ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে নিউ দিল্লি নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় চার বছর পর আবার যখন শুরু হল, তখন নতুন একটি প্ল্যান সংযোজিত। ভাইসরয় হাউসের সামনের রাস্তা রাজপথ হয়ে প্রথমে মিশবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধসহ বিভিন্ন যুদ্ধে নিহত ভারতীয় সেনানীদের স্মৃতিস্তম্ভে। যার নাম হবে ইন্ডিয়া গেট। তার দু’দিকে গড়ে তোলা হবে সুরম্য বাগান। সবুজ বনানীতে ঘেরা জলাশয়, কৃত্রিম ঝর্ণাকে দু’দিকে রেখে রাজপথ যাবে পুরনো কেল্লায়। যেখানে এক সন্ধ্যার আজান শুনে তড়িঘড়ি কেল্লার শীর্ষ থেকে নামতে গিয়ে পোশাকে পা আটকে সিঁড়ি থেকে পড়ে যান সম্রাট হুমায়ুন। মৃত্যু হয় তাঁর। কী করছিলেন তিনি ছাদে? আকাশের শুকতারা দেখছিলেন! তারপর কী হল? কখন খবর পেলেন পুত্র ১৪ বছরের আকবর? সে অবশ্য অন্য গল্প। সকলের জানা। ১৯৩১ সালে সমাপ্ত হল নতুন দিল্লি। নতুন ব্রিটিশ প্রশাসনের পাওয়ার করিডর। নতুন দিল্লি এক অত্যাধুনিক শহরে পরিণত হল। ছবির মতো। যাকে গোটা বিশ্ব চেনে একটি নামে। লুটিয়েনস দিল্লি!
ঠিক ৯২ বছর পর আবার তৈরি হবে নতুন এক দিল্লি। প্রকল্পের নাম সেন্ট্রাল ভিস্টা রিডেভেলপমেন্ট। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্থির করেছেন, নতুন করে সাজিয়ে তোলা হবে এই লুটিয়েনস দিল্লিকে। ২০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। ২০২৩ সালের মধ্যেই সমাপ্ত হবে। কী কী বদলে যাবে? প্রায় সব! প্রধানমন্ত্রীর নতুন বাসভবন তৈরি হবে। হবে নতুন পার্লামেন্ট। নতুন সচিবালয়। বর্তমান পার্লামেন্টকে মিউজিয়মে পরিণত করা হবে। রাজপথের দু’পাশে প্রায় ১৯০০ গাছ সরিয়ে দিতে হবে। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন লোককল্যাণ মার্গে। ১২ একর জমিতে গড়ে তোলা এই কমপ্লেক্সে মোট পাঁচটি বাংলো। এছাড়া অফিস বিল্ডিং, প্রেক্ষাগৃহ, কনফারেন্স হল, হেলিপ্যাড এবং একটি আন্ডারগ্রাউন্ড টানেল। এই গোপন সুড়ঙ্গ সোজা সফদরজং এয়ারপোর্টের টারম্যাকে পৌঁছে গিয়েছে। নতুন প্রধানমন্ত্রী ভবনে থাকবে ১০টি চারতলাবিশিষ্ট বাড়ি। ১৫ একর প্লট। সম্পূর্ণ নতুন পার্লামেন্ট ভবন গড়ে তোলা হবে ৯০০ কোটি টাকা ব্যয়ে।
বেকার ও লুটিয়েনস যে দিল্লি তৈরি করেছিলেন, সেখানে নতুন সংযোজন ঘটেছে একাধিকবার। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর বহু নতুন বিল্ডিং নির্মাণ করা হয়েছে। প্রধানত সেগুলি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল সেন্টার ফর আর্টস ১৯৮৫ সালে গড়ে তোলা হয়। সাহিত্য, ভিস্যুয়াল আর্টস, স্থাপত্য, ফোটোগ্রাফি, সঙ্গীত, নৃত্যকলার এক গবেষণাগার ও মেলবন্ধনকেন্দ্র। এই বিল্ডিং ভেঙে ফেলা হবে। সরকারের বহু মন্ত্রক ও বিভাগ যে ভবনগুলিতে রয়েছে সেই শাস্ত্রী ভবন, কৃষি ভবন আর থাকবে না। ধুলিসাৎ হবে। ভাঙা হবে জওহরলাল নেহরু ভবন। বিদেশমন্ত্রকের অফিস। ১৯৫৬ সালে নির্মিত দিল্লির অন্যতম গর্ব হিসেবে উপস্থাপিত একটি অসামান্য শৈলীর অট্টালিকা হল বিজ্ঞান ভবন। এটিও ভেঙে দেওয়ার প্ল্যান করা হয়েছে। উপরাষ্ট্রপতির বাংলো ভাঙা হবে। সবথেকে বেশি বিতর্ক দানা বেঁধেছে যে বিল্ডিং নিয়ে সেটি হল জাতীয় মিউজিয়াম, ন্যাশনাল আর্কাইভকে ভাঙা নিয়ে। যদিও সরকার জানিয়েছে, ন্যাশনাল আর্কাইভের মূল বিল্ডিং অটুট থাকবে। শুধুই অ্যানেক্সি ভাঙা হবে। কী আছে সেখানে? ৪৫ লক্ষ ঐতিহাসিক ফাইল। ২৫ হাজার অতীত পাণ্ডুলিপি, ১ লক্ষাধিক মানচিত্র এবং দেড় লক্ষ মোগল আমলের নথিপত্র। সরকার আশ্বাস দিয়েছে, মিউজিয়াম অথবা আর্কাইভ, প্রতিটি নথি সম্পূর্ণ সুরক্ষিত থাকবে। সংস্কৃতি মন্ত্রক জানিয়েছে, দিল্লির চরিত্র বদলের কোনও প্রয়াস হচ্ছে না। সরকারের দাবি, যখন নতুন সেন্ট্রাল ভিস্টা সামনে আসবে, তখন সকলেই বুঝবে কতটা নয়নাভিরাম এবং আধুনিক হয়েছে এই উদ্যোগ। সুতরাং এতকালের চেনা রাজধানী নতুন দিল্লির অনেকটা পাল্টে যাবে।
পুরনো টাকা বাতিল। পুরনো ট্যাক্স ব্যবস্থা বাতিল। পুরনো দিল্লি বাতিল। পুরনো পার্লামেন্ট বাতিল।
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : স্বাগত মুখোপাধ্যায়