শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহ বৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে ... বিশদ
মিমির মুখে স্বাদ নেই। মায়ের হাতের রান্নাও মুখে রুচছে না তার। কিছুদিন বাদে গন্ধের বোধও উধাও। হ্যাঁ, মিমি কোভিড পজিটিভ। ক্রমশ বাড়ির বাকিদেরও পরীক্ষা হল। সকলেরই একই রেজাল্ট। অতএব বাড়িতে কোয়ারেন্টাইন। টেলি মেডিসিনে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে ওষুধ চালু হল অচিরেই। ওষুধের পাশাপাশি অতিরিক্ত পুষ্টিযুক্ত আহারও চাই বলে দিলেন ডাক্তারবাবু। পুষ্টিকর খাবার ছাড়া শরীরে জোর আনা সম্ভব নয়। আর ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করতে গেলে, ওষুধগুলো সঠিকভাবে কার্যকরী করতে হলে শরীরে পুষ্টি মাস্ট। কিন্তু একে বিস্বাদ মুখ তাতে অসম্ভব ক্লান্তি। এই অবস্থায় রান্না করবে কে?
এমন যখন পরিস্থিতি তখন তা সামাল দিতেই এগিয়ে এসেছেন শেফ ইরা সিঙ্ঘল। ফেসবুকেই তিনি কিচেন অব ফ্লেভারস নামে একটা পেজ চালু করেছেন। সেই পেজে রোজ নানা হোম শেফ বিভিন্ন ধরনের রান্নার ছবি পোস্ট করেন। এখন শেফ সিঙ্ঘলের উদ্যোগে সেইসব রান্নাই বৃহদাকারে করে করোনা আক্রান্ত রোগীদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন তাঁরা। এবং এই কাজ তাঁরা করছেন সম্পূর্ণই বিনামূল্যে।
কিছু বিশেষত্ব আছে
তাঁদের খাবারের কিছু বিশেষত্ব আছে জানালেন শেফ ইরা সিঙ্ঘল। খাবার অতিরিক্ত সুস্বাদু কিন্তু একইসঙ্গে খুবই পুষ্টিকরও বটে। তেল মশলার ব্যবহার প্রায় নেই। রোগীর পথ্যকেও যে রান্নার গুণে সুস্বাদু করে তোলা যায় তাই প্রমাণ করে দেখিয়েছেন শেফ। এইসব খাবার সুইগি জিনি এবং উইফ্যাস্ট এই দু’টি অ্যাপের মাধ্যমে কোভিড রোগীদের বাড়িতে পৌঁছনোর বন্দোবস্ত করা হচ্ছে।
হঠাৎ এই কাজের চিন্তা এল কেন? প্রশ্ন করলে ইরা বলেন, করোনার ফার্স্ট ওয়েভে তাঁরা আক্রান্ত হয়েছিলেন সপরিবার। সর্দি, জ্বর, আর গা-হাত-পা ব্যথা সামলে নিজেদের এবং দু’টি ছোট বাচ্চার দেখভাল প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল তাঁদের পক্ষে। তার মধ্যে রোজ দু’বেলা রান্নার চিন্তা আর সামলে উঠতে পারছিলেন না। তখন থেকেই এই কোভিড রোগীদের জন্য খাবারের ব্যবস্থাপনার চিন্তাটা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। তারপর যখন ইরা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেন তখন এই কাজে কোমর বেঁধে নেমে পড়লেন। নিজে শেফ হওয়ার কারণেই বিভিন্ন মহিলার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল যাঁরা রান্নাবান্নায় পটু। তাঁদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে একটা গ্রুপ তৈরি করলেন ইরা। এই মহিলারা নিজেদের মধ্যে দল ভাগ করে কোভিড সেবায় লেগে পড়লেন।
ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে কাজ
প্রথমে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে হেলদি মেনু বিষয়ে একটা ধারণা করে নিলেন ইরা। সেই মেনুর উপকরণ দিয়ে নানা স্বাদে রান্না করার চেষ্টা করতে শুরু করলেন। কিছু এক্সপেরিমেন্টাল রান্না, কিছু বা গতানুগতিক। দুইয়ে মিলে অভিনব বিভিন্ন পদ শুরু হয়ে কিচেন অব ফ্লেভারস-এ। মাত্র পাঁচ থেকে ছ’জন মহিলা নিয়ে যে দলটি তৈরি হয়েছিল তা-ই এখন তিরিশজন সদস্যের বড় দলে পরিণত হয়েছে। ইরা আছেন দলের মাথা হিসেবে। সম্পূর্ণ প্ল্যানিং এবং পরিচালনা তাঁর হাতে। বললেন, ‘আমরা রোজকার একটা লিস্ট তৈরি করি। ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে আমাদের যোগাযোগ করা যায়। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে আমরা পরিষেবা দিই। সব পরিষেবাই লোকাল মহিলা দিয়ে চালানো হয়। ফলে খাবার বাসি হওয়ার কোনও সম্ভাবনা থাকে না।’ ফ্লেভারস অব কিচেনের ফেসবুক পেজে গিয়ে বিস্তারিত জানতে পারেন। বা ওই পেজে মেসেজও করতে পারেন। সেই মেসেজে আপনার প্রয়োজনের কথা তো জানাবেনই, তাছাড়াও ঠিকানা এবং ফোন নম্বর দিতেও ভুলবেন না। আপনার এলাকা অনুযায়ী আপনার সঙ্গে হোম শেফ যোগাযোগ করবেন এবং তারপর আপনার চাহিদা মতো খাবার পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন।
যেখানে যেমন সেখানে তেমন
কলকাতা, দিল্লি, লখনউ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান থেকে শুরু করে অসম, মিরাট ইত্যাদি অঞ্চলে খাবারের পরিষেবা দিচ্ছে কিচেন অব ফ্লেভারস। এন্টালি এলাকার হোম শেফ প্রীতি বলেন, বাড়ির রান্না অনেক সময় একঘেয়ে হয়ে যায়, তখন বাড়ির মতো রান্না খেতে মন চায়। কিচেন অব ফ্লেভারস-এ আমরা সেই বাড়ির মতো রান্না করে কোভিড আক্রান্তদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। সব রান্নাতেই পুষ্টির দিকটা খেয়াল রাখা হচ্ছে। একটা নিউট্রিশন চার্ট অনুযায়ী আমরা রান্না করার চেষ্টা করছি।
কলকাতায় বাঙ্গুর এবং এন্টালি এই দু’টি এলাকা থেকে আপাতত পরিষেবা চালানো হচ্ছে। বাঙ্গুরে যিনি পরিষেবা দিচ্ছে তাঁর নাম শ্বেতা জৈন। বললেন, রান্না করার শখ তাঁর বরাবরের। কমিউনিটির পুজো বা অন্য কোনও অনুষ্ঠানে খাবারের জোগান দিয়েছেন বহুবার। এবার ইরার সঙ্গে মিলিত হয়ে দেশের জন্য কিছু করার সুযোগ পেয়ে তিনি আপ্লুত। তাঁর কথায়, ‘আমি রান্নায় খুব সহজেই নতুনত্ব আনার চেষ্টা করি। ইরার গাইডলাইন মেনে নিজের কিছু বিশেষত্ব মিশিয়ে রান্নাকে পুষ্টিকর ও সুস্বাদু করার চেষ্টা করছি। আমার রান্না খেয়ে যদি কোভিড আক্রান্তরা সুস্থ হয়ে উঠতে পারে তাহলে খুশি হব।’
সহজ, সুস্বাদু ও পুষ্টিকর
খুবই সিম্পল মেনু রাখা হয়েছে, জানালেন ইরা। তাঁর কথায়, কোভিডে আক্রান্ত রোগী গুরুপাক খাবার খেতে পারে না, তার দরকার পুষ্টিকর খাবার। তাই প্রতিটি মিলেই ডিম অথবা চিকেন রাখা হয়েছে। এছাড়া ভাত, ডাল, সব্জি ইত্যাদিও পাবেন। মাশরুমে নাকি পুষ্টিগুণ প্রচুর, সেক্ষেত্রে ওই পদটি থাকছে কি না সে বিষয়ে প্রশ্ন করলে ইরা জানান, এখনও মাশরুমের কোনও রান্না তাঁরা রাখেননি। তবে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে যদি সঠিক মনে করেন তাহলে অবশ্যই এই উপকরণ দিয়ে পদ তাঁরা রাখবেন। ইরার কথায়, মুখে স্বাদ না থাকায় যে কোনও খাবারেই অরুচি হয়। ফলে সেই অরুচি কাটিয়ে স্বাদ ফিরিয়ে আনাটাই এক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি বললেন, হাল্কা রান্নাও যাতে মুখরোচক করা যায় সেই চেষ্টাই তিনি এবং অন্যান্য হোম শেফরা করে চলেছেন। একই উপকরণ দিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানা ধরনের রান্না করছেন। চিকেন স্টক, মাটন স্টক ইত্যাদি কাজে লাগিয়ে রান্নার স্বাদ তুলছেন। তাতে পুষ্টিও থাকছে আবার রান্না সুস্বাদুও হচ্ছে। এছাড়া তাঁরা গোলমরিচ এবং লেবুর রসও পরিমাণ মতো ব্যবহার করছেন রান্নায়, জানালেন ইরা। তাঁর কথায় এই ভাইরাসকে আটকাতে হলে নিজের ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করে তুলতে হয়। তার জন্য চাই ভিটামিন সি যা কিনা লেবুর রসে থাকে। আর গোলমরিচ শরীরের পক্ষে ভালো। তাই গোলমরিচও রান্নায় ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়াও রসুনও থাকছে কিছু কিছু পদে। এইভাবেই রান্নার স্বাদ বাড়িয়ে, তাতে নতুনত্ব এনে মুখরোচক করে তুলছেন ইরা ও তাঁর শেফ বাহিনী।