শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহ বৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে ... বিশদ
১৯০১ সালের ২২ জানুয়ারি ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়া ৮১ বছর বয়সে মারা গিয়েছেন। হিন্দু নিয়মানুযায়ী, ১২ দিনের মাথায় ২ ফেব্রুয়ারি কলকাতার বাবুরা পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর প্যালেসের মহারাজ যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের উদ্যোগে করলেন নগর সংকীর্তন। ছিল গণভোজের ব্যবস্থা । শ্রাদ্ধশান্তি মিটে যাবার পর আর কী! অনেকটা ‘নিয়মভঙ্গের’ নিয়ম পালন। ৩ ফেব্রুয়ারি দুপুরে কর্নওয়ালিস রোড বর্তমানে বিধান সরণীর দু’পাশে সার সার বসেছে সাধারণ মানুষ। দরিদ্রনারায়ণ সেবা। খিচুড়ি, কপির তরকারি, বেগুন ভাজা, চাটনি, দই আর সন্দেশ। সন্দেশ দিয়েছিলেন ভীম নাগ। বহু মানুষ এসে রানিমার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের (!) এই ভোজে অংশ নিলেন।
***
১৮৩৭ সালের ২২ জুন রাজা চতুর্থ উইলিয়াম মারা যাওয়ার পর যখন আলেকজান্দ্রিয়া ভিক্টোরিয়া ব্রিটেনের রানি হলেন, তখন তাঁর মাত্র ১৮ বছর বয়স। তখনও ভারতবর্ষ ব্রিটিশ সরকারের অধীনে ছিল না। ছিল একটি ‘কর্পোরেট কোম্পানি’ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে। ১৮৫৭ সালে ভারতে সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হল। প্রচুর ইউরোপিয়ান মারা গেল। তারপরেই ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারতবর্ষের শাসনভার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে নিয়ে এল। তার আগে পর্যন্ত যত ব্রিটিশ শাসক এই ভারতে শাসন করেছেন, তাঁরা সবাই একটি কোম্পানির হয়ে চাকরি করতে এসেছেন। ১৮৭৭ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাশ হল ‘রয়্যাল টাইটেল অ্যাক্ট’। সেই আইন বলে রানি ভিক্টোরিয়া হলেন ভারতের রানি। কলকাতা তখন ভারতের রাজধানী। সুতরাং রানিমার মৃত্যুতে রাজধানীর প্রজাদের শোক ও শোকের প্রদর্শন স্বাভাবিক। বিশেষত সমাজের উপরতলার বাবুদের যত বাবুয়ানি সবই তো ব্রিটিশ কত্তাদের বদান্যতায়। তো রানিমার মৃত্যুতে শোকাহত বাবুরা যারপরনাই নানা ‘উজ্জুগ’ শুরু করলেন।
লর্ড কার্জন তখন ভারতের ভাইসরয়। বছর দু’য়েক আগে, মানে ১৮৯৯ সালে ভাইসরয় হওয়ার আগে তিনি কম গুরুত্বপূর্ণ ‘ফরেন আন্ডার সেক্রেটারি’ হিসাবে কাজ করতেন ব্রিটিশ সরকারে। অনেককে টপকে তিনি হয়েছেন ভারতের শাসনকর্তা। আর এই সময়ে রানিমার মৃত্যু। তাঁকে কিছু করতেই হয় উল্লেখ্যযোগ্য। টাউনহলে আয়োজন করলেন রানির স্মরণসভা। বাংলার সমস্ত রাজা, বাহাদুর, জমিদার যাঁরা যা খেতাব পেয়েছেন ব্রিটিশদের কাছ থেকে সবাই হাজির হলেন। লর্ড কার্জন ওই সভায় ঘোষণা করলেন— রানি ভিক্টোরিয়াকে চিরস্মরণীয় করতে একটি এমন স্মৃতিসৌধ করা হবে, যা পৃথিবীর কাছে দর্শনীয় হবে শুধু নয়, যা সংরক্ষণ করবে ভারতের তথা বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। সবাই স্বাগত জানাল এই প্রস্তাবকে। ঘন ঘন মিটিং। চাঁদা দিল সব রাজা, মহারাজা, জমিদাররা। কে কত দিতে পারে তার হিড়িক পড়ে গেল! স্বেচ্ছায়। বহু সাধারণ মানুষও চাঁদা দিল।
***
গভীর চিন্তায় অভিজ্ঞ ব্রিটিশ স্থপতি এমারসন। রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিটেক্ট-এর প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম এমারসন। বৃদ্ধ হয়েছেন তিনি। দাঁতে ধরে থাকা পাইপে ঘন ঘন টান দিচ্ছেন। চল্লিশ বছর আগে ভারতে এসেছিলেন তিনি। বোম্বাই, এলাহাবাদ, হায়দরাবাদসহ নানা জায়গায় তাঁর স্থাপত্য ছড়িয়ে আছে। কিন্তু এমন সমস্যা হয়নি এর আগে। তাঁর সহযোগী ইঞ্জিনিয়ার ভিনসেন্ট জে ইসচ। ইসচ সাহেব তাঁর কেরিয়ার শুরু করেছিলেন বেঙ্গল-নাগপুর রেলওয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। এক বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার তাঁদের বোঝাচ্ছেন। কফির পেয়ালা ঠান্ডা হচ্ছে। টেবিলের উপরে সেই বাঙালির তৈরি নকশা। সালটা ১৯১০।
‘কয়েক মাসের মধ্যে যদি ভিত বসে যায় মাটিতে! তা’হলে মার্বেল পাথরের এই বিশাল স্ট্রাকচার থাকবে কী করে!’
‘গঙ্গার পলিমাটি বুঝলে হে...ময়দানের পাশ দিয়েই তো গঙ্গা...মাটি ভেজা ও নরম...তোমরা সেটা ভাবনি!’ এমারসন বেশ বিরক্ত।
বাঙালি আর্কিটেকচার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় কফির কাপে আলতো চুমুক দিয়ে বললেন, ‘ভিতের নীচে শাল কাঠের স্ট্রাকচার করতে হবে। তার ডিজাইন আমি করে এনেছি। কড়ি-বরগা, বাংলার নিজস্ব পুরনো ডিজাইন একটু নতুন মোড়কে করা...’
সবাই উপুড় হয়ে পড়ল টেবিলের উপর। রাজেন্দ্রনাথ বোঝালেন তাঁর নকশা। কফির কাপে চুমুক দিল সবাই। বাঙালির যুক্তি ও বুদ্ধিকে ব্রিটিশ স্থপতি ও ইঞ্জিনিয়াররা স্বাগত জানানোর পাশাপাশি মান্যতা দিল। গৃহীত হল রাজেন্দ্রনাথের কড়ি-বরগা দিয়ে ভিতের নকশা।
বড়লাট লর্ড কার্জন ১৯০১ সালে রানি ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিসৌধ নির্মাণের এমন এক পরিকল্পনা করেছিলেন, যা বিস্মিত করবে বিশ্বজনকে। এমনটাই ভেবেছিলেন। জানা যায়নি তাঁর মনের ভেতর তাজমহলের স্থাপত্যের গরিমা ছিল কি না! উইলিয়াম এমারসনকে দিয়েছিলেন দায়িত্ব। উইলিয়াম এমারসন সহযোগী হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন ইসচ সাহেবকে। ভিত থেকে প্লিন্থ পর্যন্ত দরপত্র অনুযায়ী দায়িত্ব পেয়েছে রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের কোম্পানি, মার্টিন কোম্পানি। বাংলায় মার্টিন রেলের গোড়াপত্তন তাঁরই হাতে। তিন বছর চলে গেল সব কিছু ব্যবস্থা করতে। গড়ের মাঠের দক্ষিণ প্রান্তে ৬৪ একর জমি দরকার। সেখানে রয়েছে প্রেসিডেন্সি জেল। সেই জেল স্থানান্তরিত হল। সেই বিল্ডিং ভেঙে ভিত খোঁড়া শুরু হয় ১৯০৪ সালে।
***
বঙ্গে তখন শিক্ষিত সম্প্রদায় লর্ড কার্জনের বিরুদ্ধে একটু একটু করে ক্ষোভ সংগঠিত করছে। ১৯০৩ সালে কার্জন প্রস্তাব দিয়েছে বঙ্গভঙ্গের। ‘দ্য বেঙ্গলি’ পত্রিকায় ১০ ডিসেম্বর ১৯০৩-এর সংখ্যায় ছাপানো হল প্রতিবাদ লেখা। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র দত্তের সভাপতিত্বে কলকাতায় হল প্রতিবাদ সভা। ১৯০৪ রবীন্দ্রনাথ লিখলেন ‘স্বদেশী সমাজ’। ২২ জুলাই, ১৯০৫ রবীন্দ্রনাথ পাঠ করলেন তাঁর স্বদেশ ভাবনা। দু’হাজার কপি বিলি করা হয়েছিল সেই সভায়। উন্মাদনা তৈরি করল বিপুল মানুষের ভিড়। তার আগেই ১৯০৫ সালের ১ জুলাই-এর ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকার সংখ্যায় কৃষ্ণকুমার মিত্র লিখলেন, ‘বিদেশী দ্রব্য বয়কটের ডাক’। বঙ্গের মানুষ সংগঠিত হচ্ছেন। মুখে তাঁদের ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই’। স্বদেশ চেতনা জাগ্রত ও সংগঠিত হচ্ছে। ১৬ অক্টোবর, ১৯০৫ ঐতিহাসিক রাখীবন্ধন উৎসব হল কলকাতায়। কাতারে কাতারে মানুষ অংশগ্রহণ করলেন। বাঙালির জাতীয়তাবাদী বোধের উন্মেষ এর প্রকাশ ঘটছে এই সময়েই। ১৯০৫-এ অরবিন্দ ঘোষ, প্রমথনাথ মিত্র, সরলাবালা, নিবেদিতা, যতীন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়েরা তৈরি করলেন গুপ্ত সমিতি। স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য তৈরি হচ্ছে বাংলা ও বাঙালি। ক্ষুদিরাম বসু-প্রফুল্ল চাকীর আত্মত্যাগ, মুরারিপুকুর বোমার মামলা, কানাইলাল দত্তের ফাঁসি, বারীন ঘোষ সহ বহু বিপ্লবীর নির্বাসন, বিপ্লবী অরবিন্দ থেকে ঋষি অরবিন্দের রূপান্তর, রাসবিহারী বসু— বাংলা ও বাঙালি ফুটছে তখন। কার্যত দিশেহারা কার্জন। রানি ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিসৌধ করে বঙ্গের তথা ব্রিটেনের লোকজনকে বিস্মিত করার বিষয়টির অগ্রাধিকার পেল না আর। অগ্নিযুগের আরেক নতুন বাংলা ও বাঙালির উত্থানপর্ব। লর্ড কার্জনের বিদায় ঘটল ভারত থেকে। ব্রিটিশ বিরোধী মানসিকতা বাংলার জনমানসে তখন।
***
১৯০৬ সালের ৪ জানুয়ারি প্রিন্স অব ওয়েলস এলেন কলকাতায়। গড়ের মাঠে পুলিসি ব্যবস্থা জোরদার। ব্রিটিশদের উপাধি পাওয়া রাজা, মহারাজা, রাজা বাহাদুর, জমিদার সবাই জড়ো হলেন। সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে বড়। ৬৪ একর জমি ঘিরে ফেলা হয়ে গিয়েছে। বড় বড় গাছ। সবুজ গালিচার মতো ঘাস। আর গঙ্গার হাওয়া। প্রিন্স অব ওয়েলস করলেন ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন। রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বোঝাচ্ছেন নকশা। জনগণের থেকে চাঁদা উঠেছে কোটি টাকার উপর। রাজস্থানের মাকরান (বর্তমানে পাকিস্তানে) থেকে আনানো হবে মার্বেল। সম্পূর্ণ মার্বেলের হবে স্মৃতিসৌধ। ভিত ও প্লিন্থের কাজ হতে হতে ১৯১০ সাল। কয়েকমাস বাদেই দেখা গেল ফাটল। নরম পলিমাটি রাখতে পারছে না। দৈর্ঘ্য ৩৩৮ ফুট, প্রস্থ ২২৮ ফুট। রাজেন্দ্রনাথের সেই শাল-বল্লার স্ট্রাকচার করে ভিত তৈরির নকশা মেনে নিলেন স্থপতি এমারসন। দাঁড়িয়ে গেল স্ট্রাকচার। ভিতে সেই কড়ি-বরগার আদি স্ট্রাকচার ধরে থাকল ইমারত। রাজেন্দ্রনাথের মার্টিন কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ভিত তৈরির মাত্র। কিন্তু এবারে নতুন চুক্তি করা হল পুরো সৌধ নির্মাণের। ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধ নির্মাণের সঙ্গে জড়িয়ে থাকলেন এক বাঙালি স্থপতি। ইতিমধ্যে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হল আর সঙ্গে সঙ্গে ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে স্থানান্তরিত হল দিল্লিতে। সৌধ নির্মাণের কাজের গতি কমে যাচ্ছে ক্রমশ। ১৯১২ সালে পঞ্চম জর্জ আবার এলেন অগ্রগতি দেখতে। বিরাট বাগান চারপাশে। সেই বাগানেরও সাজসজ্জা দরকার। লর্ড রেডেসডেল ও জন স্টেইন বলে দু’জন উদ্যান বিশারদ তৈরি করছেন সুদৃশ্য বাগান, জলাশয়, ফোয়ারা, বাগান-পথ, বসার জায়গা।
রক্তাক্ত ১৯১৯ সাল। রাওলাট আইন, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যালীলা। ফুঁসে উঠেছে ভারতবর্ষ। ফুঁসে উঠেছে বাংলা। রবীন্দ্রনাথের নাইট উপাধি ত্যাগ। গান্ধীজির নেতৃত্বে আইন অমান্য আন্দোলনের ঘোষণা ১৯২০ সালে। বিপ্লবী রাসবিহারী বসু তখন জাপানে আত্মগোপন করে রয়েছেন। ১০ ডিসেম্বর, ১৯২১, কলকাতায় গ্রেপ্তার হলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষচন্দ্র বসু সহ অনেক নেতা। কলকাতার পথে পথে রোজ ব্রিটিশ বিরোধী মিটিং মিছিল চলছে। চলছে ধরপাকড়। আর ঠিক এই সময়ে রানি ভিক্টোরিয়ার সুবিশাল স্মৃতিসৌধ উদ্বোধনে এলেন রাজা পঞ্চম জর্জ। ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধ উদ্বোধন করলেন তিনি ২৮ ডিসেম্বর। সাল ১৯২১।
সবুজ গড়ের মাঠের প্রান্তে সবুজের উপর সাদা স্মৃতিসৌধ তার আভিজাত্যে মোড়া গর্বোদ্ধত সৌন্দর্য নিয়ে নীল আকাশের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আছে। হতবাক কলকাতার সাধারণ আদুল গায়ে ধুতি জড়ানো মানুষগুলো। কলকাতার অন্যতম সুউচ্চ ইমারত। সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল ২০৫ ফুট, হাইকোর্ট ১৭৬ ফুট, অক্টারলোনি মনুমেন্ট (শহিদ মিনার) ১৫২ ফুট আর ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধের গম্বুজ পর্যন্ত উচ্চতা ১৮৪ ফুট। তার উপর ১৬ ফুটের ব্রোঞ্জের পরী। তিন টন ওজনের এই সুন্দরী পরীটি তৈরি হয়ে এসেছে ইতালি থেকে। লোহার গেটগুলিও এসেছে ব্রিটেন থেকে। মূল ভবনের ওজন ৮০ হাজার ৩০০ টন। শুধু মার্বেল লেগেছিল ৪৫০.২৪ ঘনমিটার। মার্বেল কিনতে খরচ লেগেছিল তখনকার যুগে ২৩ লক্ষ টাকা। মার্বেল আনার খরচ ২ লক্ষ টাকা রেল কর্তৃপক্ষ ছেড়ে না দিলে মার্বেলের খরচ ২৫ লক্ষ টাকা হতো। বাগান সমেত স্মৃতিসৌধ নির্মাণে খরচ হয়েছিল ১ কোটি ৫ লক্ষ টাকা। সব টাকাটাই চাঁদা হিসাবে তোলা হয়েছে বঙ্গবাসীর থেকে। স্মৃতিসৌধের গম্বুজটি পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম গম্বুজ। চওড়া চওড়া সিঁড়ি দিয়ে চাতালে উঠে মাঝের কুইন্স হলে ঢুকেই উপরে তাকালে দেখা যাবে গম্বুজের ভেতরের অংশ। নজরে পড়বে অর্ধচন্দ্রাকার বেশ কিছু বড় বড় ছবি। হলঘরের পাশ দিয়ে ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাওয়া যায় সেই গম্বুজের ভেতরের দেওয়ালে ছবিগুলির সামনে মার্বেলের রেলিং দেওয়া বারান্দা। মোট বারোটি ছবি আছে। ১৮৩৭ সালে রাজা চতুর্থ উইলিয়ামের মৃত্যু সংবাদ পাচ্ছেন রানি ভিক্টোরিয়া, রানির অভিষেক এবং তাঁর জীবনের বিশিষ্ট বারোটি আখ্যানমালা। শেষ অর্থাৎ বারো নম্বর ছবিটি তাঁর মৃত্যুসজ্জার (১৯০১)। দেওয়ালে দেওয়ালে ছবির পর ছবি। ড্যানিয়েল, টিলি কেটল, জোহান জোফানি, উইলিয়াম হজ, এমিলি ইডেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু প্রমুখ শিল্পীর ছবি। বহু পুরনো পাণ্ডুলিপি, দলিল-দস্তাবেজ, কাগজ-পত্তর। দেখা যায়, পুরনো কলকাতার দুষ্প্রাপ্য ফোটোগ্রাফি এবং পুরনো অস্ত্রশস্ত্রের উল্লেখযোগ্য সংরক্ষণ। বিখ্যাত ব্রিটিশ শাসকদের মূর্তিগুলির মাঝে আছে এক বাঙালির মূর্তি, তিনি স্থপতি রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।
১৯২১ সালের ২৮ ডিসেম্বর। কলকাতায় বেশ শীত। ব্রিটিশদের কাছে এই শীত বেশ আরামদায়ক হলেও এই মূহূর্তে ব্রিটিশ শাসকদের উদ্বেগের শেষ নেই। গড়ের ময়দান ঘিরে ফেলেছে ব্রিটিশ পুলিস। গোয়েন্দারা সজাগ। রাজা পঞ্চম জর্জ আসছেন রানিমার স্মৃতিসৌধ উদ্বোধন করতে এই ময়দানে। যে কলকাতা দেখেছিল রানি ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুতে নগর সংকীর্তন, সেই কলকাতা দেখল তেরঙ্গা পতাকা নিয়ে তরুণরা পথে নেমেছে স্বরাজের দাবিতে, স্বাধীনতার দাবিতে। একটা কোম্পানির হাত ধরে আসা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে।
একশো বছর ধরে ঐতিহাসিক স্থাপত্য ও সংরক্ষণের নিদর্শন হিসেবে সেই স্মৃতিসৌধ আজও দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে গড়ের মাঠে, কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে আজও, আজও মানুষের ওই ওই যে মিছিল এগিয়ে আসছে অধিকারের দাবিতে, গণতন্ত্রের দাবিত...আজও...আজও...!!
ছবি ও গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : উজ্জ্বল দাস