শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহ বৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে ... বিশদ
পেশার কোনও ভাগ থাকে না
মূলত পুরুষের যেখানে আধিপত্য সেই অটো চালানোর পেশায় কেন এলেন লাইবি? প্রশ্ন করলে অবাক হয়ে বলেন, ‘পেশায় আবার পুরুষ-নারী ভাগ থাকে নাকি? যে কাজ ছেলেরা পারে সে কাজ মেয়েরাই বা পারবে না কেন?’ তাই নিজেকে প্রমাণ করার জন্যই তিনি স্বেচ্ছায় এই পেশা বেছে নিয়েছিলেন। লাইবি ওনামের মতো আমাদের দেশে আরও অনেক মহিলা আছেন যাঁরা পুরুষের আধিপত্যের তোয়াক্কা না করেই এগিয়ে এসেছেন অটোচালিকা হতে। সব কাজ সকলের জন্য— এই নীতিতে বিশ্বাসী কয়েকজন অটোচালিকার মুখেই শোনা যাক তাঁদের এই পেশায় আসার কথা।
মেয়েরাই বা বাদ কেন?
কলকাতার হাজরা থেকে টালিগঞ্জ রুটে মহিলা অটোচালিকাদের দারুণ রমরমা। শুরুটা হয়েছিল ২০১৮ সালের গোড়ার দিকে। দক্ষিণ কলকাতার অটো ইউনিয়নের নেতা গোপাল সুতার কয়েকজন মেয়েকে অটো চালানোর প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। তাঁর প্রশিক্ষণে মোট ৩০ জন মহিলা ছিলেন যাঁদের মধ্যে ১২ জন অটো চালানো শিখে লাইসেন্স পেয়ে পেশাদার হয়ে উঠেছেন।
অটো চালানোর কাজে মেয়েদের নিয়ে আসার ভাবনাটা এল কেন? গোপালবাবু বলেন, ‘মেয়েরা সব কাজেই এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু যানবাহন, বিশেষত পাবলিক ট্রান্সপোর্ট চালানোর কাজে তাঁদের ততটা দেখা যায় না। বাস, ট্যাক্সি, অটো, রিকশা ইত্যাদি চালাতে মেয়েদের খুব একটা খুঁজে পাবেন না। ওই পেশাগুলো যেন ছেলেদের একচেটিয়া। রিকশার ক্ষেত্রে না হয় বেশি শক্তির দরকার। কিন্তু বাকিগুলো? তাতে মেয়েদের কাজ করতে বাধা কোথায়? তাই পুরুষদের আধিপত্য ভাঙার জন্যই মেয়েদের অটো চালানো শেখানোর কাজ শুরু করি।’ তাঁর কথায়, মেয়েরা যদি প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসে দেশ চালাতে পারেন, তাহলে অটোর িস্টয়ারিং ধরে চালাতে পারবেন না-ই বা কেন? তাছাড়া মেয়েরা অটো চালালে সংসারেও একটু স্বাচ্ছন্দ্য আসে। সব কাজই ভাগ করে নিলে তা সহজ হয়ে যায়। অতএব এই ভাবনা থেকেই মেয়েদের অটো চালানো শেখানো শুরু করেন গোপাল সুতার।
সংসারে সচ্ছলতা আর নিজেদের রোজগার
টালিগঞ্জের বিভিন্ন রুটে অটো চালান মৌসুমী সর্দার। হঠাৎ এই পেশায় কেন? মৌসুমী বলেন, ‘যখন ক্লাস এইটে পড়ি তখন বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। আর ফেরেননি। সংসার চালাতে আর আমাদের তিন বোনকে মানুষ করতে মায়ের হিমশিম অবস্থা। তখনই পড়াশোনা ছেড়ে মায়ের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। একটা অটোর গ্যারেজে মেকানিকের কাজ শিখে অটো সারানোর কাজে যুক্ত হই। সেখানেই আমায় দেখে গোপালকাকু (সুতার) জিজ্ঞেস করেছিলেন অটো চালানো শিখব কি না? এক কথায় রাজি হয়ে যাই। সেই থেকেই অটো চালানো শিখে এখন দিব্যি রোজগার করছি। দুই বোনকে পড়াশোনা শেখাতে পেরেছি।’
মৌসুমীর মতোই টালিগঞ্জে অটো চালান রূপা নায়েক। ৩২ বছরের রূপা খানিকটা বিরক্ত হয়েই এই পেশায় এসেছিলেন। তিনি ছিলেন গৃহবধূ। সংসারে স্বামীই একমাত্র রোজগেরে। আর সেই নিয়ে তাঁর ভীষণ দেমাক। রোজ স্ত্রীকে মারধর, গালিগালাজ। একসময় অসহ্য হয়ে উঠল রূপার কাছে। ঠিক করলেন, নিজেই রোজগার করবেন। জামাইবাবু অটো চালান। তাঁর কাছে খোঁজ নিয়ে ভর্তি হলেন গোপাল সুতারের স্কুলে। আজ তিনিও লাইসেন্সপ্রাপ্ত অটোচালিকা। রূপা বলেন, ‘প্রথমে ভেবেছিলাম এই কাজে আমিই বুঝি একা মহিলা। কিন্তু গোপালবাবুর ট্রেনিং স্কুলে গিয়ে দেখলাম আমার মতো আরও অনেক মেয়েই অটো চালানো শিখছে। একসঙ্গে এতজন মেয়েকে দেখে মনে ভরসা পেলাম। ভাবলাম আমিও পারব।’
কিছু শখ কিছু প্রয়োজন
সমাজের কোন স্তরের মেয়েরা অটো চালানো শিখতে বেশি আগ্রহী? প্রশ্ন করলে গোপালবাবু বলেন, সাধারণত আর্থিকভাবে পিছিেয় পড়া মেয়েরাই বেশি আসেন এই পেশায়। তাছাড়াও সমাজের নিম্নবিত্ত পরিবারের অনেক মেয়ে এই পেশায় আগ্রহী। অটো চালানোর মধ্যে একটা নতুনত্ব খুঁজে পেয়েছে মেয়েরা। ‘বাড়ি বাড়ি ঘুরে বাসন মাজা বা রান্না করার চেয়ে এই পেশা আমার কাছে অনেক বেশি আনন্দের’, বললেন হাজরার অটোচালিকা অঞ্জু মিস্ত্রি। তাঁর কথায়, ‘রোজ গাড়ি নিয়ে বেরলে অনেক লোকের সঙ্গে দেখা হয়। কতজন কতরকম কথা বলেন। কেউ অবাক হন, কেউ বা খুশি হন মেয়েদের এই পেশায় দেখে। সব মিলিয়ে দিনটা ভালোই কেটে যায়। তাছাড়া বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে বন্ধ থাকার চেয়ে খোলা আকাশের নীচে গাড়ি চালিয়ে ঘোরার মজা অনেক বেশি। তাই তো এই পেশা বেছে নিয়েছি।’গোপাল সুতারের মতে মেয়েদের এই অটো চালানোর পেশায় আশার মূল কারণ আর্থিক প্রয়োজন। তবে তারই সঙ্গে কোথাও যেন একটু শখও মিশেছে। গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে আরব বেদুইন হয়ে ওঠার নেশাটাও বুঝি মেয়েদের এই পেশার দিকে টেনে আনছে।
গো গুলাবো
কলকাতার রাস্তায় পিঙ্ক অটো প্রকল্পটি শুরু হয়েছিল গো গুলাবো নাম দিয়ে। মেয়েদের দ্বারা ও মেয়েদের জন্য এই প্রকল্প। তাতে মহিলা যাত্রীরা দারুণ আনন্দ পেয়েছিলেন। এই পথে রোজ যাতায়াত করেন এমন এক যাত্রী বললেন, ‘রাতবিরেতে কলকাতার রাস্তাঘাট মেয়েদের জন্য কখনও সখনও নিরাপদ থাকে না।’ তেমন পরিস্থিতিতে মহিলা অটোচালক বা পিঙ্ক অটো দেখলে একটা শান্তি পান তিনি মনে মনে। তাছাড়া মেয়েরা সমাজের চোখরাঙানির ঊর্ধ্বে উঠে সব পেশায় অবাধে বিচরণ করছে দেখলেও আনন্দ হয়। অটোচালিকারাও সমস্বরে এই কথায় সায় দিয়েছেন। বলেছেন, মহিলা যাত্রীদের সঙ্গে একটা বন্ধুত্ব হয়ে যায় তাঁদের। একই রুটে যাঁরা যাতায়াত করেন তাঁরা রীতিমতো পিঙ্ক অটো বা মহিলাচালিত অটোর জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। অনেক সময় কোনও যাত্রীর সঙ্গে এতটাই গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে যে বাড়ির অনুষ্ঠানে অটোচালিকা নেমন্তন্ন অবধি পান। অথবা কেউ হয়তো বেড়াতে গিয়ে চেনা অটোচালিকার জন্য ছোটখাট উপহারও কেনেন। এই সব অভিজ্ঞতা মনে রাখার মতো। ভীষণ ভালো লাগে এসব দেখলে। আবার কিছু যাত্রী মুখও বেঁকান। কেউ হয়তো মেয়ে বলে ভরসা করতে পারেন না ঠিক মতো। মৌসুমীর তো এমনও অভিজ্ঞতা হয়েছে যে মহিলা বলে লাইন ছেড়ে পরের অটোতে উঠেছেন এক যাত্রী। ‘এমন অভিজ্ঞতায় আগে বিরক্ত লাগত, এখন শুধুই হাসি পায়,’ বললেন তিনি। এই বছরের মধ্যে প্রায় ২০০ জন মহিলাকে এই পেশায় নিয়োগ করার কথা ভাবছে গো গুলাবো প্রকল্প।
রাজ্যে রাজ্যে অটোচালিকা
কলকাতার বাইরে দিল্লি, মহারাষ্ট্র, পাটনা বা পুণেতেও মেয়েরা ক্রমশ পারদর্শী হয়ে উঠেছেন এই পেশায়। দীর্ঘদিন ধরে দিল্লির রাস্তায় অটো চালাচ্ছেন পুষ্পা ভাট। বলেন, ‘পুরুষদের একচেটিয়া আধিপত্য ভেঙে মেয়েরা কিছু করতে চাইলে সে পথ মোটেও সুগম হয় না। আমার ক্ষেত্রেও হয়নি। আজও প্রচণ্ড কটাক্ষ করা হয় আমায়। পুরুষ সহকর্মীরা আমার সঙ্গে কোনও কাজে যোগ দিতে চান না।’ পুরুষদের এই আচরণ ঠেকাতে জোট বেঁধেছেন মহারাষ্ট্রের ৪০ জন অটোচালিকা। কুরলা, বান্দ্রা, আন্ধেরীতে অটো চালান তাঁরা।
তবে সর্বত্রই যে চিত্র এত খারাপ তা কিন্তু নয়। ১৯৮৮ সালের প্রথম অটোচালিকা শীলা দোয়ারে বললেন তিনি সাংসারিক অনটনে অটো চালাতে এসেছিলেন। সেই সময় পুরুষ অটোচালকরাই নিজেদের অটো দিয়ে তাঁর শেখার ব্যবস্থা করে দেন। কেউ ছুটিতে গেলে শীলাকে তাঁর জায়গায় অটো চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হতো। এইভাবেই শীলা ক্রমশ রোজগার করে, টাকা জমিয়ে নিজের অটো কিনতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এখন অনেক বয়স শীলার। নিয়মিত তাই অটো চালানো হয় না। কিন্তু মেয়েদের জন্য অটো ড্রাইভার’স অ্যাকাডেমি খুলতে চান তিনি। বললেন, ‘আরও বেশি মেয়ের এই পেশায় আসা উচিত। কাজের কোনও ভাগ হয় না। সমাজের কোথাও পুরুষ বা মহিলার জন্য কোনও ধরাবাঁধা কাজ নেই। সব কাজই সবার। সঠিক পথে রোজগার করে জীবন যাপনই আসল কথা। তাই মনের জানালাগুলো সবসময় খোলা রাখতে হয়।’